জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার ঘিরে আন্দোলনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে শুধু পোশাক খাতেই দৈনিক ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে দ্রুত সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে শীর্ষস্থানীয় ১২টি ব্যবসায়ী সংগঠনের যৌথ জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান টি রহমান, সিরামিক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএর সভাপতি মঈনুল ইসলাম, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, এমসিসিআইর সহসভাপতি ও ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিসিসিআইর সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী (পারভেজ)। তিনি বলেন, এনবিআরের চেয়ারম্যানের অপসারণ কোনোমতেই কাম্য নয়। এতে কোনো সফলতা নিয়ে আসবে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন না। দেশ ও ব্যবসার স্বার্থে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আন্দোলনকারীসহ সব পক্ষের আলোচনায় বিদ্যমান সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
বিসিসিআই সভাপতি বলেন, রাজস্বনীতি ও বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে আলাদাকরণ-সংক্রান্ত বিতর্কিত অধ্যাদেশ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে করা হোক। এরপর তা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত রেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও দেশের বাস্তবতার আলোকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক উন্নয়নে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সব জাতীয় প্রতিষ্ঠানে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে দৈনিক ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে শুধু পোশাকশিল্পেই। শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা, তথা সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে এ মুহূর্তে এনবিআর ইস্যুর সমাধান প্রয়োজন। এটি আমাদের শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়।
চলমান অচলাবস্থার কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সরকার তার সঠিক গুরুত্ব বুঝছে না– এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা চাপে আছেন। নতুন করে এ আন্দোলনের কারণে ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এর থেকে ফিরে আসা উচিত। তাই মঙ্গলবার নয়, আজই (গতকাল) আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে এর সমাধান করতে হবে।
আন্দোলনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, কালক্ষেপণ না করে দ্রুত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নেতৃত্বে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটিকে (বিডা) যৌথভাবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা জরুরি। তারা বলেন, এনবিআরের সব কর্মকর্তাই অসৎ নন। তাদেরও ভবিষ্যৎ আছে। সেই বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থনীতি যাতে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেই পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। এ সময় তারা আন্দোলনকারীদের প্রতি দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ‘কলমবিরতি’ ও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কোনো শর্ত ছাড়া কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, যে কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের ইন্টারেকশন বা মিথস্ক্রিয়া অতি জরুরি। কিন্তু বর্তমান সরকারের সঙ্গে এই যোগাযোগ বা সংলাপ অনেকটা স্তিমিত। তিনি বলেন, চেয়ারম্যানের অপসারণ কাম্য নয়। কারণ, এরপর হয়তো অন্য কোনো সদস্যের অপসারণের দাবিও উঠবে। তাতে সমস্যা বাড়তে থাকবে।
শাটডাউনের কারণে রপ্তানির ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করে এলএফএমইএবি সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। যুদ্ধ ছাড়া কোনো দেশের কাস্টমস বন্ধ থাকে কিনা, সেটি জানা নেই। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা এনবিআরের সংস্কার চান। তবে এনবিআরে অনেক সৎ কর্মকর্তা আছেন। সংস্কারের ফলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি বলার অধিকার তাদের আছে। সেটিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘যারা ব্যবসা করেন, তাদের সব সময়ই এনবিআর বলেন, কাস্টমস বলেন, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যবসা পরিচালনা করার চেষ্টা করতে হয়। কারণ, বাস্তবতা হলো ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে জিম্মি। এখন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও টাকা-পয়সার বণ্টন নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। মাঝপথে ব্যবসায়ীরা বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা (এনবিআরের কর্মকর্তারা) সারাজীবন ব্যবসায়ীদের জ্বালাইছে, এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে, এখন পুরো জাতিকে জ্বালাচ্ছে।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র ব যবস য় র কর মকর ত স গঠন সরক র রহম ন
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রম আইন সংস্কারে তাগিদ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের
বাংলাদেশের শ্রম আইন সংস্কারে তাগিদ দিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের সঙ্গে বৈঠকে দূতাবাসের একটি প্রতিনিধিদল বলেছে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) সবার চাওয়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশের শ্রম আইন সংস্কার করা হবে।
রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএর কার্যালয়ে আজ বুধবার সংগঠনটির সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের সঙ্গে বৈঠক করে শ্রম আইন সংস্কারে এই তাগিদ দেয় মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধিদল। শ্রম অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে দেশের আইনি সংস্কারের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিনিধিদলকে অবহিত করেন বিজিএমইএর সভাপতি। মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধিদলে ছিলেন লেবার অ্যাটাশে লীনা খান, ফরেন কমার্শিয়াল সার্ভিস অ্যাটাশে পল জি ফ্রস্ট ও ফরেন অ্যাগ্রিকালচারাল সার্ভিস অ্যাটাশে এরিন কোভার্ট।
বৈঠকে বিজিএমইএর সভাপতি ছাড়াও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান, সহসভাপতি মো. রেজোয়ান সেলিম, মিজানুর রহমান, ভিদিয়া অমৃত খান, পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রহিম, পরিচালক ফয়সাল সামাদ, শেখ হোসেন মোহাম্মদ মোস্তাফিজ উপস্থিত ছিলেন। বিজিএমইএর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।
মাহমুদ হাসান খান বলেন, তৈরি পোশাক খাতের শ্রম পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা বিজিএমইএর অন্যতম অগ্রাধিকার। তাঁর নেতৃত্বে পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সুষ্ঠু শিল্প সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ৮১টি শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে সংলাপ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন পাল্টা শুল্কের নির্বাহী আদেশে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা তৈরি পোশাকে যদি কমপক্ষে ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়, তবে সেই পণ্যের ওপর নতুন আরোপ শুল্ক থেকে আনুপাতিকভাবে অব্যাহতি পাওয়া যাবে। বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিজিএমইএ নেতারা মার্কিন প্রতিনিধিদলের কাছে জানতে চান, রপ্তানি পণ্যে কী ফর্মুলায় বা প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল ব্যবহারের মূল্যায়ন এবং স্বচ্ছতা ও ট্রেসেবিলিটি নির্ণয় করা হবে। এ ব্যাপারে দূতাবাসের সহযোগিতা কামনা করেন তাঁরা।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়াতে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে একটি গুদাম স্থাপনের সম্ভাব্যতা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। তাঁরা বলেন এটি বাংলাদেশি উদ্যোগ বা মার্কিন উদ্যোগ বা যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এই গুদাম তৈরি পোশাক রপ্তানিতে লিড টাইম কমাতে ভূমিকা রাখবে।
বিজিএমইএ নেতারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির পাশাপাশি পলিয়েস্টার, নাইলনের মতো ম্যান মেইড ফাইবার আমদানি করতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে তাঁরা মার্কিন দূতাবাসের সহযোগিতা কামনা করেন। বিষয়টি নিয়ে ফরেন কমার্শিয়াল সার্ভিস অ্যাটাশে পল জি ফ্রস্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা বিস্তারিত জানাবেন।
মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে আগামী মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উদ্যোগের সিলেক্ট ইউএসএর সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বিজিএমইএ নেতাদের পরামর্শ দেন। তাঁরা বলেন, এটি বাংলাদেশি তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কিং তৈরিতে সহায়তা করবে।