শৃঙ্খলার অজুহাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
Published: 19th, October 2025 GMT
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত আজ যে অবস্থানে পৌঁছেছে, তা রাষ্ট্রীয় নয়; বেসরকারি উদ্ভাবন ও সামাজিক উদ্যোগের ফসল। বেশ কিছু ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য বিমোচন, নারী ক্ষমতায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই সাফল্যের পেছনে সরকারি আমলাতন্ত্র নয়; বরং স্বাধীন ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় জবাবদিহি এবং মাঠভিত্তিক অভিজ্ঞতার জোরই প্রধান শক্তি। সেই পরিসরে সরকার এখন ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে দুজন ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ নিয়োগের বিধান আনতে যাচ্ছে, যা শৃঙ্খলার অজুহাতে আসলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নতুন অধ্যায় হতে পারে।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) দাবি করছে, ক্ষুদ্রঋণ খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন আনতেই তারা এই উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ অনেক সময় সুশাসন আনে না, বরং ‘অতিরিক্ত তদারকি’র সংস্কৃতি তৈরি করে। নিয়ম অনুসারে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালকেরা মুনাফাভোগী নন; তঁারা সমাজসেবামূলক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন। ব্যাংকের মতো এখানে গ্রাহকের আমানত নয়, দাতা সংস্থা ও পুনর্বিনিয়োগকৃত মূলধনই প্রধান অর্থের উৎস। ফলে ব্যাংকের সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের গঠনগত কোনো মিল নেই। দুই খাতের একই ধরনের নিয়ন্ত্রণকাঠামো চাপিয়ে দিলে তা হবে একধরনের প্রশাসনিক একরৈখিকতা, যা খাতটির স্বকীয়তা নষ্ট করতে পারে।
স্বতন্ত্র পরিচালক হতে হলে প্রস্তাবিত বিধি অনুযায়ী প্রার্থীকে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির চাকরিতে ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের জন্য নতুন এক পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করা। প্রশ্ন হলো, যে প্রশাসন সরকারি ব্যাংকগুলোর অপব্যবহার রোধে ব্যর্থ, তারা ক্ষুদ্রঋণ খাতের অনিয়ম ঠেকাতে পারবে কীভাবে? বরং এতে রাজনৈতিক প্রভাব, তদবির ও ব্যক্তিস্বার্থের নতুন দ্বার খুলে যাবে।
ক্ষুদ্রঋণ খাতের প্রতি সরকারের মনোভাব বরাবরই দ্ব্যর্থক। একদিকে এই খাতের সাফল্যকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রচারে ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে সময়মতো এদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা চলে। এমআরএর প্রস্তাবিত আইনেও দেখা যাচ্ছে, শুধু স্বতন্ত্র পরিচালক নয়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগেও অনাপত্তিপত্র নেওয়ার শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। এটি সরাসরি স্বশাসনের পরিপন্থী। কোনো এনজিওর সিইও নিয়োগের আগে সরকারি অনুমতি নিতে হবে, এমন বিধান স্পষ্টভাবে সরকারি হস্তক্ষেপের দরজা খুলে দেয়।
ক্ষুদ্রঋণ খাত নিখুঁত নয়, তাতে অনিয়ম-অদক্ষতা আছে—এ কথা সত্য। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এর প্রতিকার হতে পারে না। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, ব্যাংক খাতে ব্যর্থ মডেল ক্ষুদ্রঋণ খাতে প্রয়োগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বরং দরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার—যেমন স্বাধীন অডিট, জনসমক্ষে বার্ষিক প্রতিবেদন বা গ্রাহক তদারকি কমিটি।
এমআরএ যদি সত্যিই সুশাসন চায়, তবে তাদের উচিত হবে নীতিমালা প্রয়োগে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি, অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা মতামত দিতে পারবেন। ‘নিয়ন্ত্রণ’ নয়, বরং ‘সহযোগিতামূলক তদারকি’ হতে হবে লক্ষ্য।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ষ দ রঋণ খ ত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শৃঙ্খলার অজুহাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত আজ যে অবস্থানে পৌঁছেছে, তা রাষ্ট্রীয় নয়; বেসরকারি উদ্ভাবন ও সামাজিক উদ্যোগের ফসল। বেশ কিছু ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য বিমোচন, নারী ক্ষমতায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই সাফল্যের পেছনে সরকারি আমলাতন্ত্র নয়; বরং স্বাধীন ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় জবাবদিহি এবং মাঠভিত্তিক অভিজ্ঞতার জোরই প্রধান শক্তি। সেই পরিসরে সরকার এখন ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে দুজন ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ নিয়োগের বিধান আনতে যাচ্ছে, যা শৃঙ্খলার অজুহাতে আসলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নতুন অধ্যায় হতে পারে।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) দাবি করছে, ক্ষুদ্রঋণ খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন আনতেই তারা এই উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ অনেক সময় সুশাসন আনে না, বরং ‘অতিরিক্ত তদারকি’র সংস্কৃতি তৈরি করে। নিয়ম অনুসারে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালকেরা মুনাফাভোগী নন; তঁারা সমাজসেবামূলক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন। ব্যাংকের মতো এখানে গ্রাহকের আমানত নয়, দাতা সংস্থা ও পুনর্বিনিয়োগকৃত মূলধনই প্রধান অর্থের উৎস। ফলে ব্যাংকের সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের গঠনগত কোনো মিল নেই। দুই খাতের একই ধরনের নিয়ন্ত্রণকাঠামো চাপিয়ে দিলে তা হবে একধরনের প্রশাসনিক একরৈখিকতা, যা খাতটির স্বকীয়তা নষ্ট করতে পারে।
স্বতন্ত্র পরিচালক হতে হলে প্রস্তাবিত বিধি অনুযায়ী প্রার্থীকে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির চাকরিতে ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের জন্য নতুন এক পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করা। প্রশ্ন হলো, যে প্রশাসন সরকারি ব্যাংকগুলোর অপব্যবহার রোধে ব্যর্থ, তারা ক্ষুদ্রঋণ খাতের অনিয়ম ঠেকাতে পারবে কীভাবে? বরং এতে রাজনৈতিক প্রভাব, তদবির ও ব্যক্তিস্বার্থের নতুন দ্বার খুলে যাবে।
ক্ষুদ্রঋণ খাতের প্রতি সরকারের মনোভাব বরাবরই দ্ব্যর্থক। একদিকে এই খাতের সাফল্যকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রচারে ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে সময়মতো এদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা চলে। এমআরএর প্রস্তাবিত আইনেও দেখা যাচ্ছে, শুধু স্বতন্ত্র পরিচালক নয়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগেও অনাপত্তিপত্র নেওয়ার শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। এটি সরাসরি স্বশাসনের পরিপন্থী। কোনো এনজিওর সিইও নিয়োগের আগে সরকারি অনুমতি নিতে হবে, এমন বিধান স্পষ্টভাবে সরকারি হস্তক্ষেপের দরজা খুলে দেয়।
ক্ষুদ্রঋণ খাত নিখুঁত নয়, তাতে অনিয়ম-অদক্ষতা আছে—এ কথা সত্য। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এর প্রতিকার হতে পারে না। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, ব্যাংক খাতে ব্যর্থ মডেল ক্ষুদ্রঋণ খাতে প্রয়োগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বরং দরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার—যেমন স্বাধীন অডিট, জনসমক্ষে বার্ষিক প্রতিবেদন বা গ্রাহক তদারকি কমিটি।
এমআরএ যদি সত্যিই সুশাসন চায়, তবে তাদের উচিত হবে নীতিমালা প্রয়োগে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি, অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা মতামত দিতে পারবেন। ‘নিয়ন্ত্রণ’ নয়, বরং ‘সহযোগিতামূলক তদারকি’ হতে হবে লক্ষ্য।