ডোমপাড়ার প্যানকাটুকে সবাই চেনে। তার আরেক নাম হরবোলা। তবে এ নামে কেউ তাকে ডাকে না। দুষ্টু ছেলেরা বিকৃত করে ডাকে ‘হরিবোল’। কেউ আরও বিকৃত করে বলে ‘বোলহরি’। তার পরিচিতি এক বিশেষ পারদর্শিতার জন্য। প্যানকাটু পশুপাখির ডাক নকল করতে পারে। এমনকি সে তাদের ভাষাও বোঝে বলে ডোমপাড়ার লোকদের বিশ্বাস। এ কারণে ডোমপাড়া ছাড়িয়ে শহরের লোকও তাকে চেনে। ডোমপাড়ায় ঝুট ফেলানোর নর্দমার পাশে, কালীমন্দির-ঘেঁষা পলিথিন-বাঁশ-খড়ের ছোট্ট ঝুপড়িতে পালক মা পাতানির সঙ্গে থাকে প্যানকাটু। সে অবশ্য ঝুপড়িতে তেমন থাকে না। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে শহরের রাস্তায়, গলিতে, ডাস্টবিনের কাছে, সাগরেদ কুকুর আর কাকদের সঙ্গে আড্ডায়।
মাতৃসদন হাসপাতাল হওয়ার আগে পাতানি ছিলেন এই শহরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাইদানি। প্রসূতির যত্ন, সন্তান প্রসব, নবজাতকের নাড়ি কাটা—এসবে তার হাত ছিল পাকা। ডোম হলেও কুলীন হিন্দু-মুসলমান সবাই ডাকত তাকে। সুখেই চলত তার সংসার।
একদিন পাতানি হঠাৎ একটি নবজাতক নিয়ে হাজির। কোথা থেকে এনেছেন, কেউ জানল না। ডোমপাড়ায় চাউর হলো, ‘কারও যমজ থেকে চুরি করেছে’, ‘কোনো কুমারীর পাপের ফসল’, ‘পাতানির নিজের পাপের ফসল’ ইত্যাদি। যেহেতু শিশুটির জাত-কুল জানা গেল না, ডোম সরদার রংলাল তার নামও রাখেননি। নবজাতকের পরিচয় প্রকাশ না করায় ডোমপট্টিতে পাতানিকে একঘরে করা হয় বেশ কিছুদিন। পাতানি নিজেই নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে শিশুটির নাম রাখলেন প্যানকাটু।
প্যানকাটু পরিচিতি এক বিশেষ পারদর্শিতার জন্য। পশুপাখির ডাক নকল করতে পারে। এমনকি সে তাদের ভাষাও বোঝে বলে ডোমপাড়ার লোকদের বিশ্বাস। এ কারণে ডোমপাড়া ছাড়িয়ে শহরের লোকও তাকে চেনে। সে ঝুপড়িতে তেমন থাকে না। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে শহরের রাস্তায়, গলিতে, ডাস্টবিনের কাছে, সাগরেদ কুকুর আর কাকদের সঙ্গে আড্ডায়।প্যানকাটু বড় হলো পাড়ার কুকুর, বাচ্চা শূকর আর কাকদের সঙ্গে খেলতে খেলতে। সে তাদের ডাক এমনভাবে নকল করত যে ডোমপাড়ার সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। প্যানকাটু যখন হাঁটতেও শেখেনি, তখন থেকেই কুকুরগুলো ওর গা ঘেঁষে বসত। কাকরা ডানা মেলে চারপাশে চক্কর দিত, বিড়াল এসে নাক দিয়ে তার হাতের তালু ঘষে দিত।
প্যানকাটুর বয়স এখন ১২–১৩ বছর। কুকুর, বাচ্চা শূকর আর কাকদের সঙ্গে তার সখ্য এখন আরও নিবিড়। শিসজাতীয় বিশেষ একটা শব্দ করলে কুকুর, বিড়াল, কাকগুলো কাছে আসে, আবার দূরে সরে যায়। প্যানকাটু যে ধরনের অঙ্গভঙ্গি করে, ওরাও তা–ই করে। কখনো কখনো ওরা প্যানকাটুর কথায় সাড়া দেয়। দেখে মনে হয় ওরা প্যানকাটুর সঙ্গে কথা বলছে। একদিন এক আগন্তুক এসব কীর্তিকলাপ দেখে প্যানকাটুকে বলেছিল ‘হরবোলা’।
দুই.ডোমপাড়ার কালীমন্দিরটি যেখানে তার পাশেই পাতানির একটি দোচালা ঘর ছিল। ওলাওঠায় স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তাকে ঘর ও জমিছাড়া করার চেষ্টা শুরু হয়। ডোম সরদারের শূকরের খোয়াড় বানানোর জন্য নর্দমার পাশের উঁচু জায়গাটিই সর্বোত্তম। কিন্তু পাতানি কোনো শর্তেই এই জায়গা ছাড়তে চাননি।
শীতের রাত। ডোম সরদারের শূকরের রাখাল মংলু হ্যাজাক নিয়ে শূকর গুনতে বেরিয়েছে। পাতানির ঘরের কাছে এসে সে নাকি অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়। খিড়কি দিয়ে ঘরের ভেতরে তাকাতেই কয়েকটি কুকুর তাকে তাড়া করে। তবে দৌড়ে পালাতে পালাতে নাকি মংলুর চোখে পড়ে পাতানির সঙ্গে দিগম্বর অবস্থায় অপরিচিত এক পুরুষ। ফলে ভোরের আলো ফোটার আগেই সরদারের হুকুম—পাপমুক্তির জন্য পাতানির ঘরটি পুড়িয়ে ফেলা হোক।
কেরোসিন, লাঠি, শুকনো খড় নিয়ে জড়ো হলো ডোমপাড়ার পুরুষেরা। আগুন লেলিহান হয়ে ওঠার আগেই বিছানা-বালিশ বাঁচাতে পাতানি ছুটে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেন। তিনি চিৎকার করে ‘মা কালী’কে নালিশ জানান। প্যানকাটু নির্বিকার দাঁড়িয়ে দেখে। প্যানকাটুর সঙ্গী কুকুরগুলো সরদারসহ সাঙ্গপাঙ্গকে তাড়া করে।
পরদিন ছাইয়ের স্তূপ সরিয়ে বানানো হলো নতুন টিনের ঝকঝকে দোচালা ঘর। সরদারের শুকরগুলো পেল স্থায়ী আশ্রয়স্থল। ঘর ও প্রাঙ্গণসহ মন্দিরের চারপাশ এখন শুকরের অভয়াশ্রম।
তিন.ঘর হারিয়ে নর্দমার ধারে ছোট্ট ঝুপড়িটা গড়ে তুললেন পাতানি। ঝুপড়িতে ঠাসাঠাসি হওয়ায় প্যানকাটু অনেক রাতই বাইরে কুকুর-শূকরের সঙ্গে কাটায়। পাতানির হাত পুড়ে যাওয়ার পর সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ল প্যানকাটুর ঘাড়ে। সে শহরের হোটেল থেকে এঁটো-পচা খাবার এনে কুকুর, কাক আর পাতানিকে নিয়ে খায়।
একদিন ডোমপট্টিতে এক পোয়াতি বিড়াল না খেয়ে মরে গেল। প্যানকাটু চুপচাপ বসে কাঁদল। পরে মরা বিড়ালটাকে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলল। সেদিন থেকেই তার অভ্যাস বদলে গেল। যদি মরা পশুপাখি পায়, প্যানকাটু আর হোটেলের এঁটো ছোঁয় না। তার কুকুর ও কাক বাহিনীও আগুনে ঝলসানো মাংস খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।একদিন ডোমপট্টিতে এক পোয়াতি বিড়াল না খেয়ে মরে গেল। প্যানকাটু চুপচাপ বসে কাঁদল। পরে মরা বিড়ালটাকে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলল। সেদিন থেকেই তার অভ্যাস বদলে গেল। যদি মরা পশুপাখি পায়, প্যানকাটু আর হোটেলের এঁটো ছোঁয় না। তার কুকুর ও কাক বাহিনীও আগুনে ঝলসানো মাংস খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
শুধু পাতানির জন্যই প্যানকাটুকে আলাদা করে খাবার জোগাড় করতে হয়। এই কাজে কুকুরের দল তাকে সাহায্য করে। দিনের এক সময় তারা ছড়িয়ে পড়ে—কেউ যায় হোটেলের সামনে, কেউ মিষ্টির দোকানের কাছে, কেউ শিশুপার্কের ফটকে। কেউ কিছু ছুড়ে দিলে সেটা মুখে নিয়ে ছুটে আসে প্যানকাটুর কাছে। সেই খাবার পাতানির মুখে তুলে দেওয়া হয়।
চার.মার্চ মাসের শেষ দিকে সবকিছু বদলাতে শুরু করে। কোনো এক অচিন দেশ থেকে আসা অতিমারি ঠেকাতে শহরে প্রবেশ বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। ক্রমে স্কুল, কলেজ, পার্ক, খাবারের হোটেল, শপিং মল—সবকিছুই বন্ধ হয়। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে শহরের অলিগলি। মায়ের খাবার জোগাড় করতে বিপাকে পড়ে প্যানকাটু ও তার সঙ্গী কুকুরগুলো।
দুদিন ব্যর্থ হয়ে অভিজাত মহল্লাগুলোর ডাস্টবিন থেকে খাবারের কিছু উচ্ছিষ্ট পায় প্যানকাটু। পরে সেটাও বন্ধ হয়।
তবে মরা পশুপাখি ভালোই পাচ্ছিল প্যানকাটু ও তার সঙ্গীরা। সেগুলো ঝলসে ক্ষুধা অনায়াসে মেটানো যেত, কিন্তু পাতানির উপযোগী খাবার মিলছে না তো। ফলে একদিন দুপুরে পাতানির নিশ্বাস চিরতরে বন্ধ হলো। প্যানকাটু একাই রাতের অন্ধকারে লাশ পোড়াল, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল আগুন নিভে যাওয়া পর্যন্ত।
পরদিন সকালে সরদার দলবল নিয়ে এসে বলল, ‘এই ছোঁড়া পাতানির লাশ পুড়ে খেয়েছে।’ প্যানকাটু কিছুই বলল না। শুধু শিস বাজিয়ে ধীরগতিতে পা চালাল ডোমপাড়ার বাইরে।
পাঁচ.শহরের লোকজনের হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে এক কিশোরকে, যে ধীর পায়ে হাঁটে আর তার পিছু পিছু চলে ডজনখানেক কুকুর। তাদের ঘিরে এলোমেলো উড়তে থাকে কিছু কাক।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরদ র র শ কর র র শ কর র জন য শহর র একদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
মেঘনা গ্রুপের চিনি কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, দেড়ঘন্টার চেষ্টায় নয়ন্ত্রণে
সোনারগাঁয়ের ঝাউচর এলাকায় মেঘনা গ্রুপের চিনি কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) রাতে এ ঘটনা ঘটে। সোনারগাঁ ফায়ার সার্ভিস ও মেঘনা গ্রুপের ৮ টি ঔ ইউনিট দেড় ঘন্টা চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
তবে হতাহত ও ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয়নি। আগুনের খবর সংগ্রহ করতে ঘটনাস্থলে যাওয়া সাংবাদিকদের কারখানায় প্রবেশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার বিষয়ে কথা বলতে কোন কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের ঝাউচর এলাকায় মেঘনা গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ফ্রেশ চিনির কারখানায় শুক্রবার রাত সাড়ে ৭ টার দিকে সাইলোতে হঠাৎ বিকট শব্দে আগুন ধরে যায়। এসময় আগুন বিভিন্ন সাইলোতে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে সোনারগাঁ ফায়ার সার্ভিসের ৩ টি ইউনিট ও মেঘনা গ্রুপের নিজস্ব ৫ টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। দীর্ঘ দেড় ঘন্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
প্রত্যক্ষদর্শী মেঘনা গ্রুপের চিনি কারখানার কর্মচারী সজল সরকার জানান, সীড ক্যারেসিন সাইলোতে আগুন ধরে যায়। মূহুর্তের মধ্যে আগুন বিভিন্ন সাইলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক ওসমান গণি জানান, মেঘনা গ্রুপের চিনি কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। বিস্তারিত পরে জানা যাবে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাষ্টিস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) কার্তিক চন্দ্র দাসের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি কল রিসিভ করেনি।