স্বাস্থ্য খাতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর। সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণা অনুসারে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ২২.৮ শতাংশই পথচারী এবং ৪.২ শতাংশ সাইকেল আরোহী। গড়ে তারা যথাক্রমে ১১ ও ৯ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন এবং প্রতি রোগীর জন্য চিকিৎসা ব্যয় হয় গড়ে ২৭ হাজার ৫৩২ টাকা ও ১৮ হাজার ৯৫২ টাকা।

বুধবার (২৮ মে) রাজধানীর বিআরটিএ সদর দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে ‌‘জাতিসংঘ গ্লোবাল রোড সেফটি সপ্তাহ ২০২৫’ উপলক্ষে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় মতবিনিময় সভাটির আয়োজন করে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘পথচারী ও সাইকেল আরোহীদের জন্য নিরাপদ সড়ক’।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো.

ইয়াসীন। স্বাগত বক্তব্য দেন বিআরটিএ’র রোড সেফটি উইং-এর পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন পরিচালিত রোড সেফটি অ্যান্ড ইনজুরি প্রিভেনশন প্রোগ্রামের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ওয়ালী নোমান।

প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বব্যাপী রোডক্র্যাশ মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখ মানুষ সড়কে প্রাণ হারান এবং প্রায় ৫ কোটি মানুষ আহত হন। ৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মৃত্যুর প্রধান কারণও এটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে পথচারী মৃত্যুর হার বেড়েছে ৩ শতাংশ এবং সাইকেল আরোহীদের ক্ষেত্রে এ হার বেড়েছে ২০ শতাংশ। অথচ বিশ্বের ৮০ শতাংশ সড়কে পথচারীদের জন্য কোনো নিরাপদ অবকাঠামো নেই এবং মাত্র ০.২ শতাংশ রাস্তায় রয়েছে সাইকেল লেন।

এ পরিস্থিতিতে, জীবন বাঁচাতে ও সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’ একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইউরোপে এ পদ্ধতির বাস্তবায়নে মৃত্যুহার ৩৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সুইডেনে প্রতি লাখে মৃত্যুহার মাত্র ২.৮।

সভায় আলোচক হিসেবে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী বলেন, “শহরে দুর্ঘটনা কমাতে যানবাহনের গতিসীমা নির্ধারণ অত্যন্ত জরুরি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও যথাযথ আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।”

সভাপতির বক্তব্যে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন বলেন, “সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিআরটিএ ইতোমধ্যে ‘মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা ২০২৪’ জারি করেছে এবং সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন- গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর ড. মো. শরিফুল আলম, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী, হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি শরিফুল ইসলামসহ বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।

ঢাকা/হাসান/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব আরট এ পথচ র

এছাড়াও পড়ুন:

আইন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার

এটা অনস্বীকার্য যে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করা হয়, অন্যভাবে বললে মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই আইনই মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সহযোগী উপাদান বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষত আইন যখন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যাতে অতিবিস্তৃত, অস্পষ্ট এবং অসংগতিপূর্ণ ধারা থাকে কিংবা আইনের দুর্বল এবং ‘সিলেকটিভ’ প্রয়োগ হয়; আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা নির্বিচার আটকের ন্যায্যতা দেয়, মৌলিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং বৈষম্যমূলক চর্চাকে উৎসাহিত করে।

আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে সেসব দেশে, যেখানে আইনের শাসন ভঙ্গুর, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত এবং গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

২.

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন অধ্যায়, যেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটে। সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও তৎকালীন সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং সহিংস আক্রমণের ফলে পরবর্তীকালে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং একটি স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়।

জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংসতা, নির্বিচার আটক ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল।

আন্দোলন চলাকালীন হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে নির্বিচার আটক করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আটকের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) অনুসরণের যে বিধান, তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণগ্রেপ্তার অভিযানের সময় আটক হওয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী এবং সাধারণ নাগরিক আর ১৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। হত্যা, নির্বিচার আটক এবং নির্যাতনের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষের যোগাযোগের অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।

এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, আত্মরক্ষায় বলপ্রয়োগ কিংবা জনস্বার্থের মতো ‘অস্পষ্ট’ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এসব ক্ষেত্রে আইন সহযোগী উপাদান বা অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, কারফিউ জারি, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বা দেখামাত্রই গুলির নির্দেশকে ন্যায্যতা দিতে জননিরাপত্তা এবং জনস্বার্থের মতো বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত আইন রাষ্ট্রের দমনমূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে সহায়তা করেছে, যা মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

৩.

জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেই নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিগত সময়ে কিছু কঠোর ও দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই আইনগুলো ভিন্নমত দমন, নির্যাতন এবং নিপীড়ন করে কর্তৃতবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ছিল। বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল এমন একটি আইন (যা পূর্ববর্তী আইসিটি আইনের বিতর্কিত এবং দমনমূলক ৫৭ ধারার একটি পদচিহ্ন)। এ আইন বাংলাদেশে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার ভুক্তভোগী ছিলেন অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।

এই দমনমূলক ডিএসএ আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে আইনের অপব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না, বরং আইনটি ব্যবহার করেই অর্থাৎ আইনের মধ্যে থেকেই মানুষকে হয়রানি এবং নির্যাতন করা সম্ভব ছিল। ডিজিটাল আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ভীতি এবং সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি তৈরি করে ভিন্নমতকে দমন করা, যা সংবিধান প্রদত্ত বাক্‌স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। লক্ষণীয়, নিপীড়নমূলক ডিজিটাল আইন প্রণয়নে এবং প্রয়োগে বিগত সরকার ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যখন ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকারের ধারণা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে, বাংলাদেশে দমনমূলক ডিজিটাল আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করেছে।

বিগত সরকারের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে উঠেছিল ভিন্নমত দমনের বড় অস্ত্র

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আইন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার
  • এইচএসসি পরীক্ষা: ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্রে ভালো করতে হলে
  • জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করল সরকার