জুন মাস বাজেট ও পরিবেশ সচেতনতার মাস। আমরা দেখেছি বাংলাদেশে বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়, অবকাঠামো নির্মাণ, প্রশাসনিক ব্যয় আর ঋণ শোধের দিকে নজর দিতে। বাদ পড়ে না প্রতিরক্ষা খাতও। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো নীতিগতভাবে উপেক্ষিত থাকে। অথচ পরিবেশ রক্ষায় বিনিয়োগ অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনাকেও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সংরক্ষণ-সংক্রান্ত এক চাঞ্চল্যকর ব্যয়ের হিসাব প্রকাশিত হয়েছে। জানা যায়, প্রায় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা দেড় লাখ ইভিএম মেশিন এখন ব্যবহার না হলেও সেগুলো সংরক্ষণে গুদাম ভাড়া বাবদ প্রতিবছর খরচ হচ্ছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
পরদিনই দৈনিক সমকালে বিশ্ব পরিবেশ দিবস নিয়ে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে একটি ইতিবাচক খবর বের হয়েছে: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় গত তিন বছরে তিন হাজার বর্জ্য সংগ্রাহক এবং ২০০ ভাঙারিওয়ালার মাধ্যমে প্রায় ২৪ হাজার ৫০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ কোটি ৬৮ লাখ কেজি ছিল একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক। এই প্লাস্টিক সংগ্রহে ব্যয় হয়েছে মোট ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছরে গড়ে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা।
প্রতিবেদন দুটির তুলনা করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমাদের সামনে দাঁড়ায়: বাজেটের অগ্রাধিকার কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? একদিকে ১৫ কোটি টাকা প্রতিবছর চলে যাচ্ছে এমন গুদামে, যেখানে অনাবশ্যক মেশিন পড়ে থাকে। অন্যদিকে ১ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগেই চট্টগ্রাম শহর কিছুটা মুক্তি পাচ্ছে বর্ষাকালের দুর্ভোগ থেকে। যেখানে আগে দু’দিন বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি জমত, এখন সেখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা অনেকটাই সচল। এটাই অগ্রাধিকারের হিসাব।
বাজেটের অগ্রাধিকার নির্ধারণে আমরা বছরের পর বছর ভুল করে আসছি। বিশেষত আমরা এখনও প্রকৃতি ও পরিবেশকে অপ্রয়োজনীয় খাত হিসেবে দেখি। আমরা মনে করি, প্রকৃতির সুরক্ষা এমন একটি কাজ, যা ‘দাতা সংস্থা করলে ভালো’; ‘অন্য কেউ ভাবুক’, কিংবা ‘দিবস এলে ভাবা যাবে’।
প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রভাব শুধু ড্রেন ব্লকেই সীমাবদ্ধ নয়। এগুলো নদী, জলাশয়, এমনকি সমুদ্রে গিয়ে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসব বর্জ্য দীর্ঘদিন মাটিতে থেকে মাটির গুণগত মান কমিয়ে দেয়। কৃষিকে ব্যাহত করে। শুধু শহরেই নয়, এখন গ্রামেও প্রতিনিয়ত দেখা যায় পলিথিন ভরা খালে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর পানি দূষিত হয়ে রোগের উৎসে পরিণত হচ্ছে। প্লাস্টিক শুধু বর্জ্য নয়; এটি নিঃশব্দ ঘাতক। বাচ্চাদের খেলার মাঠে প্লাস্টিকের টুকরো ধুলো হয়ে ফুসফুসে ঢোকে। মাছের পেটে গিয়ে আবার আমাদের পাতে ফিরে আসে।
বাংলাদেশে বছরে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় প্রায় ৮ লাখ টন। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে এর প্রায় ৪৮ শতাংশ, অর্থাৎ ৩.
সরকার চাইলে জলবায়ু খাত বা পরিবেশ সংরক্ষণ নামে আলাদা বাজেট বরাদ্দ দিতে পারে, যেখানে স্থানীয় সরকার বা পৌরসভাগুলোকে উৎসাহ দেওয়া হবে বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইক্লিং কার্যক্রম পরিচালনায়। এনজিও বা সামাজিক উদ্যোগগুলোকে সহায়তা দিয়ে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরের মতো ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্লাস্টিক ফেরত দিলে ‘পুরস্কার পাবে’– এমন কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে।
এখানে উদ্যোক্তা গড়ে তোলার সুযোগও থাকছে। প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং এখন সম্ভাবনাময় বাজার। পিইটি বোতল থেকে তৈরি ফ্লেক্স এখন চীন ও ইউরোপে রপ্তানি হয়। ঢাকার বাইরে পর্যটন কেন্দ্রগুলোসহ প্রতিটি জেলায় এমন সংগ্রহ কেন্দ্র তৈরি করে বেকার তরুণের কর্মসংস্থান সম্ভব। গ্রামগঞ্জে কিশোর-কিশোরী ক্লাবের মাধ্যমেও এই সচেতনতা তৈরি করা যায়।
পরিবেশ রক্ষার বিষয়কে নৈতিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে দেখতে হবে। এটা জন্মস্থানের প্রতি, বসবাসের জায়গার প্রতি ঋণ শোধের বিষয়। পরিবেশ রক্ষাকে ব্যয় নয়, বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। সেই বিবেচনায় পরিবেশ বাঁচাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। এই ব্যয় প্রতিরক্ষা খাতে রাইফেল, ক্ষেপণাস্ত্র কেনার মতো নয়। এটি আমাদের শ্বাস নেওয়ার জায়গা, খাওয়ার পানি, শিশুর ভবিষ্যৎ– এসব রক্ষার জন্য।
প্রতিটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের জন্য ‘পরিবেশ পুনর্ব্যবস্থাপনা তহবিল’ থাকা দরকার। যেখানে স্থানীয়ভাবে পিইটি বোতল, পলিথিন, ইলেকট্রনিক বর্জ্য, খাদ্য বর্জ্য সংগ্রহের জন্য কর্মসূচি চালানো যাবে।
বিদ্যমান বাস্তবতায় চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতা মডেল হতে পারে। যেখানে নগর কর্তৃপক্ষ, বেসরকারি খাত ও শ্রমজীবী মানুষ মিলে কাজ করবে সাশ্রয়ী উপায়ে পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে। এ ধরনের মডেল দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রয়োগ করা সম্ভব।
মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প ল স ট ক বর জ য বর জ য স গ র ব যবস থ আম দ র স রক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে শান্তির পথ হবে না: ট্রাম্প-পুতিনকে ইউরোপীয় নেতাদের সতর্কবার্তা
ট্রাম্প-পুতিন আগামী সপ্তাহের শীর্ষ বৈঠক নিয়ে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, সম্ভাব্য চুক্তিতে ইউক্রেনকে তার ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হতে পারে।
এ উদ্বেগ থেকে গতকাল শনিবার রাতে ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রতি রাশিয়ার ওপর চাপ আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ খুঁজে পেতে আগামী শুক্রবার আলাস্কায় বৈঠকে বসবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ওই বৈঠকে যোগ দিতে চাইছেন। ইউক্রেন ও ইউরোপের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, কিয়েভকে অবশ্যই আলোচনার অংশ করতে হবে।
গত শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের ঘোষণা দেওয়ার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘উভয় পক্ষের মঙ্গলের জন্য কিছু ভূখণ্ড অদলবদল করতে হবে।’ এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত আর কিছু বলেননি।
পরদিন গতকাল শনিবার জেলেনস্কি সতর্ক করে বলেন, শান্তি কেনার জন্য তাঁর দেশ রাশিয়াকে কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেবে না।
ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ বৈঠকের দিন ঘোষণার পর নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে গতকাল শনিবার যুক্তরাজ্যে বৈঠক করেন কিয়েভের মিত্রদেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের প্রতিনিধিরা।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জেলেনস্কি লেখেন, ‘ইউক্রেনীয়রা দখলদারের কাছে নিজেদের ভূমি দেবে না। আমাদের স্বার্থবিরোধী যেকোনো সিদ্ধান্ত, আর ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্ত হবে শান্তির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত।’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে ফোনালাপে জেলেনস্কি ইউক্রেনের মিত্রদের প্রতি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘স্পষ্ট পদক্ষেপ’ নেওয়ার আহ্বান জানান।
গতকাল রাতে এক যৌথ বিবৃতিতে ইউরোপীয় নেতারা বলেন, সক্রিয় কূটনীতি, ইউক্রেনকে সহায়তা ও রুশ ফেডারেশনের ওপর চাপ সৃষ্টি—এ তিনটিকে মিলিয়ে একটি যৌথ পদ্ধতিই শুধু রাশিয়ার অবৈধ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে সফল হতে পারে।
ইউরোপের নেতারা ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রেখে, পাশাপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপ ও তা বজায় রেখে তাঁরা ট্রাম্পকে যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিকভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত।
ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন এ যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি