আগুন লাগা নিছক দুর্ঘটনা হলেও তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে যতটা জ্বালিয়ে দেয়, তার দাগ থাকে আরও বহুদিন।

সম্প্রতি রাজধানীর কড়াইল বস্তির ভয়াবহ আগুন শহরটিকে আবার স্মরণ করিয়ে দিল একটি পুরোনো সত্য। তা হলো মানুষ যত আধুনিক হোক, যত নগরায়ণই হোক, অসাবধানতার আগুন একবার ছড়িয়ে পড়লে সভ্যতার পর্দা মুহূর্তেই খুলে যায়।

হাজার হাজার মানুষের এই ঘনবসতিতে আগুন শুরু হয়েছিল একটি ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ থেকে। আর তার লেলিহান শিখা রাতারাতি পুরো এলাকা গিলে খেয়েছে।

ঢাকার বস্তিগুলো এমনিতেই ঝুঁকির ওপর দাঁড়ানো ছোট ঘরগুলোর ভেতর দাহ্য উপকরণ টিন–কাঠ–প্লাস্টিক –ফোম মিলে তৈরি হয় আগুন ছড়ানোর উপযুক্ত পরিবেশ।

সংকীর্ণ গলি, বিদ্যুতের জটলা পাকানো তার, বাতাসে শুকনা কাঠের গন্ধ সব মিলিয়ে একটি স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট বড় বিপর্যয় ঘটাতে। কড়াইলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি মানুষ দৌড়ে পালাতে পালাতে হারিয়েছে স্বপ্ন, হারিয়েছে শেষ অবলম্বন।

আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের সংকটে পড়তে হয়েছে। সংকীর্ণ গলি দিয়ে পানি আনার লাইন স্থাপন করতেও লেগেছে অনেক বেশি সময়। আর প্রতিটি মিনিটই তখন কারও ঘর, কারও জীবন, কারও স্মৃতিকে আগুনের কাছে সমর্পণ করে দিচ্ছে।

ধারণা করা হয় এই আগুনের সূচনা হয়েছিল গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে। রাজধানীতে দীর্ঘদিন ধরে চলা গ্যাস–সংকটের কারণে বস্তিবাসী বাধ্য হয় নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহার করতে, আর সেই সুযোগে অবৈধ সিলিন্ডার সিন্ডিকেটগুলো স্বল্পশিক্ষিত দরিদ্র মানুষের কাছে নিম্ন মানের সিলিন্ডার সরবরাহ করে।

কড়াইল বস্তির আগুন শুধু কয়েক শ ঘর পোড়ায়নি, এটি নগর-পরিকল্পনার ব্যর্থতা, নিরাপত্তাহীনতার নগ্ন সত্য এবং আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাবকেও সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। আগুনের উৎস রহস্য হতে পারে; কিন্তু এর শিক্ষাটি কখনোই রহস্য হয়ে থাকা উচিত নয়।

এসব সিলিন্ডার শুধু প্রাণঘাতীই নয়; বরং বস্তির মতো জনবহুল ও ঘিঞ্জি পরিবেশে তা হয়ে ওঠে জীবন্ত বিস্ফোরক। একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের চাপেই কয়েক শ ঘর মুহূর্তে আগুনে পুড়ে যেতে পারে। কড়াইলের আগুন সেই সম্ভাবনাকেই নির্মমভাবে বাস্তবে পরিণত করেছে।

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, কেন এমন এলাকাগুলো আজও এতটা অপরিকল্পিত রয়ে গেল? কেন হাজারখানেক মানুষের জীবন ভর করে থাকে কিছু জীর্ণ তার ও কিছু নিম্নমানের সিলিন্ডারের ওপর। কেন দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার পরও তারা গ্যাস পায় না। আর উৎসহীন নজরদারির ওপর কেন আগুন নেভানোর মৌলিক জ্ঞান থেকেও মানুষ বঞ্চিত থাকে।

এই পরিস্থিতির প্রতিকার শুরু করতে হলে প্রথমত ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো চিহ্নিত করে প্রযুক্তিগতভাবে সংস্কার করা অপরিহার্য। বস্তি এলাকাকে বৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগের আওতায় আনলে তারের জট, অতিরিক্ত লোড আর শর্টসার্কিটের মতো বিপদ অনেকটাই কমবে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিম্নমানের ও অবৈধ গ্যাস সিলিন্ডারের বাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারি সংস্থা, সিটি করপোরেশন ও তদন্ত দলকে যৌথভাবে এই এলাকায় সিলিন্ডারের মান পরীক্ষা, বিতরণব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ এবং অপরাধী সিন্ডিকেটগুলোকে আইনের আওতায় আনা এখন জরুরি।

এর পাশাপাশি বস্তি এলাকার সংকীর্ণ গলি পুনর্বিন্যাস করে জরুরি সড়ক তৈরি করাও অপরিহার্য; কারণ ফায়ার সার্ভিস যদি আগুনের কাছে পৌঁছাতেই না পারে, তবে আগুন নেভানো আর প্রতিরোধ দুটিই অর্থহীন হয়ে যায়।

কমিউনিটি-ভিত্তিক ফায়ার সেফটি প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত মহড়া বস্তিবাসীদের দক্ষ করে তুলতে পারে, যাতে ছোট আগুনকে বড় হতে না দেওয়ার সক্ষমতা তাদের মধে৵ গড়ে ওঠে; কিন্তু এসবের বাইরে আরও বড় একটি বিষয় আছে পুনর্বাসন। আগুন নিভলেও মানুষের জীবনে আগুনের ক্ষত বহুদিন জ্বলতে থাকে।

তাই প্রতিবার আগুন লাগার পর তাদের আবার সেই একই জায়গায় ফিরে যেতে দেওয়া মানে নতুন একটি আগুনের অপেক্ষা করা। দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পিত বহুতল আবাসনই একমাত্র স্থায়ী সমাধান যেখানে থাকবে নিরাপদ বিদ্যুৎ, নিয়মিত গ্যাস, অগ্নিনিরোধী নির্মাণসামগ্রী ও পানির উৎস।

কড়াইল বস্তির আগুন শুধু কয়েক শ ঘর পোড়ায়নি, এটি নগর-পরিকল্পনার ব্যর্থতা, নিরাপত্তাহীনতার নগ্ন সত্য এবং আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাবকেও সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। আগুনের উৎস রহস্য হতে পারে; কিন্তু এর শিক্ষাটি কখনোই রহস্য হয়ে থাকা উচিত নয়।

শহরকে নিরাপদ করার জন্য আমাদের সবারই উচিত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে অসাবধানতায় আগুন না লাগে, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখা।

ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ মিডিয়া কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম বিষয়ের শিক্ষার্থী

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র আগ ন বস ত র আগ ন র আগ ন শ আগ ন ন রহস য

এছাড়াও পড়ুন:

আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে আইটি ক্লাব চালু

শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিনির্ভর বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিতে সাভার ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আর্মি আইবিএ) আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে আইটি ক্লাব। গতকাল বুধবার আর্মি আইবিএ মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ফাওজিয়া তাসনিমকে সভাপতি করে আইটি ক্লাব চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। নবগঠিত আইটি ক্লাবের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফজাল হোসাইন। আজ বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে আর্মি আইবিএ আইটি ক্লাব।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও শিক্ষা: ভবিষ্যতের দিগন্ত’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে আর্মি আইবিএ আইটি ক্লাব চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রুহুল আমিন বলেন, ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল দক্ষতা অপরিহার্য। এ ধরনের উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে কাজ শেখার সুযোগ তৈরি করে দেবে।

আর্মি আইবিএ এর পরিচালক এবং আইটি ক্লাবের চিফ পেট্রন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন কানেক্টিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজী হাসান। তিনি শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংযোগ তৈরির পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং শিল্প-খাতের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, শিক্ষার্থীরা যদি আইসিটি দক্ষতা, উদ্ভাবনী মানসিকতা ও ডিজিটাল সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন, তবে তারা ভবিষ্যতে শুধু ভালো চাকরি নয়- বরং উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা ও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। আইটি ক্লাবের কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা, সমস্যা সমাধান, নেতৃত্ব বিকাশ এবং ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করেন তারা।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইন্টারনেট সোসাইটি বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সহসভাপতি মোহাম্মদ কাওছার উদ্দীন। গেস্ট অব অনার হিসাবে বক্তব্য দেন বেসিস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (বিআইটিএম) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. মোফাজ্জল হোসেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ