গভীর সংস্কার না করলে স্বৈরাচার আবার ফিরবে
Published: 29th, July 2025 GMT
মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘এটা উপরে একটা প্রলেপ দেওয়ার পরিবর্তন না, গভীরতমভাবে পরিবর্তন। সেই গভীরতম পরিবর্তন যদি না করি, যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আজকে আমরা কথা বলছি, আবার ঘুরে ফিরে সে চলে আসবে, যতই আমরা সামাল দেই, যতই সংস্কার করি। আমাদের আরও গভীর সংস্কার দরকার। এই সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান ও জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের ওপর জাতিসংঘের ঢাকা দপ্তর আয়োজিত জুলাই স্মরণ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা এ মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন, জুলাই আন্দোলনের শহীদ নাফিসের বাবা গোলাম রহমান এবং শহীদ সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তী। ধারনকৃত ভিডিওর মাধ্যমে বার্তা দেন জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সংস্কারের পাশাপাশি জুলাইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে আমরা বদ্ধপরিকর। ন্যায়বিচার মানে কেবল শাস্তি নয়। ন্যায়বিচার মানে এমন একটি রাষ্ট্র গঠন, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা আর কখনো জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দপ্তরকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে প্রায় ১,৪০০ মানুষের প্রাণহানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই সহিংসতা ছিল পরিকল্পিত, সংগঠিত এবং পূর্ববর্তী সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে পরিচালিত।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘জাতিসংঘের হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ, তারা শুধু এই নিপীড়নের প্রামাণ্য নথি প্রস্তুত করেনি, বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে, তার জন্য একটি বিস্তৃত সুপারিশমালাও দিয়েছে।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার মানবাধিকার সুরক্ষায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন দণ্ডবিধির সংশোধন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদে যোগদান এবং জাতিসংঘের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। এর আওতায় ঢাকায় একটি সহায়তাকারী মিশন গঠিত হচ্ছে, যা সরকার ও নাগরিক সমাজকে কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ও সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্নের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেস্টা বলেন, ‘আমরা এমন একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য কাজ করছি, যার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা।’
অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরাও চাই অতি দ্রুত এসব হত্যার বিচার হোক। জরুরি সংস্কারগুলো অতি দ্রুত হোক। তবে একটি জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন, জনগণের প্রতিনিধিত্বসম্পন্ন সরকার খুবই জরুরি। কারণ ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করা, আর ম্যান্ডেট ছাড়া কাজ করার মধ্যে অবশ্যই কিছু পার্থক্য আছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের ওপর আমি জোর দিতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে সমাধান করবে। বৈপ্লবিক কোনো ঘটনা ঘটবে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে সেই পরিবর্তনটা অবশ্যই আসবে।’ প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন আশা প্রকাশ করেন বিএনপির এই নেতা।
প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আসলে একটি বছর খুব বড় সময় নয়। এই সময়ে তাঁরা অনেকগুলো কাজ করেছেন, অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁরা যে বড় কাজটি এগিয়ে নিয়েছেন, তা হলো সংস্কারের কাজ।
জুলাই আন্দোলন ঘিরে আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আগে কোনো নির্বাচন হতে পারে না বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন একসঙ্গে চলতে হবে। বিচার ও সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে সেটা জাতির জন্য বিপর্যয় হবে।
শফিকুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিচার চাই, কিন্তু বিচারের নামে ওদের ওপর যেন অন্যায় না হয়। ওদের প্রাপ্য বিচার বুঝিয়ে দেওয়া হোক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেলে কেউই পার পাবেন না। যারা খুন করেছে, তারা যেন তাদের ন্যায্য শাস্তি পায় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেন দূর হয়।’
বিচার বিভাগ স্বাধীন করার বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের সুপারিশ সমর্থন করেন এনসিপির নেতা আখতার হোসেন। জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত যারা দেশে আছে তাদের খুঁজে বের করা এবং বিদেশে পালিয়ে থাকাদের দেশে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান তিনি।
জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ নাফিসের বাবা গোলাম রহমানের অভিযোগ, ছেলেকে হত্যাকারী পুলিশ সদস্য এখন কাজ করছেন কক্সবাজারে। দ্রুত তাঁকে বিচারের আওতায় এনে সুবিচার দাবি করেন তিনি।
জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের শেষ দেখতে চান শহীদ সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তী। তিনি জুলাই সনদ দ্রুত প্রকাশেরও আহ্বান জানান।
জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক অপারধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন ঢাকার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হুমা খান। সমাপনী অনুষ্ঠানের শুরুতে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতের অপর একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ম নব ধ ক র অন ষ ঠ ন ব যবস থ র আওত য় ক জ কর র জন য সরক র রহম ন ইসল ম ফখর ল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন
প্রথিতযশা অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সব্যসাচী মানুষ। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাঁর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের ধারণ করতে হবে।
জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা, বৃত্তি, পদক, পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট।
অনুষ্ঠানে ‘যুগলের বন্ধন: কাজী নজরুল ইসলাম-কাজী মোতাহার হোসেন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। তিনি দুই বন্ধুর সম্পর্কের রসায়নের নানা দিক তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই অনুষ্ঠানের দুটো প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, মানুষের অবদান ও মেধাকে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা সব্যসাচী মানুষের ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে।
কাজী মোতাহার হোসেন যেকোনো বিবেচনায় একজন দার্শনিক বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রথম সারির পরিসংখ্যানবিদ, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি অনেকগুলো সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। একজন মানুষের ছোট জীবদ্দশায় এত গুণ সন্নিবেশিত করা কঠিন। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।
সবাইকে নিয়ে চলা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, নিজের জগতের বাইরে নানা কিছুতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঐতিহ্য কাজী মোতাহার হোসেন করে গেছেন বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, তাঁর সম্মানে যাঁরা আজ স্বীকৃতি পেলেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সে বার্তা দেবেন। যেসব শিক্ষার্থী সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের ছোট প্রোফাইল তৈরি করে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মাজেদ বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। তিনি দাবা খুব পছন্দ করতেন। দাবা খেলার কথা শুনলে তিনি ছুটে যেতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তাঁর শোনা নানা গল্প তিনি স্মৃতিচারণা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাফর আহমেদ খান বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন। বিজ্ঞান, দাবাচর্চারও পথিকৃৎ ছিলেন। এমন কোনো পুরস্কার নেই যে, তিনি পাননি। তাঁর দেখানো পথে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলোকিত করতে পারেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। এই আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেরা শিক্ষার্থীদের বই, নগদ অর্থ ও সনদ তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।