গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ ও বেহাত বিপ্লব
Published: 25th, November 2025 GMT
বাংলাদেশের ইতিহাস মূলত গণমানুষের জাগরণের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান—প্রতিটি অধ্যায়ে তৃণমূল মানুষের আত্মত্যাগ, রক্ত ও স্বাধীনভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। কিন্তু প্রতিটি বিজয়ের পর ইতিহাস যেন এক অপ্রিয় বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। বিপ্লব হয়, পরিবর্তনের সুর বাজে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ফিরে যায় ভিন্ন মুখোশধারী একই গোষ্ঠীর হাতে। যেন—যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।
তাহলে প্রশ্ন জাগে—আমাদের গণ-অভ্যুত্থানগুলো কি সত্যিই জনগণের জন্য, নাকি সাধারণ মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার পালাবদলের হাতিয়ার?
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক মহান সামাজিক বিপ্লবের সামগ্রিক ফসল। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েই সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব চলে যায় রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত এক এলিট শ্রেণির হাতে। যাদের ওপর আস্থা রেখে জনগণ শাসনক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন, কালের পরিক্রমায় তারাই শাসক থেকে শোষকে রূপান্তরিত হলেন। হয়ে উঠলেন রক্ষক থেকে ভক্ষক। অথচ জনতার স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বাস্তবে তার সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হলো—যেখানে আদর্শ হার মানল লোভের কাছে, আর রাজনীতি পরিণত হলো স্বার্থ চরিতার্থ করার যন্ত্রে। ফলস্বরূপ, জনমনে জন্ম নিল নতুন অসন্তোষ।
এরপর এল ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান। ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ একত্র হয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রচনা করল এক নতুন ইতিহাস। সবাই ভেবেছিল, এবার হয়তো সত্যিকারের গণতন্ত্রের সূর্যোদয় হবে। কিন্তু না—ইতিহাস আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্ত করল। আন্দোলনের সুফল ভোগ করল রাজনীতির পুরোনো খেলোয়াড়েরা, আর যারা রাস্তায় রক্ত দিল, যাদের পরিবারের সদস্যরা জীবন বিপন্ন করল, তারাই রইল মঞ্চের বাইরে। শাসক বদলাল, কিন্তু চরিত্র বদলাল না। আবারও বিপ্লব বেহাত হলো।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানেও দৃশ্যপট প্রায় অভিন্ন। হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ আর অসংখ্য মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে উদিত হয়েছিল এক নতুন সূর্য। কিন্তু বছর না ঘুরতেই দেখা গেল সেই পুরোনো পরিচিত চিত্র—চাঁদাবাজি, বদলি বাণিজ্য, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনে বিপ্লবের চেতনা ক্ষয় হতে শুরু করল। সংস্কার নিয়ে ঐকমত্যে বিরোধ, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে তর্ক—সব মিলিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা আজ প্রায় বিপর্যস্ত। যাদের আত্মত্যাগে এই আন্দোলন সফল হয়েছিল, তাদের প্রতি দেখা যাচ্ছে অবহেলা। অন্যদিকে পরাজিত শক্তিও আবার মাথা তুলছে—নাশকতা, ককটেল বিস্ফোরণ, রাজনৈতিক সহিংসতা—সবকিছু যেন ফিরে এসেছে পুরোনো চিত্রে।
সব মিলিয়ে আজকের বাংলাদেশ যেন তাসের ঘরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক বেহাত বিপ্লবের নাম। দুই দিন পর হয়তো নির্বাচন হবে, সরকার গঠিত হবে, কিন্তু তারপর? হয়তো দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নেই ব্যস্ত থাকবে রাজনৈতিক দলগুলো। জনগণকে তখন মনে পড়বে কেবল ভোটের দিনে, আর বাকিটা সময় তারা হয়ে থাকবে নিছক এক ‘সংখ্যা’।
ইতিহাস সাক্ষী—প্রয়োজনে যতবারই ক্রান্তিকাল এসেছে, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ জনতা রক্ত দিয়েছে। অথচ ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছেন রাজনীতিবিদেরা ও মুষ্টিমেয় এলিট শ্রেণি। বিপ্লবের চেতনা রাস্তায় জন্ম নেয়, কিন্তু ফল ভোগ করে চৌহদ্দিতে বন্দী কিছু সুযোগসন্ধানী। এই চক্র ভাঙতেই হবে—এবং ভাঙতেই হবে। তবে এর জন্য কেবল বিপ্লব বা সরকার পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন মানুষের মানসিকতার গভীর পরিবর্তন। বিপ্লবীদেরও বুঝতে হবে—অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা হস্তান্তরই চূড়ান্ত দায়িত্ব নয়; নিজেদের হাতে নিয়ে দায়িত্বশীলভাবে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করাও তাদের কর্তব্য। জনগণকে নিজেদের ক্ষমতা, অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে রাজনীতি-সচেতন, নেতৃত্ব নির্বাচনে সজাগ ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
তবেই হয়তো এই হতভাগ্য রাষ্ট্রের ভাগ্য আকাশে সুবাতাস বইবে; নয়তো এই অন্ধকার চক্র চলবে শেষনিশ্বাস পর্যন্ত।
সাব্বির রহমান
শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিজ্ঞান, ঢাকা কলেজ।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দুই মাস পর ভুটানের প্রথম চালানের পণ্য খালাস শুরু
দুই মাস আগে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে নামানো হয়েছিল ভুটানের ট্রানজিট পণ্যের প্রথম চালান। তবে সরকারি সংস্থাগুলোর এ–সংক্রান্ত অনুমোদন না পাওয়ায় এত দিন খালাস করা যায়নি। গত সপ্তাহে বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদনের পর গতকাল রোববার চালানটি খালাসের প্রক্রিয়া শুরু করে ভুটানের পণ্য খালাসের জন্য নিযুক্ত বাংলাদেশের প্রতিনিধি। আজ সোমবার চালানটি বন্দর থেকে খালাসের পর ভুটানের উদ্দেশে নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে সই হওয়া ‘অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্য মুভমেন্ট অব ট্রাফিক-ইন-ট্রানজিট’ চুক্তি ও প্রটোকলের আওতায় পরীক্ষামূলক চালানটি নেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২২ মার্চ এই চুক্তি ও প্রটোকল সই হয়েছিল। ভুটান স্থলবেষ্টিত হওয়ায় দেশটিতে কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। ফলে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের মাধ্যমে শুরু হওয়া পরীক্ষামূলক চালান পরিবহনে দেশটি সন্তুষ্ট হলে নিয়মিত পণ্য পরিবহন শুরু হতে পারে। তবে এটি নির্ভর করছে ভুটানের সিদ্ধান্তের ওপর।
থাইল্যান্ড থেকে আসা ভুটানের পরীক্ষামূলক চালানটিতে ৬ হাজার ৫৩০ কেজি পণ্য রয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে শ্যাম্পু, শুকনো পাম ফল, আইস টি, চকলেট ও জুস। চালানটির রপ্তানিকারক থাইল্যান্ডের অ্যাবিট ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড। চালানটি আমদানি করেছে ভুটানের এবিট ট্রেডিং।
পরীক্ষামূলক চালান খালাসে বিলম্বদুই দেশের মধ্যে চুক্তি ও প্রটোকল সই হয় ২০২৩ সালে। এক বছর পর ২০২৪ সালের এপ্রিলে ভুটানে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ–ভুটান বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের সভায় সুবিধাজনক সময়ে দুটি পরীক্ষামূলক চালান পরিবহনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী গত ৮ সেপ্টেম্বর থাইল্যান্ডের ল্যাম চ্যাবাং বন্দরে ভুটানের চালানের কনটেইনার জাহাজে বোঝাই করা হয়। ভুটান বিষয়টি বাংলাদেশকে অবহিত করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরে পাঠানো হয়। তার আগেই গত ২২ সেপ্টেম্বর ভুটানের চালানটি বাংলাদেশি পতাকাবাহী ‘এমভি এইচআর হিরা’ জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।
এরপর গত ১৭ নভেম্বর রাজস্ব বোর্ড ভুটানের প্রথম চালানের কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য অফিস আদেশ জারি করে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ট্রানজিট চালানে সড়কের টোল ও মাশুলের বিষয় জানিয়ে এনবিআরকে চিঠি দেয় গত ২০ নভেম্বর। এরপর ভুটানের পণ্য খালাসের জন্য নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এন এম ট্রেডিং করপোরেশন কাজ শুরু করে।
জানতে চাইলে এন এম ট্রেডিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল আলম খান গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়কের টোল ও মাশুল দিচ্ছি। আশা করি, সোমবার বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে পারব। এরপরই সড়কপথে কনটেইনারটি ভুটানে নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, গতকাল রোববার বিকেলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট যাবতীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর কয়েক ঘণ্টায় চালানটির শুল্কায়ন হয়েছে। এখন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বাকি প্রক্রিয়া শেষ করে চালানটি খালাস নিতে পারবে।
পরীক্ষামূলক চালান পরিবহনের নির্ধারিত ট্রানজিট পথ অনুযায়ী চালানটি নেওয়া হচ্ছে। এই পথ হলো থাইল্যান্ডের ল্যাম চাবাং বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সড়কপথে বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দরের মাধ্যমে শিলিগুড়ি হয়ে অর্থাৎ ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভুটানের ফুয়েন্টশোলিং স্থলবন্দর।
পরীক্ষামূলক চালান থেকে কত পাচ্ছে বাংলাদেশভুটানের পরীক্ষামূলক চালানে চট্টগ্রাম কাস্টমস, চট্টগ্রাম বন্দর এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ—এই তিন সংস্থা মাশুল আদায় করবে। চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল নির্ধারণ করা আছে। অন্য দুই সংস্থা পরীক্ষামূলক চালানটির জন্য মাশুল নির্ধারণ করেছে।
গত ১৭ নভেম্বর এনবিআরের আদেশে জানানো হয়, প্রতি চালানে ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি প্রতি টন ২০ টাকা, নিরাপত্তা চার্জ প্রতি টন ১০০ টাকা, এসকর্ট ফি প্রতি কনটেইনারে কিলোমিটারপ্রতি ৮৫ টাকা, প্রশাসনিক মাশুল প্রতি টন ১০০ টাকা এবং স্ক্যানিং ফি প্রতি কনটেইনারে ২৫৪ টাকা।
পরীক্ষামূলক চালানের জন্য সড়ক টোল ও মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর এনবিআরে পাঠানো সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের চিঠি অনুযায়ী, ট্রানজিট পথের (চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বুড়িমারী স্থলবন্দর) দৈর্ঘ্য ৬৮৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম পোর্ট অ্যাকসেস রোডে ১২ কিলোমিটারের টোল সড়ক রয়েছে, যার জন্য ৪৫ টাকা টোল দিতে হবে। এ ছাড়া মেঘনা, মেঘনা–গোমতী, যমুনা এবং তিস্তা ব্রিজের জন্য মোট টোল দিতে হবে ৪ হাজার ৮১৫ টাকা। আবার ট্রেইলারের মোট ওজন ধরে প্রতি টনে টোল ফ্রি সড়কের (৬৭২ কিলোমিটার) জন্য মাশুল দিতে হবে ১ হাজার ৪৬২ টাকা। এ হিসাবে সাড়ে ৬ টন পণ্যের জন্য ১০ হাজার ২৩৪ টাকা মাশুল দিতে হবে।
চাপ পড়বে না বন্দরেইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভুটানের বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল ১৮৯ কোটি ৫৮ লাখ মার্কিন ডলারের। দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্যের ৭৯ শতাংশ বা প্রায় ১৪৯ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া অন্য দেশের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য খুবই কম, ২০২৪ সালের হিসাবে যা ভুটানের মোট বাণিজ্যের ১৭ শতাংশ বা ৩২ কোটি ডলার। ট্রানজিট চালু হলে এসব পণ্যই নেওয়া হতে পারে বাংলাদেশ ও ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক পর্ষদ সদস্য মো. জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ভুটান বাংলাদেশের মাধ্যমে নিয়মিত ট্রানজিট পণ্য পরিবহন করলেও তা বন্দরের ওপর চাপ তৈরি করবে না। কারণ, দেশটি যে পরিমাণ পণ্য পরিবহন করবে, তা বন্দরের সক্ষমতার তুলনায় নগণ্য।