উপদেষ্টারা জানেন নাকি, ফরিদপুর থেকে ভাঙ্গা, আহা মধু মধু মধু...
Published: 19th, October 2025 GMT
ট্রেনের দেরি একসময় এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, জনপ্রিয় প্রবাদ হয়ে উঠেছিল, নয়টায় ট্রেন কয়টায় ছাড়ে? বাংলাদেশের ট্রেন সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই অপবাদ থেকে বেশির ভাগটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছে। দুর্ঘটনা, দুর্যোগ কিংবা উৎসবের সময়কার মাত্রাতিরিক্ত চাপে শিডিউল বিপর্যয় ছাড়া ট্রেন মোটামুটি সময় ধরেই চলাচল করে। কিন্তু কালোবাজারি ঠেকাতে যে ট্রেনের টিকিট অনলাইনে নেওয়া হয়েছে, সেটা কতটা কমেছে?
অনলাইনে টিকিট ছাড়া হয় ১০ দিন আগে। ওয়েবসাইটে ঢুকতে এক থেকে দুই সেকেন্ড দেরি করলে বেশির ভাগ রুটে আর সেই টিকিট পাওয়া যাবে না। কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা ১০ দিন আগে কয়জনা আর করতে পারেন! আর সেই টিকিট পাওয়ার জন্য সকাল আটটা বাজার আগে মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা ট্যাবের সামনে বসে থাকতে পারেন! ফলে টিকিট নেই। কিন্তু যতই ডিজিটাল হোক, রেল কালো বিড়ালের আসর থেকে মুক্ত হতে পারেনি। অনলাইনে টিকিট নেই, কিন্তু টিকিট আছে কালো বিড়ালদের হাতে। তারা অস্তিত্বের তাগিদেই ডিজিটাল হয়ে উঠেছে। তারা আটটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে দল বেঁধে টিকিট কেটে ফেলে। আর সেই টিকিট বেশি দামে বিক্রি করে। মাঝেমধ্যে ভেজাল টিকিট দিয়ে বিপত্তিতে ফেলে যাত্রীদের। এমনিতেই অ্যাপ ব্যবস্থার কারণে ৫২ লাখের মতো মানুষ ট্রেনের টিকিট কাটতে পারছে। তারপর আবার ডিজিটাল টিকিটে কালো বিড়ালের থাবা।
ইদানীং সড়কপথে কেউ যদি পরিকল্পনা করে কোথাও যেতে চান, কিংবা গিয়ে ফিরে আসতে চান, ভাগ্যের বৃহস্পতি তুঙ্গে না থাকলে তাঁর কপালে ভোগান্তি ছাড়া আর কিছু লেখা নেই। অবকাঠামো খাতের তিন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানকেও গত সপ্তাহে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক পরিদর্শনে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে হয়েছে। তাঁর আগমন উপলক্ষে ভাঙাচোরা সড়কে আগে থেকেই ইট বিছানো হয়েছিল। রাস্তার পাশের ময়লার ভাগাড় বেড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি। প্রায় দুই ঘণ্টা জ্যামে আটকে থেকে গাড়ি থেকে নেমে তাঁকে মোটরসাইকেলে রওনা হতে হয়েছিল। সাড়ে ১০টার অনুষ্ঠানে তিনি পৌঁছাতে পারেন বেলা একটার দিকে। সেই ভিডিও ভাইরালও হয়। উপদেষ্টা বলেন, যানজট শুধু রাস্তার সমস্যা নয়; এখানে ট্রাফিকে শৃঙ্খলার অভার রয়েছে। যানবাহনগুলো এলোমেলোভাবে চলাচল করে থাকে।’ যাহোক, উপদেষ্টার সফরের পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সরাইলে শৃঙ্খলা ফিরেছে। গাড়ির চাপ থাকলেও যানজট আর নেই।
প্রথম আলো মহাসড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সড়কগুলোর দুর্দশা নিয়ে গত মাসে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংস্কারহীন সড়ক আর ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা হয়ে উঠেছে জনদুর্ভোগ আর দুর্দশার সমর্থক। সম্প্রতি পাটুরিয়া–দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এবং পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া ও কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যাওয়া ও আসা দুই ক্ষেত্রেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
ঢাকা থেকে রওয়ানা হওয়ার আগের দিন রাতে বৃষ্টি হয়েছে। সকালে বাসা থেকে বেরিয়েই সড়কে হাঁটুপানি। ভাগ্যক্রমে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা পাওয়া গেল, গন্তব্যে যেতে রাজিও হলো। কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হলো। সবটা পথ পেরিয়ে এলেও টেকনিক্যাল মোড় থেকে বিধিবাম। গাড়ি আর সামনে এগোয় না। ফলে নির্ধারিত বাস ধরতে না পারায় ভোগান্তির শুরু হলো। ভাগ্যক্রমে সদ্য এক মাস চালু হওয়া এই রুটের নতুন একটি কোম্পানির বাসে পেছনের সারির আগের সারিতে টিকিট মিলল। ঝাঁ–চকচকে বাস। বাইরে থেকে মনটা ভালো হয়ে গেল। কিন্তু ভেতরে উঠেই মোহ ভাঙল। গুমোট গন্ধ আর তেলচিটচিটে পুরোনো সিট।
শিরদাঁড়া সোজা রেখে কোনোরকমে বসা যায়। কিন্তু হাঁটুটা কসরত করেই সামনের সিটে ঠেকে যাওয়া থেকে বাঁচানো যায়। এর মধ্যে সিট ভেঙে দেওয়ার কারণে যাত্রীদের বচসাও বেধে গেল। বাসে সামনে একটা ও পিছনে ৫টা সিট এক্সটা যুক্ত করা হয়েছে।
দেখার দায়িত্ব কার? সড়ক পরিবহন সিন্ডিকেটের আসর থেকে মুক্তি দেবে কে? সামনের মুখগুলো শুধু পাল্টেছে। কিন্তু ব্যবস্থা পাল্টায়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সড়কের নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকিটবাজি আলোচিত ও নাগরিক উদ্বেগের বড় কারণ ছিল।
বলা হতো, রাজনৈতিক সরকারের আমলে পরিবহন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন যে শক্তিশালী নেক্সাস গড়ে ওঠে, সেখানে জনগণকে স্রেফ জিম্মি করা হয়। সেটা তো রাজনৈতিক সরকারের আমলের ব্যাপার। অন্তর্বর্তী সরকার কেন সেই নেক্সাস ভাঙতে পারল না? বরং এই সরকারের কাছ থেকে যে গোষ্ঠীরা বিশেষ সুবিধা আদায় করে নিয়েছে, তার মধ্যে সামনের কাতারে থাকবেন পরিবহন ব্যবসায়ীরাও। কথা ছিল, ২০ থেকে ২৫ বছরের পুরোনো বাস-ট্রাক রাস্তা থেকে তুলে দেওয়া হবে। সেটা তো হচ্ছেই না; বরং তাঁদের আরও বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। রিকন্ডিশন্ড বাস–ট্রাক আমদানির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব গাড়ি কেনার জন্য মালিকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি তাঁদের আয়করের বোঝা কমানোর দিকেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
যাহোক, গাবতলী থেকে আমিন বাজার পেরিয়ে হেমায়েতপুরের আগে বন্ধ হয়ে গেল গাড়ির চাকা। সেই যে বন্ধ হলো, সচল হতে লেগে গেল পাক্কা দেড় ঘণ্টা। রাস্তার পাশে উচ্ছেদ অভিযান। তাই সড়ক বন্ধ। যাক, দেড় ঘণ্টার মধ্যেই মুক্তি মিলল। ফেরিঘাটে পৌঁছে ফেরি নেই। সেখানেও ঘণ্টাখানেক বসে থাকা।
এরপর ঘাট পেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর রেলক্রসিংয়ের আগে এসে থেমে গেল বাস। সেখানেও পাক্কা সোয়া ঘণ্টা। এখানে কেন যে বাসের চাকা থেমে থাকল, তার উত্তর কেউ দিতে পারল না। রাজবাড়ী এসে জেলা পরিবহন মালিক সমিতির ষন্ডাপান্ডারা পাকড়াও করল যাত্রীসমেত বাসটি। সুপারভাইজারের সঙ্গে দেনদরবার ও লেনদেন শেষে মুক্তি মিলল। বলা চলে শনির দশা কাটল। শেষে গন্তব্যে পৌঁছানো গেল। একটি স্মরণীয় জার্নি বাই বাস। রচনা লিখলে ১০-এ অন্তত সাড়ে ৭ পাওয়া যেত। কিন্তু সাড়ে ৪ ঘণ্টার জার্নি শেষ করতে পাক্কা ৯ ঘণ্টা চলে গেছে।
ফেরার দিনে টিকিটের সংকট। এবার টিকিটে মিলল পেছনের সারিতে। এবার জার্নি বাই বাস পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় ফেরা। একের পর এক ওভারটেক করে বাস শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলেছে। স্প্রিড ব্রেকার পার হওয়ার সময় ক্ষণিকের জন্য মহাশূন্যে ভাসার অভিজ্ঞতা পাওয়া যাচ্ছিল। প্রতিবার লাফিয়ে ওঠার সিটটিও লাফিয়ে আলগা হয়ে জায়গা থেকে সরে যাচ্ছিল।
সুপারভাইজারকে ডেকে চালককে একটু সংযতভাবে চালানোর অনুরোধ করা হলে তিনি বললেন, গাড়ির প্রতি চালকের খুবই দরদ আছে। আর সিট কেন সরে যাচ্ছে, তা জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দিলেন, বোঝেন তো, সামনের একটি ও পেছনের এই পাঁচটি সিট পরে আলাদাভাবে লাগানো হয়েছে। ভেবে দেখলাম, নাগরিকের সেবার প্রতি কতটা অঙ্গীকার থাকলে একজন পরিবহনমালিক এমন কাজ করতে পারেন। সত্যিই তো, পেছনের সারিতে এক্সটা সিট না থাকলে তো আজ ফেরাই হতো না।.
এই বোঝার বিষয়টা যে কতটা ভয়াবহ ও দুর্বিষহ হতে পারে, সেটা বাস্তব অভিজ্ঞতা না হলে বোঝা যেত না। বাস কোম্পানিগুলোর উচিত যাত্রীদের সিটবেল্ট সরবরাহ করা। মনে হলো, একটা রোলারকোস্টারের মধ্যে জোর করে পুরে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলো দিয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান সড়ক এটি। ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী কিংবা একজন সংকটাপন্ন রোগী এই সড়ক দিয়ে কীভাবে যাবেন?
সহযাত্রীদের একজন বলে বসলেন, ‘উপদেষ্টারা জানেন নাকি, ফরিদপুর-ভাঙ্গার ২৫ কিলোমিটার রাস্তার খবরখানি’। পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলেন, ‘আহা...মধু মধু রসমালাই...’। সাম্প্রতিক কালে এ দুটি বিষয়ই ভাইরাল হয়েছে। সত্যিই, দুর্দশার মধ্যে কারো কারো রসবোধকে তারিফ করতেই হয়।
যাহোক, এক্সপ্রেসওয়েতে গিয়ে দুঃসহ ভোগান্তির অবসান হলো। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু ওই যে ছোটগল্পের ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’–এর মতো, মুন্সিগঞ্জে এসে টোল প্লাজার সামনে কয়েক মাইল দীর্ঘ গাড়ির সারি। পার হতে দুই ঘণ্টা হাওয়া হয়ে গেল। এক্সপ্রেসওয়েতে যদি টোল দেওয়ার জটিলতায় দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয়, তাহলে গাঁটের পয়সা খরচ করে মানুষ কেন সেখানে যাবে? সাড়ে চার ঘণ্টার যাত্রা শেষ হলো সাত ঘণ্টায়।
সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, চীন থেকে ১০টি যুদ্ধবিমান কিনবে বাংলাদেশ। হাসিনা সরকারের চালু করা বড় কেনাকাটা আর মেগা প্রকল্পের ফাঁদ থেকে কতটা বেরিয়ে আসতে পারল দেশ? শিক্ষকদের বাসাভাড়া ৫ শতাংশ বাড়ে। বলা হয়, সরকারি কোষাগারে টাকা নেই। টাকার অভাবে কিছুদিন পরপর বন্ধ করে দেওয়া হয় ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির সরকারি উদ্যোগ। অথচ সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন দ্বিগুণ করার জন্য নতুন পে স্কেল করার তোড়জোড় চলে। তরুণদের চাকরি, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা যায়নি। উল্টো নারীদের বড় একটা অংশ কাজ হারিয়েছে।
সব মিলিয়ে একটাই প্রশ্ন—সরকারের অগ্রাধিকার আসলে কোথায়? উড়ালসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সব কাজই তো চলছে। সড়ক-মহাসড়কের ক্ষতগুলো অন্তত ঢেকে দেওয়ার জন্য বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। উপদেষ্টারা এ সব সড়ক–মহাসড়ক ধরে
মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট র সরক র র ব যবস থ পর বহন স মন র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
সিটিজেনস ব্যাংকের বাড্ডা উপশাখার এক বছর পূর্তিতে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা
সিটিজেনস ব্যাংক পিএলসির বাড্ডা উপশাখার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে শতাধিক পোশাক শ্রমিককে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়েছে।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপশাখা কার্যালয়ে এ কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে একজন গাইনি এবং একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পরামর্শ দেন। প্রয়োজনীয় ঔষধও বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। এই কর্মসূচিতে সহযোগিতা করেছে বাড্ডা মা ও শিশু হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক লিমিটেড।
উদ্বোধন করেন সিটিজেনস ব্যাংকের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোস্তাফিজুর রহমান। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গুলশান কর্পোরেট শাখার ব্যবস্থাপক সালেক সাব্বির আহমেদ, মা ও শিশু হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক লিমিটেডের পরিচালক সামসুর নাহার শান্তি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আব্দুল্লাহ আলিফ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাড্ডা উপশাখার প্রধান সমীর চক্রবর্তী।
বক্তারা এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, পোশাক শ্রমিকদের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক এই ধরনের আয়োজন সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উপস্থিত শ্রমিকরাও সিটিজেনস ব্যাংকের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং ভবিষ্যতেও এমন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
ঢাকা/ইভা