কুরাইশের নেতৃস্থানীদের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে মুসলিমদের প্রথমবার মক্কা ছাড়ার অনুমতি দেন নবীজি (সা.) নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে।

৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে আরবি রজব মাসে চারজন নারীসহ বারো থেকে পনেরোজন মানুষ আবিসিনিয়ার (বর্তমান ইথিওপিয়া) উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মক্কার সবাই মুসলিম হয়ে গেছে, এই খবর শুনে কয়েক মাস পরে আবার তাঁরা ফিরে আসেন জন্মভূমিতে। কাছাকাছি পৌঁছে শুনতে পান খবরটি মিথ্যা। কয়েকজন যে-পথে এসেছেন সে-পথেই ফিরে যাবেন বলে থমকে যান, কয়েকজন ফিরে যান মক্কাতেই। যাঁরা আবার আবিসিনিয়ায় ফিরবেন বলে ভাবেন, তাদের সঙ্গে যোগ দেন আরও শতাধিক নারী-পুরুষ। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন নবীজি (সা.

)–র চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালিব (রা.)।

প্রশ্ন হলো, নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরত করলেন? আবিসিনিয়ায় বা অন্য কোথাও নয়। এর বেশ কয়েকটি কারণ প্রখ্যাত সিরাত গবেষক আবুল আলি নদভি (র.) তাঁর নবিয়ে রহমত গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন।

নবীজি (সা.) তাঁদের সঙ্গে ছিলেন না। আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীরা যখন আবার হেজাজের পথ ধরেন, ততদিনে নবীজি (সা.)–ও অবশ্য মক্কায় নেই। ৬২১ খ্রিষ্টাব্দের জুনের শেষ দিকে নবীজি (সা.) ইয়াসরিবে চলে গেছেন, যা পরে ‘মদিনাতুন্নবি’ বা ‘নবির শহর’ হয়ে মদিনা নামে খ্যাত হয়েছে। আবিসিনিয়ার মুহাজিরগণ আরও প্রায় সাত বছর পরে ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে সরাসরি মদিনায় এসে নবীজি (সা.)–র সঙ্গে মিলিত হন।

আরও পড়ুনতাঁর জানাজা পড়িয়েছিলেন স্বয়ং রাসুল (সা.)২৬ এপ্রিল ২০২৩

প্রশ্ন হলো, নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরত করলেন? আবিসিনিয়ায় বা অন্য কোথাও নয়। এর বেশ কয়েকটি কারণ প্রখ্যাত সিরাত গবেষক আবুল আলি নদভি (র.) তাঁর নবিয়ে রহমত গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রথমতঃ আল্লাহর নির্দেশ। কী রহস্য ছিল এই নির্দেশের পিছনে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

দ্বিতীয়তঃ ৬২১ ও ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হজের সুযোগে মক্কায় একদল মদিনাবাসী যেভাবে নবীজি (সা.)–এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন এবং নবীজি (সা.)–কে রক্ষার দৃঢ় শপথ করেছেন, আল্লাহর কাছে অত্যন্ত সন্তোষজনক বলে মনে হয়েছে। মদিনাকে দারুল হিজরত বা ইসলামের দাওয়াতের কেন্দ্র হিসাবে নির্বাচনের পেছনে মদিনাবাসীদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন ছিল অন্যতম একটি কারণ।

আরও পড়ুননবীজি (সা.)–এর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু০২ মে ২০২৩

তৃতীয়তঃ ইয়াসরিবের ভৌগোলিক সুবিধা। পর্বত, ঘন খেজুর বন আর ‘হাররা’য় (লাভায় গড়া স্থান) তিন দিক থেকে বেষ্টিত নিরাপদ অঞ্চল। এ ছাড়া তা ছিল কৃষি অঞ্চল। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে মদিনার অবস্থান ছিল দুর্গের মতো নিরাপদ। আরব উপদ্বীপের কাছাকাছি আর কোনো শহর এর সমকক্ষ ছিল না।

চতুর্থতঃ ইয়াসরিবের অধিবাসীদের সহমর্মী মানসিকতা। মদিনার প্রধান দুটি গোত্র আওস ও খায়রাজ জাতীয় মর্যাদাবোধ, আত্মসম্মান, অশ্বারোহণ ও শৌর্য-বীর্যে ছিল বিশিষ্ট। কোনও বড় গোত্র বা হুকুমতকে কখনও তারা কর বা জরিমানা দেয়নি।

পঞ্চমতঃ মদিনার বনি আদি ইবনে নাজ্জার গোত্র ছিল বনি হাশিমের মাতৃকুল। সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) ছিলেন সে বংশের একজন। মদিনায় পৌঁছে নবীজি (সা.) তার ঘরে অবস্থান করেন।

বিয়ের পরে ব্যবসার উদ্দেশ্যে হাশিম সিরিয়ায় গেলে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। সালমার গর্ভে রেখে যান তার অনাগত সন্তান শাইবাকে।

বর্তমান সৌদি আরবের স্বপ্নদ্রষ্টা আবদুল ওয়াহাব নজদির (১৭০৩-১৭৯২) লেখা একটি সিরাত গ্রন্থ হলো মুখতাসার সিরাতুর রসুল (সা.)। এই বইয়ে তিনি সিরাতে ইবনে হিশাম থেকে নিয়ে এই পঞ্চম বিষয়টির একটা সারসংক্ষেপ লিখেছেন। মহানবি (সা.) কেন ইয়াসরিবে গেলেন—তাঁর আলোচনা এ প্রশ্নের চমৎকার একটা মানবীয় ব্যাখ্যা দেয়।

ব্যাখ্যাটা এমন:

মহানবীর (সা.) দাদা আবদুল মুত্তালিবের বাবা হাশিম সিরিয়ায় যাওয়ার পথে ইয়াসরিবের সালমা বিনতে আমেরকে বিয়ে করেন। ইয়াসরিবের দুটি প্রধান গোত্র আওস ও খাজরাজ। সালমা খাজরাজের শাখা বনু নাজ্জার অংশের মেয়ে। বিয়ের পরে ব্যবসার উদ্দেশ্যে হাশিম সিরিয়ায় গেলে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। সালমার গর্ভে রেখে যান তার অনাগত সন্তান শাইবাকে।

আরও পড়ুনমদিনায় রাসুল (সা.)-কে যিনি আশ্রয় দিলেন২৭ এপ্রিল ২০২৩

হাশিমের ছিল আরও তিন ভাই—মুত্তালিব, আবদে শামস এবং বৈমাত্রেয় ভাই নওফল। মুত্তালিব ছিলেন হাশিমের পরে কুরাইশের নেতা। তাঁর কোনো সন্তানাদি ছিল না। বহু বছর পর মুত্তালিব জানতে পারেন, তার ভাইয়ের ছেলে শাইবা ইয়াসরিবে আছেন। তিনি তাকে চাদরে পেঁচিয়ে মক্কায় নিয়ে আসেন। সালমাকে জানান, তাঁর ইচ্ছা, শাইবাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করবেন।

মক্কার লোকেরা প্রথমে ভেবেছিল, ছেলেটা মুত্তালিবের দাস হবে। ফলে তারা তাকে ‘আবদুল মুত্তালিব’ বা ‘মুত্তালিবের দাস’ নামে ডাকতে থাকে। ধীরে ধীরে প্রজ্ঞায়–প্রশংসায় সবাইকে ছাড়িয়ে মুত্তালিব পরবর্তী নেতৃত্বের শীর্ষে চলে আসেন আবদুল মুত্তালিব।

এ নিয়ে মুত্তালিবের অন্য দুই ভাই নওফল ও আবদে শামসের সঙ্গে বিবাদ হয়। কুরাইশের অন্যান্য অংশেও সহায়তা না পেয়ে নিরুপায় আবদুল মুত্তালিব চিঠি লেখেন সেই ইয়াসরিবে—তার মাতুলালয়ে—তার নাজ্জারি মামাদের কাছে। জানা যায়, কয়েক ছত্র কবিতার মাধ্যমে তিনি আর্জি জানিয়েছিলেন। মামা আবু সাদ বিন আদি ভাগ্নের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন।

মক্কাবাসীদের সিরিয়ায় যাওয়ার প্রধান বাণিজ্যপথে ইয়াসরিব হয়েই যেতে হতো। ফলে ইয়াসরিবের প্রধানতম গোত্র খাজরাজি বা নাজ্জারিদের সঙ্গে শত্রুতার পরিণতি নিয়ে আবদে শামসের শঙ্কা থাকারই কথা।

জানা যায়, কয়েক ছত্র কবিতার মাধ্যমে তিনি আর্জি জানিয়েছিলেন। মামা আবু সাদ বিন আদি ভাগ্নের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন।

তা ছাড়া মক্কারই একটি গোত্র বনু খুজায়া আবদুল মুত্তালিবের নাজ্জারি মামাদের সহায়তায় করেন। এমনকি তারা দারুন নদওয়া  বা মক্কার কংগ্রেসনাল সভায় নওফল ও আবদে শামসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে। উল্লেখ্য, হাশিমের দাদি মানে আবদে মানাফের মা আতিকার বংশ ছিল বনু খুজায়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

মামার পক্ষের এই শক্তি আবদুল মুত্তালিবকে মক্কার নেতৃত্বে পুনর্বাসনে সহায়তা করে।

আশ্রয়ের জন্য ইয়াসরিব বা মদিনাকে বেছে নেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ছিল আত্মীয়তার শক্তি। আত্মীয়-কুটুম্বের গুরুত্ব সে-সময় আরবে ছিল বিরাট। একে উপেক্ষা করা হতো না। ইয়াসরিবের ভূমি মহানবীর (সা.) দাদা আবদুল মুত্তালিবের সময় থেকেই তার বংশধরদের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল, বর্তমান সময়ের রাজনীতিতে আত্মীয়তা যেমন সহায়তা হয়ে থাকে।

আবদুল মুত্তালিবের বৈরী চাচা আবদে শামসের ছেলেই উমাইয়া। তার ছেলে হারব। তার ছেলে আবু সুফিয়ান। তার ছেলে মুয়াবিয়া। তার ছেলে ইয়াজিদ। পুরোনো নেতৃত্বের প্রশ্নে বনু হাশেমের সঙ্গে বনু উমাইয়ার বৈরিতার রেশ থেকে যাওয়া অস্বাভিক নয়। তা ছাড়া বনু খুজায়ার সঙ্গে সেই থেকেই আবদুল মুত্তালিব বংশের সদ্ভাব। হোদায়বিয়ার ঘটনার পরে তাদের ওপর যখন কুরাইশদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বনু বকর আক্রমণ করে, সেটাই হয়ে ওঠে মহানবীর (সা.) মক্কা অভিযানের প্রধান অনুঘটক।

আরও পড়ুননবীজি (সা.)-এর মুজিজা২৫ এপ্রিল ২০২৩

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আবদ ল ম ত ত ল ব র মদ ন য় কর ছ ন আরও প হ জরত

এছাড়াও পড়ুন:

“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”

সুরা মুহাম্মাদ আমাদেরকে এক অলৌকিক যাত্রায় নিয়ে যায়, যেখানে দুনিয়ার মায়াজাল থেকে শুরু করে আখিরাতের সত্যতা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে আল্লাহর অসীম রহমতের ছায়া। এই সুরার শেষ আয়াতগুলো (৩৬-৩৮) একটি বিশেষ নিয়ম প্রতিষ্ঠা করে: “আল্লাহ ধনী এবং তোমরা দরিদ্র”।

এটা জীবনের এক গভীর দর্শন।

সুরা মুহাম্মাদ মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলিমরা হুদায়বিয়ার সন্ধির পরের দিনগুলো পার করছে। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে যে, সুরা ফাতহের পর এই সুরা ‘কারে আল-গামিম’ (মক্কার কাছে এক স্থান) নামক স্থাকে অবতীর্ণ হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪১৭২)

এই সুরা মুসলিমদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিজয়ের পরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, কারণ দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। ইমাম আলুসি বলেছেন, এই সুরা মুনাফিকদের সন্দেহ দূর করে এবং মুমিনদের ইমান বৃদ্ধি করে। (ইমাম আলুসী, রুহুল মা'আনি ফিত তাফসিরিল কুরআনিল আজিম, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১২৩)

প্রথম: দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া-কৌতুক

আয়াতগুলো দুনিয়ার স্বরূপ বর্ণনা করে একটা ধাক্কা দিয়ে শুরু হয়: “নিশ্চয় দুনিয়ার জীবন কেবল ক্রীড়া ও কৌতুক।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৬)

এই বর্ণনা দুনিয়াকে অবজ্ঞা করে না, বরং এর ক্ষণস্থায়িত্ব দেখিয়ে দেয়। দুনিয়া যেন শিশুদের খেলা—আনন্দময় কিন্তু অস্থায়ী। এর মোহে মত্ত হয়ে যাওয়া মানে আমাদের দায়িত্ব ভুলে যাওয়া। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় বা দানের ক্ষেত্রে, যখন মানুষ অর্থের জন্য পিছিয়ে যায়।

এই বর্ণনা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়া সৌন্দর্যের জন্য নয়, আখিরাতের প্রস্তুতির জন্য। এক কবি বলেছেন, “যুবকের জীবনপ্রিয়তা তাকে অপমানিত করে... যদিও তার মধ্যে সাহস ও মর্যাদা থাকে”।

দুনিয়ার মায়ায় আটকে থাকলে আমরা শত্রুর সামনে দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু সত্যিকারের জীবন আখিরাতে, যেখানে আমাদের কাজের ফল পাব। এই শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য—দান করলে দুনিয়ার মোহ কমে, আখিরাতের দিকে হৃদয় ঝুঁকে যায়।

আরও পড়ুনব্যস্ত জীবনেও কোরআন খতমের কার্যকর কৌশল০৩ আগস্ট ২০২৫দ্বিতীয়: ইমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর পুরস্কার

দুনিয়ার স্বরূপ বর্ণনার পর আসে উপায়: “আর যদি তোমরা ইমান আন এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে তোমাদের পুরস্কার দান করবেন।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৬)

এখানে আগের আয়াতের নিষেধের (তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং সন্ধির আহ্বান করে বসো না, যখন তোমরাই প্রবল) সঙ্গে যুক্তি দেয়া হয়েছে যে ইমান ও তাকওয়া দুনিয়ার দুর্বলতা দূর করে এবং আল্লাহর পুরস্কার নিশ্চিত করে।

খ্যাতিমান তাফসিরকারক ইবনে আশুর বলেছেন, সন্ধির আহ্বান করার পিছনে অর্থের ভালোবাসা থাকতে পারে, কিন্তু ইমান ও তাকওয়া এই দুর্বলতা দূর করে দেয়। দরিদ্রকে দান করার মূলেও রয়েছে তাকওয়া অবলম্বন করা এবং নিষেধ থেকে বিরত থাকা। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১২৩)

ইমান ছাড়া সকল কাজ অসম্পূর্ণ; তাকওয়া ছাড়া দান হৃদয়কে পরিষ্কার করে না। এই দুটি মিলে দানকে ইবাদত করে তোলে, যা আল্লাহর কাছে মর্যাদা বাড়ায়।

হাদিবিয়ার চুক্তির পর মুসলিমরা হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু ইমান ও তাকওয়ায় তারা অটল রয়েছিলেন। ফলে মক্কা বিজয় হয়েছে। তেমনি দান-সদকা যদি একনিষ্ঠ ইমানের সঙ্গে করা হয়, তাহলে তাতে সম্পদের ক্ষতি হয় না, বরং আখেরে লাভ হয়।

তৃতীয়: আল্লাহ তোমাদের সম্পদ চান না

আল্লাহর রহমতের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত এই আয়াতে: “আর তিনি তোমাদের সম্পদ চান না। যদি তিনি চাইতেন, তাহলে তোমাদের চাপ দিতেন তাহলে তোমরা কৃপণতা করতে আর তাতে তিনি তোমাদের বিদ্বেষভাব প্রকাশ করে দিতেন।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৬-৩৭)

আল্লাহ জানেন মানুষের অর্থের প্রতি আকর্ষণ। তাই তিনি সবকিছু দাবি করেন না, বরং সামান্য অংশ (জাকাত, সাদাকা) চান।

কাতাদা বলেছেন, “আল্লাহ জানেন যে, অর্থ বের করলে হৃদয় থেকে গোপন বিদ্বেষ বের হয়ে যায়।” (ইমাম ইবনে কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯ খ্রি., খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ১৮৩)

ইবনে আশুর বলেছেন, এটি ফিতনার পথ বন্ধ করার মূল। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তুনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১৩৪)

মদিনায় নবীজির সময় মুসলিমরা নবীজির অনুসরণ করে অর্থ দান করেছিলেন, কিন্তু মুনাফিকরা সন্দেহ করত। আল্লাহ তাদের অবস্থা বিবেচনা করে অল্প দাবি করেছেন। এই রহমত দেখিয়ে দানকে সহজ করে।

একজন দরিদ্র সাহাবী অল্প অর্থ দান করলেন, নবীজি (সা.) বললেন, “আল্লাহ তোমার মতো দরিদ্রের অল্প দানকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, কারণ এটি সত্যিকারের ত্যাগ”।

আরও পড়ুনযে দানে ত্যাগের অনুভূতি হয়, সেটিই প্রকৃত দান১১ ডিসেম্বর ২০২৪চতুর্থ: দানকারীই প্রথম লাভবান হয়

আয়াতগুলো মুমিনদের প্রতি সরাসরি আহ্বান জানায়: “তোমাদেরকে আহ্বান করা হচ্ছে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করতে। তোমাদের মধ্যে কেউ কৃপণতা করে, আর যে কৃপণতা করে সে তার নিজের প্রত কৃপণতা করে।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৮)

এখানে আহ্বান দুই রকম: বাধ্যতামূলক (জাকাত) এবং উৎসাহমূলক (সাদাকা)। কার্পণ্যকারী নিজের প্রতিই কার্পণ্য করে, কারণ দানের লাভ তারই হয়।

ইবনে আশুর বলেছেন, কৃপণের সম্পদ শত্রুর হাতে পড়ে বা সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১৪৫)

পঞ্চম: “আল্লাহ ধনী এবং তোমরা দরিদ্র”

আল্লাহর ধন অসীম, আমাদের দারিদ্র্য সীমাবদ্ধ। ইবনে আশুর বলেছেন, আল্লাহের ধনাঢ্যতা সর্বব্যাপী ও চিরস্থায়ী, আমাদের দারিদ্র্য তাঁর সামনে সীমিত। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১৫৬)

আল্লাহর আমাদের প্রয়োজন নেই, তাঁর দান আমাদের জন্যই। এই সত্যতা বুঝলে আমরা অহংকার থেকে মুক্ত হতে পারব। দান করলে আল্লাহর কাছে আমাদের হৃদয় ঐশ্বর্যবান হয়ে যায়।

ষষ্ঠ: সবিশেষ সতর্কতা

সুরা শেষ হয় সতর্কতায়: “আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য এক সম্প্রদায়কে আনবেন, যারা তারপর তোমাদের মতো হবে না।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৮)

ইসলাম ধারণকারীরা যদি ক্ষমতাহীন হয়, আল্লাহ অন্যকে বেছে নেবেন। নবীজি (সা.) এই আয়াত তিলাওয়াত করে সালমান ফারসী (রা.)-এর কাঁধে হাত রেখে বলেছেন, “যে জাতিই এমন হবে, তার জন্যই এই নিয়ম।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৮৬)।

এই সুন্নাহ আমাদেরকে সতর্ক করে যে, দান ও ত্যাগের দায়িত্ব পালন না করলে আমরা হারিয়ে যেতে পারি।

সুরা মুহাম্মাদের এই আয়াতগুলো আমাদেরকে শেখায় যে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, ইমান ও তাকওয়া তার মোহ থেকে মুক্ত করে, আল্লাহর রহমত দানকে সহজ করে, দানের লাভ দাতারই এবং আল্লাহ ধনী—আমরা তাঁর কাছে দরিদ্র।

এই শিক্ষা আজকের দুনিয়ায় বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যেখানে লোভ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। দান করে আমরা নিজেকে সমৃদ্ধ করি এবং সমাজকে একত্রিত করি। আল্লাহ আমাদেরকে এই পথে চলার তাওফিক দিন। আমীন।

আরও পড়ুনআল-আজিজ, যিনি ইজ্জত দান করেন২০ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • “আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”