আরব আমিরাতে হওয়ার ঘোষণা দিয়েও পিএসএল স্থগিত
Published: 9th, May 2025 GMT
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভারতের আক্রমণাত্মক মনোভাবকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল)–এর দশম আসরের বাকি ম্যাচগুলো স্থগিত করেছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। বৃহস্পতিবার (৮ মে) এক আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় এ সিদ্ধান্ত জানায় পিসিবি।
বোর্ড জানায়, প্রধানমন্ত্রী মিয়াঁ মোহাম্মদ শেহবাজ শরিফের সরাসরি পরামর্শেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি মনে করছেন, ভারতের বেপরোয়া আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে এখন দেশের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সেনাবাহিনীর সাহসিকতাকে সম্মান জানানো এবং জাতীয় সংহতি বজায় রাখা।
এক বিবৃতিতে পিসিবি জানায়, ‘‘পিএসএলের চলতি আসরের বাকি থাকা আটটি ম্যাচ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের পরামর্শ অনুসারে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যিনি মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের মনোযোগ ও আবেগ থাকা উচিত আমাদের সেনাবাহিনীর সাহসিকতায়, যারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপসহীনভাবে লড়াই করছে।’’
আরো পড়ুন:
স্থগিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ভারতের বাংলাদেশ সফর ও এশিয়া কাপ
দিল্লি স্টেডিয়াম উড়িয়ে দেওয়ার হুমকিতে তোলপাড়
পিসিবি আরও জানায়, টুর্নামেন্টের সফল আয়োজন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন অংশীজনদের অবদান ছিল প্রশংসনীয়। তবে দেশ যখন সংকটের মুখোমুখি, তখন ক্রিকেটকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বিরতি দেওয়া প্রয়োজন।
‘‘ক্রিকেট আনন্দ ও ঐক্যের প্রতীক হলেও, দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে খেলা কিছু সময়ের জন্য স্থগিত থাকাই যৌক্তিক। আমরা অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের মানসিক সুস্থতা ও বিদেশি খেলোয়াড়দের পরিবারের উদ্বেগকেও গুরুত্ব দিচ্ছি।’’ — বলেন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
পিএসএলের এবারের আসর যখন শেষ ধাপে পৌঁছেছিল, তখনই আসে এ সিদ্ধান্ত। এরই মধ্যে ২৭টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে, বাকি ছিল মাত্র ৮টি ম্যাচ।
পয়েন্ট টেবিলের বর্তমান চিত্র:
কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটরস: ৯ ম্যাচে ৬ জয়, ২ হার, ১ পরিত্যক্তে ১৩ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে।
করাচি কিংস: ৮ ম্যাচে ৫ জয় ও ৩ হারে ১০ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে।
ইসলামাবাদ ইউনাইটেড: ৯ ম্যাচে ৫ জয়, ৪ হারে সমান ১০ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয়।
লাহোর কালান্দার্স: ৪ জয়, ৪ হার ও ১ পরিত্যক্তে ৯ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ।
পেশাওয়ার জালমি: ৯ ম্যাচে ৪ জয়ে ৮ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম।
মুলতান সুলতানস: ৯ ম্যাচে মাত্র ১ জয় পেয়ে প্লে’অফের আগেই বিদায় নিয়েছে।
যেসব ম্যাচ স্থগিত হলো:
> করাচি কিংস বনাম পেশাওয়ার জালমি,
> পেশাওয়ার জালমি বনাম লাহোর কালান্দার্স,
> ইসলামাবাদ ইউনাইটেড বনাম করাচি কিংস,
> মুলতান সুলতানস বনাম কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটরস,
> কোয়ালিফায়ার,
> এলিমিনেটর ১,
> এলিমিনেটর ২,
> ফাইনাল।
ঢাকা/আমিনুল
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়াতে পারে
মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। ইরানের হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র, অর্থাৎ হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দিয়েছে দেশটি। সে কারণে গতকাল সোমবার বিশ্বের সব গণমাধ্যমেই এই হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রভাব নিয়ে সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে।
ইসরায়েল–ইরান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ইরানের সংসদে ইতিমধ্যে হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দেশটির নিরাপত্তা কাউন্সিলের। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান হরমুজ প্রণালি অবরোধ করলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম অনেকটাই বেড়ে যাবে। এই সংঘাত শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অন্যতম মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রতিদিনই কিছু কিছু না বাড়ছে। খবর বিবিসি, আল–জাজিরা, রয়টার্সের।
বৈশ্বিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি হরমুল প্রণালি দিয়ে তেল সরবরাহ এক মাসের জন্য অর্ধেকে নেমে আসে এবং পরবর্তী ১১ মাসে তা ১০ শতাংশ কমে যায়, তাহলে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম অস্থায়ীভাবে ব্যারেলপ্রতি প্রায় ১১০ মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে। নানা ধরনের হিসাব কষে দেখিয়েছে গোল্ডম্যান স্যাকস। তার মধ্যে আরেকটি হিসাব হলো, ইরানের তেল সরবরাহ দৈনিক সাড়ে ১৭ লাখ ব্যারেল কমে গেলে ব্রেন্টের ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি সর্বোচ্চ ৯০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। তবে ২০২৬ সালের মধ্যে সরবরাহ স্থিতিশীল হলে তা ৬০-৭০ ডলারের মধ্যে নেমে আসবে।
অন্যদিকে আরেক বিনিয়োগ ব্যাংক জে পি মরগ্যানের বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন, অতীতে মধ্যপ্রাচ্যে সরকার পরিবর্তনের পর তেলের দাম হঠাৎ করে ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে—দীর্ঘ মেয়াদে বেড়েছে গড়ে ৩০ শতাংশ। উল্লেখ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে ইরানে সরকার পরিবর্তনের কথা বলেছেন।
এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে বলে শঙ্কা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা ব্লুমবার্গ টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জ্বালানি তেলের বাজার কোথায় যায়, সেদিকে নিবিড় দৃষ্টি রাখা হয়েছে। তেলের দাম বাড়লে বিশ্ব অর্থনীতির সবখানে তার প্রভাব অনুভূত হবে। ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ফলে শুধু তাৎক্ষণিক নয়, পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। তেলের দাম বাড়লে তা বড় বড় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির রাশ টেনে ধরতে পারে। তখন ভোক্তা ব্যয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ কমতে পারে, এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস করতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) অনুমান, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রতিদিন হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য যেসব দেশ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা হলে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে।
শেয়ার ফিউচার্সের পতন
বৈশ্বিক গণমাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার প্রভাব শেয়ারবাজারেও পড়েছে। গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচার্স শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে; নাসডাক ফিউচার্স কমেছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শেয়ারবাজারগুলোর সূচক নিয়ে (জাপান বাদে) মর্গান স্টানলির তৈরি এমএসসিআই সূচক শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পড়ে গেছে আর জাপানের নিক্কি সূচক কমেছে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।
ইউরোপের বাজারেও পতনের ধারা দেখা গেছে। ইউরোস্টকস ৫০ ফিউচার সূচক শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, এফটিএসই ফিউচার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ও ডিএএক্স ফিউচার সূচক শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে।
মুদ্রাবাজারের অবস্থা
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সাধারণত সোনা ও ডলারের মান বাড়ে। তবে এবার এখন পর্যন্ত সেই প্রবণতা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। জাপানি ইয়েনের বিপরীতে ডলারের মান বেড়েছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে প্রতি ডলারে পাওয়া যাচ্ছে ১৪৬ দশমিক ৪৮ ইয়েন। অন্যদিকে ইউরোর বিপরীতে ডলারের মান শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে প্রতি ইউরোতে পাওয়া যাচ্ছে ১ দশমিক ১৪৮১ ডলার।
বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম হলো যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড। কিন্তু গতকাল এই বন্ডের বিষয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি দেখা যায়নি, বরং ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ২ ভিত্তি পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪০ শতাংশে।
ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার নিয়ে আগাম অনুমানের বাজারে (ফিউচার্স) সামান্য পতন দেখা গেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, তেলের দাম দীর্ঘ মেয়াদে বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতিতে আরও চাপ তৈরি হবে—এ আশঙ্কা থেকেই এই প্রতিক্রিয়া।
ইরান কি হরমুজ বন্ধ করতে পারবে
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হরমুজ যে কেবল ইরানের জন্য ভৌগোলিক সুবিধা, তা নয়; বরং এটি তাদের কৌশলগত অস্ত্র। ইরানের উপকূলঘেঁষা এই চ্যানেলের মাধ্যমে জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ পারস্য উপসাগর ও আরব সাগর সংযুক্ত হয়েছে। শুধু ইরান নয়, পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন ও ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানির প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে এ সমুদ্রপথের ওপর।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) প্রতিবেদন অনুসারে, হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়, যা তেলের বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ২১ শতাংশ।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) বলছে, হরমুজ প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত জ্বালানি তেলের প্রায় ৭০ শতাংশেরই ভোক্তা দক্ষিণ এশিয়া। এর মধ্যে রয়েছে চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপাইন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাও সরাসরি মধ্যপ্রাচ্য থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। ফলে হরমুজ প্রণালিতে যেকোনো ব্যত্যয়ের প্রতিক্রিয়া এসব দেশের জ্বালানি তেলের বাজারেও পড়বে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সভার্সাল কনসালটিংয়ের প্রেসিডেন্ট এলেন ওয়াল্ড সিএনবিসিকে বলেন, হরমুজ প্রণালিতে তেলপ্রবাহের গতি থামিয়ে প্রকৃতপক্ষে ইরানের ‘লাভ নেই’। বিশেষ করে যখন ইরানের নিজস্ব তেল স্থাপনাগুলোতে এখনো সরাসরি হামলা হয়নি। তিনি আরও বলেন, এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে ইরানকে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হতে পারে।
এ ছাড়া হরমুজ প্রণালির বেশিরভাগ অংশই ওমানের সীমানার মধ্যে, ইরানের মধ্যে নয়। এই প্রণালি এতটাই চওড়া যে ইরান চাইলেও তা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে না বলে মনে করেন বিশ্লোষকেরা। অনেক জাহাজ ইরানের জলসীমা দিয়ে গেলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের অংশ দিয়েও চলাচল সম্ভব। সে কারণে এই প্রণালী বন্ধ করার হুমকি রাজনৈতিক বক্তৃতার বেশি কিছু নয়।
এলেন ওয়াল্ড আরও সতর্ক করে বলেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাবে—তখন ইরানের সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা চীনও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাবে। এই বাস্তবতা বুঝে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে চীনের দূতিয়ালি চেয়েছে, তারা যেন ইরানকে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে বারণ করে। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। ইরানের হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র, অর্থাৎ হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দিয়েছে দেশটি। সে কারণে গতকাল সোমবার বিশ্বের সব গণমাধ্যমেই এই হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রভাব নিয়ে সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে।
ইসরায়েল–ইরান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ইরানের সংসদে ইতিমধ্যে হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দেশটির নিরাপত্তা কাউন্সিলের। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান হরমুজ প্রণালি অবরোধ করলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম অনেকটাই বেড়ে যাবে। এই সংঘাত শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অন্যতম মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রতিদিনই কিছু কিছু না বাড়ছে। খবর বিবিসি, আল–জাজিরা, রয়টার্সের।
বৈশ্বিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি হরমুল প্রণালি দিয়ে তেল সরবরাহ এক মাসের জন্য অর্ধেকে নেমে আসে এবং পরবর্তী ১১ মাসে তা ১০ শতাংশ কমে যায়, তাহলে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম অস্থায়ীভাবে ব্যারেলপ্রতি প্রায় ১১০ মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে। নানা ধরনের হিসাব কষে দেখিয়েছে গোল্ডম্যান স্যাকস। তার মধ্যে আরেকটি হিসাব হলো, ইরানের তেল সরবরাহ দৈনিক সাড়ে ১৭ লাখ ব্যারেল কমে গেলে ব্রেন্টের ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি সর্বোচ্চ ৯০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। তবে ২০২৬ সালের মধ্যে সরবরাহ স্থিতিশীল হলে তা ৬০-৭০ ডলারের মধ্যে নেমে আসবে।
অন্যদিকে আরেক বিনিয়োগ ব্যাংক জে পি মরগ্যানের বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন, অতীতে মধ্যপ্রাচ্যে সরকার পরিবর্তনের পর তেলের দাম হঠাৎ করে ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে—দীর্ঘ মেয়াদে বেড়েছে গড়ে ৩০ শতাংশ। উল্লেখ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে ইরানে সরকার পরিবর্তনের কথা বলেছেন।
এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে বলে শঙ্কা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা ব্লুমবার্গ টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জ্বালানি তেলের বাজার কোথায় যায়, সেদিকে নিবিড় দৃষ্টি রাখা হয়েছে। তেলের দাম বাড়লে বিশ্ব অর্থনীতির সবখানে তার প্রভাব অনুভূত হবে। ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ফলে শুধু তাৎক্ষণিক নয়, পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। তেলের দাম বাড়লে তা বড় বড় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির রাশ টেনে ধরতে পারে। তখন ভোক্তা ব্যয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ কমতে পারে, এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস করতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) অনুমান, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রতিদিন হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য যেসব দেশ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা হলে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে।
শেয়ার ফিউচার্সের পতন
বৈশ্বিক গণমাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার প্রভাব শেয়ারবাজারেও পড়েছে। গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচার্স শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে; নাসডাক ফিউচার্স কমেছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শেয়ারবাজারগুলোর সূচক নিয়ে (জাপান বাদে) মর্গান স্টানলির তৈরি এমএসসিআই সূচক শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পড়ে গেছে আর জাপানের নিক্কি সূচক কমেছে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।
ইউরোপের বাজারেও পতনের ধারা দেখা গেছে। ইউরোস্টকস ৫০ ফিউচার সূচক শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, এফটিএসই ফিউচার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ও ডিএএক্স ফিউচার সূচক শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে।
মুদ্রাবাজারের অবস্থা
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সাধারণত সোনা ও ডলারের মান বাড়ে। তবে এবার এখন পর্যন্ত সেই প্রবণতা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। জাপানি ইয়েনের বিপরীতে ডলারের মান বেড়েছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে প্রতি ডলারে পাওয়া যাচ্ছে ১৪৬ দশমিক ৪৮ ইয়েন। অন্যদিকে ইউরোর বিপরীতে ডলারের মান শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে প্রতি ইউরোতে পাওয়া যাচ্ছে ১ দশমিক ১৪৮১ ডলার।
বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম হলো যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড। কিন্তু গতকাল এই বন্ডের বিষয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি দেখা যায়নি, বরং ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ২ ভিত্তি পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪০ শতাংশে।
ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার নিয়ে আগাম অনুমানের বাজারে (ফিউচার্স) সামান্য পতন দেখা গেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, তেলের দাম দীর্ঘ মেয়াদে বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতিতে আরও চাপ তৈরি হবে—এ আশঙ্কা থেকেই এই প্রতিক্রিয়া।
ইরান কি হরমুজ বন্ধ করতে পারবে
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হরমুজ যে কেবল ইরানের জন্য ভৌগোলিক সুবিধা, তা নয়; বরং এটি তাদের কৌশলগত অস্ত্র। ইরানের উপকূলঘেঁষা এই চ্যানেলের মাধ্যমে জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ পারস্য উপসাগর ও আরব সাগর সংযুক্ত হয়েছে। শুধু ইরান নয়, পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন ও ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানির প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে এ সমুদ্রপথের ওপর।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) প্রতিবেদন অনুসারে, হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়, যা তেলের বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ২১ শতাংশ।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) বলছে, হরমুজ প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত জ্বালানি তেলের প্রায় ৭০ শতাংশেরই ভোক্তা দক্ষিণ এশিয়া। এর মধ্যে রয়েছে চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপাইন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাও সরাসরি মধ্যপ্রাচ্য থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। ফলে হরমুজ প্রণালিতে যেকোনো ব্যত্যয়ের প্রতিক্রিয়া এসব দেশের জ্বালানি তেলের বাজারেও পড়বে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সভার্সাল কনসালটিংয়ের প্রেসিডেন্ট এলেন ওয়াল্ড সিএনবিসিকে বলেন, হরমুজ প্রণালিতে তেলপ্রবাহের গতি থামিয়ে প্রকৃতপক্ষে ইরানের ‘লাভ নেই’। বিশেষ করে যখন ইরানের নিজস্ব তেল স্থাপনাগুলোতে এখনো সরাসরি হামলা হয়নি। তিনি আরও বলেন, এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে ইরানকে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হতে পারে।
এ ছাড়া হরমুজ প্রণালির বেশিরভাগ অংশই ওমানের সীমানার মধ্যে, ইরানের মধ্যে নয়। এই প্রণালি এতটাই চওড়া যে ইরান চাইলেও তা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে না বলে মনে করেন বিশ্লোষকেরা। অনেক জাহাজ ইরানের জলসীমা দিয়ে গেলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের অংশ দিয়েও চলাচল সম্ভব। সে কারণে এই প্রণালী বন্ধ করার হুমকি রাজনৈতিক বক্তৃতার বেশি কিছু নয়।
এলেন ওয়াল্ড আরও সতর্ক করে বলেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাবে—তখন ইরানের সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা চীনও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাবে। এই বাস্তবতা বুঝে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে চীনের দূতিয়ালি চেয়েছে, তারা যেন ইরানকে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে বারণ করে।