টাচ স্ক্রিনে হারিয়ে যাচ্ছে কি হাতের লেখা
Published: 21st, November 2025 GMT
একসময় মানুষ নিয়মিত চিঠি লিখত। কে জানে, হয়তো কাগজ-কলম হাতে নিয়ে টেবিলে বসে লিখতে লিখতেই জন্ম হতো কবিতা, গল্প, উপন্যাস, থিসিস বই কিংবা মোহময় প্রেমের। আর এখন? প্রেম আসে ভয়েস নোটে, অডিও–ভিডিও কলে প্রেম ভেঙেও যায়। হাতের লেখার চর্চা আজকাল হয়ে উঠছে দুর্লভ।
হাতের লেখা হারিয়ে যাচ্ছে—এই বাক্য এখন কেবল গবেষক কিংবা গুরুজনদের মুখেই শোনা যায় না; তরুণ-তরুণীরাও প্রায়ই স্বীকার করেন যে, ভাই, হাতের লেখা আর আগের মতো নেই।
সমস্যা হলো, আমরা এমন এক টেকনো–সমাজ গড়ে তুলেছি, যেখানে হাতের লেখা এখন অনেকটাই ‘বিলাসী’ দক্ষতা। অথচ হাতের লেখাই ছিল মানুষের চিন্তার প্রথম এবং সবচেয়ে প্রাণবন্ত রূপ।
আধুনিকায়ন হাতের লেখার ওপর যে দখলদারি করেছে, তা আরেক গল্প। আগে রিপোর্ট লিখতে খাতা-কলম লাগত, এখন গুগল ডকস খুললেই চলে। ই–মেইল থাকায় চিঠি লেখা প্রায় বিলুপ্ত, নোট নেওয়ার খাতারও ব্যবহার নেই। এখন সবাই ফোনে ‘নোটস অ্যাপ’ খুলে রাখে। কাগজে দাগ কাটার আনন্দটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
প্রযুক্তি যেমন সুবিধা এনে দিয়েছে, তেমনি মানুষের ধৈর্যের ওপর এমন বসন্তের ঝড় বইয়ে দিয়েছে যে মানুষ এখন হাতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে যায়। তবে সারা রাত ফোন টিপতে কোনো সমস্যা নেই। শিশুরা এখন পেনসিল ধরতে চায় না, সোজা ট্যাব ধরে আঁকায় মন দিচ্ছে। ফলে তাদের হাতের মাংসপেশি যেমন দুর্বল হচ্ছে, তেমনই অক্ষর গঠনের সৌন্দর্যও যাচ্ছে কমে।
মজার ব্যাপার হলো, এখনকার মানুষ টাইপিংয়ের ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল যে হাত দিয়ে বেশি লিখতে বললে মনে হয় যেন এটি অতীত যুগের কোনো শাস্তির নির্দেশ। প্রতিদিন বিভিন্ন ক্লাসে নিয়মিতই খেয়াল করি, কেউ আর নোট নেয় না! ছাত্ররা হাতে লিখতে কিংবা ক্লাসে আসতে দেরি করে, কিন্তু চ্যাটিংয়ে ৩০ শব্দ প্রতি সেকেন্ডে গতি তুলতে পারে! সত্যিই তো, স্ট্যাটাস আপডেটের স্পিড এমন যে হাতের লেখা সেখানে যেন কচ্ছপগতি! এদিকে আজকাল কি–বোর্ডের অটো করেক্ট ফিচার মানুষের বানানজ্ঞানকেও বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে ‘বিশ্বাস’ লিখতে গিয়ে কেউ ‘বিছান’ লিখলেও ফোন সেটা ঠিক করে দেয়; আর হাতে লিখলে তো ভুলটা খুব লজ্জাজনকভাবে চোখে পড়ে।
আরও গভীর সমস্যা হলো প্রযুক্তির আরেকটি বিস্ময়, ভয়েস-টু-টেক্সট। মানুষ এখন লিখতে চায় না, বলতে চায়। ফোন শুনে নেয়, লিখেও দেয়। এ–ই নিয়ে হাস্যরসাত্মক ঘটনাও আছে অনেক। কেউ বলতে চেয়েছিল, ‘মাকে বললাম আসতে’। ফোন লিখে দিল, ‘মাকে বললাম হাসতে’। হাতের লেখা হলে তো এমন বিপদ কমই হতো।
শেষ কথা হলো, হাতের লেখা হারিয়ে যাচ্ছে না; বরং দ্রুত জীবনের আড়ালে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। আমরা যদি কলমটাকে একটু স্নেহ করি, তবে সে আবার ফিরে আসবে। স্ক্রিন যত উজ্জ্বলই হোক, কাগজ–কলমের নরম ছোঁয়া যে আলাদা আলো ছড়ায়, তা কখনোই নিভে যাবে না। যাহোক, কালি-কলম বেঁচে থাকুক—এই কামনায় লেখাটি শেষ পর্যন্ত টাইপ করেই লিখলাম।এআই এসে তো লেখার জগতে আরও বিপ্লব ঘটিয়েছে। এখন কেউ যদি বলে, ‘আমি একটা প্রবন্ধ লিখতে বসেছি, ’ সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ হয়, বসেছে তো বসেছে, কিন্তু লিখছে কে? চ্যাটজিপিটি, ডিপসিকের মতো টুল যখন মুহূর্তে লেখা বানিয়ে দেয়, তখন হাতে লেখা প্রবন্ধ যেন ইতিহাসের পাতার এক নিঃশব্দ গান। অফিস-আদালতেও এখন কাগজহীন নীতি চলছে। ‘সাইন’ করার বদলে এসেছে ‘ই-সিগনেচার’। ফলে কলমের ভূমিকা এখন শুধু চুক্তির আনুষ্ঠানিকতাতেই সীমাবদ্ধ। এমনকি বিদেশের অনেক ব্যাংকের কাউন্টারেও আপনাকে বলা হয়, ‘দয়া করে টাচপ্যাডে সাইন দিন।’
মনে প্রশ্ন জাগে, কবে থেকে সাইনও ডিজিটাল হলো? হাতে সাইন করার যে গর্ব, তা টাচপ্যাডে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।
তবে হাতের লেখা হারিয়ে গেলে সমাজ যা হারাবে, তা কিন্তু গভীর চিন্তার বিষয়। হাতের লেখা স্মরণশক্তি বাড়ায়, এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। হাতে লিখলে মস্তিষ্ক তথ্যকে ভিন্নভাবে প্রক্রিয়া করে, যা শেখা ও বোঝাকে শক্তিশালী করে। শিশুরা হাতে লিখে যা শেখে, তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের আবেগ, প্রেম, স্মৃতি, সাহিত্য—সবকিছুই কাগজে অক্ষরের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে। হাতে লেখা হস্তাক্ষর আজও বহু ঐতিহাসিক নথির অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি দেখলে যে আবেগ জাগে, তা কি কোনো টাইপ করা লেখায় পাওয়া যায়?
তাহলে কি হাতের লেখা বিলুপ্ত হবে? হয়তো পুরোপুরি নয়। হাতের লেখা মানুষের একটি গভীর সত্তা, যা হারিয়ে যেতে চায় না। যেকোনো জিনিসের শেষ আশ্রয় থাকে আবেগে। আর হাতের লেখার আবেগ আমাদের রক্তের ভেতরেই।
প্রয়োজন শুধু একটু সচেতনতা। প্রতিদিন একটু করে লেখা, সপ্তাহে এক দিন ডায়েরি লেখা, কারও জন্য হাতে লেখা নোট তৈরি করা—এগুলো হাতের লেখাকে বাঁচিয়ে রাখার চমৎকার উপায়। প্রযুক্তি আমাদের সঙ্গী, তবে হাতের লেখা আমাদের অন্তর। দুটোই থাকতে পারে পাশাপাশি, যদি আমরা চাই।
শেষ কথা হলো, হাতের লেখা হারিয়ে যাচ্ছে না; বরং দ্রুত জীবনের আড়ালে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। আমরা যদি কলমটাকে একটু স্নেহ করি, তবে সে আবার ফিরে আসবে। স্ক্রিন যত উজ্জ্বলই হোক, কাগজ–কলমের নরম ছোঁয়া যে আলাদা আলো ছড়ায়, তা কখনোই নিভে যাবে না। যাহোক, কালি-কলম বেঁচে থাকুক—এই কামনায় লেখাটি শেষ পর্যন্ত টাইপ করেই লিখলাম।
অধ্যাপক ড.
ইকবাল আহমেদ কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[মতামত লেখকের নিজস্ব]
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
২৫২ কোটি রুপির মাদক–কাণ্ডে ওরি! আবার তোলপাড় বলিউডে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় মুখ ওরহান অবাত্রামণি। সবাই তাঁকে চেনে ‘ওরি’ নামেই। বলিউড তারকাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, পার্টিতে নিয়মিত উপস্থিতির কারণে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হন। এবার তিনি আলোচনায় এসেছেন ভিন্ন এক কারণে; ২৫২ কোটি রুপির মেফেড্রোন মামলায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সমন পাঠিয়েছে মুম্বাই পুলিশের অ্যান্টি-নারকোটিকস সেল (এএনসি)।
গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁকে হাজির হতে বলা হয়েছিল; কিন্তু ওরি নিজে হাজির হননি। তাঁর হয়ে উপস্থিত হন আইনজীবী। তাঁর আইনজীবী তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান, ‘ওরি বর্তমানে ব্যক্তিগত কারণে হাজির হতে পারছেন না।’ একই সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের তারিখ ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। এখন এএনসির সিনিয়র কর্মকর্তারা সেই আবেদন বিবেচনা করছেন।
কীভাবে আলোচনায় এল ওরির নাম
এই হাইপ্রোফাইল মামলার মোড় ঘোরে মূল অভিযুক্ত মোহাম্মদ সেলিম মোহাম্মদ সুহেল শেখ, ওরফে ‘ল্যাভিশ’, তদন্তে নতুন তথ্য দেওয়ার পর। বিলাসী জীবনযাপনের কারণে পরিচিত ল্যাভিশ তদন্তে দাবি করেন, তিনি যে মাদক পার্টিগুলো আয়োজন করতেন, সেখানে মুম্বাইয়ের পরিচিত তারকা, ফ্যাশন দুনিয়ার ব্যক্তিত্ব, প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিমের এক আত্মীয় নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। সেই তালিকায় ওরির নামও উঠে আসে।এই তথ্যের ভিত্তিতেই এএনসি তাঁকে সমন পাঠায়। যদিও এখনো তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সরাসরি অভিযোগ আনা হয়নি।