নাটক ভারতীয় সাহিত্যের ঐতিহ্য হলেও আধুনিক বাংলা নাটকের উদ্ভব ইউরোপ থেকে। এ ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরীর যখন আবির্ভাব ঘটে, বাংলা নাটকের শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে এবং তা পুষ্ট ও পরিণত ধারা হয়ে উঠেছে। মুনীর চৌধুরী নিজেও মনে করতেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ উনিশ শতকের বাংলা নাটক, আর একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বিশ শতকে নাটকের উল্লেখযোগ্য নিরীক্ষা কেউ করেননি; অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া উনিশ ও বিশ শতকে পার্থক্যও বিশেষ নেই। আর তত দিনে বাংলা নাটক বিষয়, প্রকরণ ও মঞ্চায়নের দিক থেকেও ক্লিশে হয়ে উঠেছিল। কেননা, তখনকার নাটক পেশাদার রঙ্গমঞ্চের স্থূল আবেদনে অর্থহীন, অশ্লীল ও উদ্ভট হয়ে উঠেছিল; এ ছাড়া তাতে জীবনের কোনো সত্যতা ও গভীরতা ছিল না। অবশ্য এর বিপরীতে জীবন ও সমাজঘনিষ্ঠ নাটকের আরেকটা ক্ষীণ ধারা বহমান ছিল। তবে তা–ও প্রকরণগত দিক থেকে ছিল অনুকরণমূলক ও অনেকটা অস্বাভাবিক। এসব নাটকে কাহিনি ও প্লটের সরলতা জীবনের বিচিত্র রহস্যকে প্রকাশের পক্ষে বাধা হিসেবে কাজ করত। চরিত্রায়ণও ছিল একমাত্রিক, অগভীর ও গতানুগতিক। গভীরতর জীবনবোধেরও ছিল তাতে বড় অভাব। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুনীর চৌধুরী চেয়েছিলেন বাংলা নাটকের পুনর্জাগরণ এবং নতুন শিল্পরীতিতে নবজীবনের উদ্বোধন। তাঁর নাট্যচেতনার মূলে ছিল কমিউনিস্ট আদর্শ, শ্রেণিসংগ্রাম ও মানবমুক্তির আকাঙ্ক্ষা। একই সঙ্গে ঐতিহ্যের মূলধারার সঙ্গে পরিবর্তনশীল জীবন ও পরিবেশের শিল্পসম্মত মিলন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন বাঙালির বিপুল বিচিত্র ঐতিহ্যের সঙ্গে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিজীবনে রয়েছে নানা ঘটনার দ্বান্দ্বিকতা এবং স্বপ্নময় অফুরন্ত জীবনতৃষ্ণা। সুতরাং এসব নাটকীয় উপাদান নাট্যরচনায় ব্যবহার করে বাংলা নাটককে যুগোপযোগী শিল্পমাধ্যমে পরিণত করা সম্ভব।

মুনীর চৌধুরীর নাট্যচিন্তায় এমন দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল ইউরোপীয় নবনাট্যের ধারা। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইউরোপজুড়ে নতুন ঘরানার নাটকের প্রচণ্ড দাপট চলছিল। এই সময়ে জীবনপ্রণালি ও জীবনচিন্তা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ নাট্যশিল্পে নিজেদের উপযুক্ত আঙ্গিক গ্রহণ করে। এটি ছিল মূলত একটি সাহিত্যিক ও শৈল্পিক আন্দোলন; এতে বিষয়বস্তু, দৃষ্টিভঙ্গিসহ পুরাতন নাট্যরীতি বর্জন করে নতুন রীতির নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন হতে থাকে। ইউরোপের নাটকের ধরনও ছিল এমন যে পুরাতনকে অভিঘাত করে নতুনের আবাহন। এই নবনাট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বাস্তববাদ ও প্রকৃতিবাদ, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিষয় নির্বাচন, যৌক্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের সংশ্লেষ এবং নতুন কলাকৌশল।

ইউরোপীয় নবনাট্যের পেছনে অর্থনৈতিক, সমাজ-রাজনৈতিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও দার্শনিক নানা কারণ বিদ্যমান ছিল। বিশেষ করে শিল্পবিপ্লব, নগরায়ণ, শ্রমিক অধিকার, নারী-স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, মার্ক্সবাদ, ডারউইনবাদ, ফ্রয়েডবাদ, ধর্মনৈতিকতা বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধতা, বাস্তবতার বহুস্তরবাদ, নিরাশাবাদ, অস্তিত্ববাদ প্রভৃতি নাট্যকারদের দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্মাণরীতিকে পাল্টে দেয়। এই প্রক্রিয়ার প্রথম দিকে নরওয়েতে হেনরিখ ইবসেন, রাশিয়ায় আন্তন চেখভ, ব্রিটেনে জর্জ বার্নাড শ, সুইডেনে অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ প্রমুখ নাট্যকারের আবির্ভাব ঘটে। বলতে গেলে এঁদের হাত ধরে ইউরোপীয় আধুনিক থিয়েটারের ভিত্তি স্থাপিত হয়। পরে এ ধারাটি আরও শক্তিশালী ও বিচিত্রিমুখীন হয়ে ওঠে। ফরাসি প্রতীকবাদ ও অভিব্যক্তিবাদী শিল্প-আন্দোলন প্রভৃতি হয়ে নাট্যধারাটি পরিণতি পায় এপিক ও অ্যাবসার্ড থিয়েটারে। এমন নাট্যরীতির উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে দর্শকের সংযোগ সৃষ্টি করা; অর্থাৎ দর্শকের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক উদ্দীপনা সৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে বেলজিয়ামে মরিস মেটারলিঙ্ক, জার্মানিতে জর্জ কাইসের ও বার্টল্ড ব্রেখট, ফ্রান্সে জ্যঁ আনুই, ইতালিতে লুইজি পিরান্ডেলো, আয়ারল্যান্ডে স্যামুয়েল বেকেট, রোমানিয়ায় ইউজিন লোনেস্কো, ফ্রান্সে জ্যঁ পল সার্ত্র ও আলবেয়ার কামু প্রমুখ বিশেষ অবদান রাখেন।

মুনীর চৌধুরীর নাট্যচিন্তায় এমন দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল ইউরোপীয় নবনাট্যের ধারা। এই নবনাট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বাস্তববাদ ও প্রকৃতিবাদ, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিষয় নির্বাচন, যৌক্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের সংশ্লেষ এবং নতুন কলাকৌশল।

প্রায় শত বছরজুড়ে এঁরা সবাই মিলে নাট্যরীতি, মঞ্চ ও অভিনয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন ও রূপান্তর আনেন। নাট্যরীতিতে প্রচলিত পাঁচ অঙ্কের কাঠামো ভেঙে টুকরো টুকরো দৃশ্য পরিকল্পনা, লিনিয়ার কাহিনি ত্যাগ, অ-নায়ক চরিত্রের সৃষ্টি এবং বহুনির্দেশী সমাপ্তি যোজনা করে পূর্বের ঐতিহ্যকেই প্রত্যাখ্যান করলেন। মঞ্চায়নে প্রতীকী আলো ও আঁধার, চিত্রকল্পকেন্দ্রিক কৌশলসহ প্রপসকে কম গুরুত্ব দিয়ে নান্দনিকতাকে প্রাধান্য দিলেন। আর অভিনয়রীতিতে ক্রমান্বয়ে যোজিত করলেন স্ট্যানিস্লাভ্স্কির বাস্তববাদী অভিনয়-পদ্ধতি, মেয়েরহোল্ডের বায়োমেকানিকস এবং ব্রেখটের বিচ্ছিন্নতা অভিনয়-পদ্ধতি। ইউরোপের যুগোপযোগী এই নাট্যান্দোলন দ্রুতগতিতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, ঔপনিবেশিত বাংলায়ও তার ব্যতিক্রম ছিল না।

শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (২৭ নভেম্বর ১৯২৫—১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১).

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউর প য় নবন ট য নবন ট য র র জন ত ক র ন টক ন টক র শ শতক

এছাড়াও পড়ুন:

খুলনায় বিএনপির ৯ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

খুলনা বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নয় নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। 

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের এ সকল নেতাকে আগেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

আরো পড়ুন:

ময়মনসিংহে পুলিশ বক্সের সামনে যুবদলকর্মীকে হত্যা

ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না: আমান উল্লাহ

বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হওয়া নেতারা হলেন, খুলনা মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি শেখ ইকবাল হোসেন, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মহাবুব কায়সার, সদর থানা বিএনপির সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মাজেদা খাতুন, মহানগর ছাত্রদলের সাবেক দপ্তর সম্পাদক শেখ মুসফিকুর হাসান অভি, ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান হোসেন এবং সুন্দরবন আদর্শ কলেজ ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সালাউদ্দিন নান্নু।

এ ছাড়া খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার চালনা পৌর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মোজাফ্ফর হোসেন শেখ, বটিয়াঘাটা উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক খায়রুল ইসলাম খান জনি এবং কয়রা উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আব্দুর রশিদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

তবে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত অপর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ২৬ নভেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে ভুলবশত মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুব হাসান পিয়ারুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়, যা স্থগিত করা হলো।
 

ঢাকা/নুরুজ্জামান/বকুল 

সম্পর্কিত নিবন্ধ