গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের ফটকে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান করছিলেন আল-জাজিরা আরবির গাজা প্রতিনিধি আনাস আল-শরিফ ও মোহাম্মদ কুরেইকেহ। এই দুই সাংবাদিকের সঙ্গে ছিলেন তাঁদের ক্যামেরাম্যান ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নওফাল ও মোয়ামেন আলিওয়া।

গত রোববার রাতে ইসরায়েল আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান ফটকের কাছে সাংবাদিকদের থাকার জন্য ব্যবহৃত একটি তাঁবুতে ড্রোন হামলা চালায়। হামলায় আল–জাজিরার পাঁচ সংবাদকর্মীসহ সাতজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মোহাম্মদ আল-খালদি নামে আরেকজন স্থানীয় ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিকও রয়েছেন।

নিহত সাংবাদিকেরা ২২ মাস ধরে গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং সেখানকার বাসিন্দাদের ওপর যুদ্ধের কী প্রভাব পড়ছে, তার প্রামাণ্য দলিল সংগ্রহ করছিলেন। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের সম্ভাব্য গণহত্যার প্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়েই এই সাংবাদিকদের প্রাণ হারাতে হয়েছে।

‘এই উন্মত্ততা যদি না থামে, গাজা পরিণত হবে ধ্বংসস্তূপে, এখানকার মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে, তাঁদের মুখগুলো মুছে যাবে আর ইতিহাস আপনাদের মনে রাখবে সেই নির্বাক সাক্ষী হিসেবে, যাঁরা এই গণহত্যা বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত বেছে নিয়েছেন।আনাস আল-শরিফ, গাজায় নিহত আল–জাজিরার সাংবাদিক

রোববার রাতের ওই হামলার পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাবাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, আনাস আল-শরিফকে নিশানা করেই তারা ওই হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, হামাসের একটি সন্ত্রাসী সেলের প্রধান ছিলেন আল-শরিফ।

ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার কয়েক মিনিট আগে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ‘এক্স’–এ একটি পোস্ট দিয়েছিলেন আল-শরিফ। সর্বশেষ ওই পোস্টে তিনি বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে বলেছিলেন, গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার পরিকল্পনা অবরুদ্ধ এ অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠ সম্পূর্ণ রুদ্ধ করার ঝুঁকি তৈরি করেছে।

শরিফ লেখেন, ‘এই উন্মত্ততা যদি না থামে, গাজা পরিণত হবে ধ্বংসস্তূপে, এখানকার মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে, তাঁদের মুখগুলো মুছে যাবে আর ইতিহাস আপনাদের মনে রাখবে সেই নির্বাক সাক্ষী হিসেবে, যাঁরা এই গণহত্যা বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত বেছে নিয়েছেন।’

রোববার রাতের ওই হামলার পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাবাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, আনাস আল-শরিফকে নিশানা করেই তারা ওই হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, হামাসের একটি সন্ত্রাসী সেলের প্রধান ছিলেন আল-শরিফ।

২০২৪ সালের মার্চে আল-শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার সময় মোহাম্মদ কুরেইকেহর মা নিহত হন। তিনি তাঁর মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। কুরেইকেহ দুই সপ্তাহ খোঁজাখুঁজির পর হাসপাতালের একটি সিঁড়িতে পড়ে থাকা অবস্থায় মায়ের মৃতদেহ খুঁজে পান, তত দিনে সেটিতে পচন ধরে গিয়েছিল।

পরে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে কুরেইকেহ জানতে পারেন যে তাঁর মাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

ব্যক্তিগত শোক ও অসহনীয় পরিস্থিতি সত্ত্বেও আল-শরিফ ও কুরেইকেহ গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছিলেন। বিশ্বজুড়ে ক্রমেই এ যুদ্ধ গণহত্যা বলে বিবেচিত হওয়ার দাবি বাড়ছে।

ত্যাগ ও সাহস

গাজার বাকি সব ফিলিস্তিনির মতো আল-শরিফ ও কুরেইকেহ ইসরায়েলি দখলদারির মধ্যেই জন্ম নিয়েছিলেন এবং বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁরা জীবনের বেশির ভাগ সময় দেখেছেন, ইসরায়েল গাজার স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথ সম্পূর্ণ অবরোধ করে রেখেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভাষায়, গাজা কার্যত খোলা আকাশের নিচে এক উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে।

এই অবরোধ ফিলিস্তিনিদের জীবিকা, যাতায়াত, পারিবারিক সম্পর্কসহ জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করেছে। আল-শরিফ ও কুরেইকেহ ইসরায়েলের নির্মম দখলের অধীনে তাঁদের জনগণের জীবনসংগ্রামের গল্প বিশ্বকে জানাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন।

‘(সে সময় উত্তরাঞ্চলে) ইসরায়েলি হামলার কারণে তাঁর জীবন ঝুঁকিতে ছিল। তবু তিনি ইসরায়েলের প্রতিটি হামলার পর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতেন, ইসরায়েলের অপরাধের মুখোশ উন্মোচন করার জন্যইয়াসের আল-বান্না, গাজায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিক।

আল-শরিফ গাজার আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া স্টাডিজে লেখাপড়া করেছিলেন এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরায়েলি সামরিক অভিযান নিয়ে নিজের প্রতিবেদনের জন্য তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। তিনি সেখানে যুদ্ধের মানবিক ও অসামরিক প্রভাব নিয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছিলেন।

গাজার ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ইয়াসের আল-বান্না বলেন, যখন ইসরায়েল ২২ লাখ ফিলিস্তিনিকে গাজার দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল, তখনো আল-শরিফ ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান ও কার্যক্রম নথিভুক্ত করতে গাজার উত্তরাঞ্চলে রয়ে যান।

কয়েকজন ফিলিস্তিনি গাজা সিটিতে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি জায়গা দেখছেন। এ জায়গাটিতেই আনাস আল–শরিফসহ আল–জাজিরার পাঁচ সংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন। ১১ আগস্ট ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র ম হ ম মদ আল জ জ র ছ ল ন আল করছ ল ন গণহত য স গ রহ

এছাড়াও পড়ুন:

গাজা দখল করে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ গড়তে চান নেতানিয়াহু

নিজের জনগণকে ৬৭০ দিনের বেশি সময় ধরে ধ্বংস হতে দেখার বেদনা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এত কষ্ট, এত অপরাধের সাক্ষী হওয়ার পরও গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আরেক দফা ইসরায়েলি হামলার কথা ভাবা পর্যন্ত কল্পনার বাইরে। অথচ বিশ্বের চোখের সামনেই এটি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ব কি শুধু দাঁড়িয়ে দেখে যাবে?

ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা গাজায় এই নতুন হামলার ঘোষণা দিয়েছে। গাজা উপত্যকাকে ‘সম্পূর্ণ দখল’ করার জন্যই তারা সেখানকার জনবসতিগুলোয় হামলা চালানোর পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এ হামলা শুরু হবে গাজা সিটি থেকেই। এর ফলাফল অনুমান করা কঠিন নয়।

২০২৪ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক সতর্কবার্তা ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) নির্দেশ অমান্য করে ইসরায়েল রাফা এলাকায় হামলা চালায়। আজ রাফার কোনো অস্তিত্ব নেই। এরপর ২০২৪ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তারা উত্তর গাজার বেইত লাহিয়া, বেইত হনুন ও জাবালিয়া শহরে হামলা চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দেয়। 

আরও পড়ুনমুখ ফিরিয়েছে বিশ্ব, গাজা কি নিভে আসছে ০৯ জুন ২০২৫

সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালন এ অভিযানকে বলেছেন ‘জাতিগত নিধন’। এরপর ইসরায়েল একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফেলে, ২০ লাখ বেঁচে থাকা মানুষকে অনাহারে রাখে এবং দক্ষিণের খান ইউনিস শহর ধ্বংস করে দেয়। এসব কাজ ২০২৪ সালের জানুয়ারি, মার্চ ও মে মাসে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের দেওয়া তিনটি গণহত্যাবিরোধী রায়ের সরাসরি লঙ্ঘন।

জানুয়ারিতে আদালত গাজায় গণহত্যার ঝুঁকি আছে বলে জানান এবং তা ঠেকাতে কিছু ব্যবস্থা নিতে বলেন। এর মধ্যে ছিল গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু দেখা গেল, ইসরায়েল এই নির্দেশ মানছে না। গাজা সিটিতে হামলা হলে তা এই গণহত্যা অভিযানের শেষ ধাপ হবে।

যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমা দেশগুলো গত দুই বছরে ইসরায়েলের গণ–অত্যাচারের সহযোগিতার দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে না। ইসরায়েলকে জবাবদিহি থেকে মুক্তি দিয়ে এবং এই দুষ্ট রাষ্ট্রকে অস্ত্র সরবরাহ করে পশ্চিমারা এই অপরাধগুলোকে সম্ভব করেছে। সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে ঘোষণাগুলো এসেছে, তা কেবল প্রচারমূলক চাল ও মনোযোগ সরানোর কৌশল।

৭ অক্টোবরের পরপরই ইসরায়েলের নেতা, রাজনীতিক, সামরিক কমান্ডার ও সেনারা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তাঁরা গাজাকে ধ্বংস করে দেবেন, পুড়িয়ে দেবেন এবং সমতল করে দেবেন। তাঁরা ঠিক সেটাই করেছেন। তাঁরা গাজার ৯০ শতাংশ এলাকা কার্যত ধ্বংস করে এটিকে জনমানবহীন মরুভূমিতে পরিণত করেছেন। বাকি জনসংখ্যাকে ঠাসা অবস্থায় মাত্র ১২ শতাংশ এলাকায় গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। সেখানে মানুষের বেঁচে থাকার মতো কোনো পরিবেশ নেই। অবরোধ আর বোমাবর্ষণের মাধ্যমে ইসরায়েল গাজায় কোনো নিরাপদ জায়গা রাখেনি। বাইরে যাওয়ারও কোনো পথ রাখেনি।

এখন গাজা সিটি, দেইর আল-বালাহ বা আল-মাওয়াসির বাকি জনবসতিতে হামলার মানে হবে নতুন গণহত্যা, আরও ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি এবং অবশিষ্ট অনাহারগ্রস্ত মানুষকে সরাসরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এর মানে ইসরায়েল আসলে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ গড়ার মেসিয়ানি কল্পনা ও অপরাধমূলক প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে—ইসরায়েলের লক্ষ্য ‘সর্বোচ্চ পরিমাণ জমি, সর্বনিম্নসংখ্যক আরব’।

গাজায় দাতব্য রান্নাঘরের সরবরাহ করা খাবার সংগ্রহ করতে ফিলিস্তিনিদের ভিড়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজা দখল করে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ গড়তে চান নেতানিয়াহু
  • তারা তোমার অশ্রুর যোগ্য ছিল না, আনাস!
  • গাজায় গণহত্যা নিয়ে ভারত সরকারের নীরবতা ‘লজ্জাজনক’: প্রিয়াঙ্কা গান্ধী
  • অস্ট্রেলিয়াও সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনকে ‘স্বীকৃতি দেবে’
  • জাতিসংঘে তীব্র সমালোচনার মুখে ইসরায়েল, গাজা–পরিকল্পনার পক্ষে সাফাই নেতানিয়াহুর
  • নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই গাজার পক্ষে নরওয়ে কাঁপিয়ে দিল ব্যান্ডটি