মার্কিন রাজনৈতিক পরিসরে যখন কেউ ফিলিস্তিনের মানবিক বিপর্যয়ের কথা তোলে, তখনই প্রশ্ন আসে, ‘৭ অক্টোবরের হামাসের বিষয়টা কী হবে?’ এ প্রশ্ন যেন একটি অস্ত্র, যা দিয়ে ফিলিস্তিনপন্থী বা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলা মানুষদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, বিশেষত মার্কিন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। অথচ এর পাল্টা জবাব হতে পারে, ‘৬ আগস্টের বিষয়টা তাহলে কী হবে?’

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় প্রথম পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল। তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বোমা ফেলা হয়। এই দুই হামলায় আনুমানিক দুই লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল।

এর আগেই ১৯৪৫ সালের মার্চে ‘অপারেশন মিটিংহাউস’ নামে পরিচিত ভয়াবহ অগ্নিবোমা হামলায় টোকিওতে কয়েক হাজার মানুষ মারা যান এবং এক মিলিয়নের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন।

আজ গাজার গণহত্যার সময় যে ‘সংখ্যার রাজনীতি’ আমরা দেখছি, তা এক শীতল বাস্তবতার প্রতিফলন। টোকিও অভিযানের নেতৃত্বদানকারী মার্কিন জেনারেল কার্টিস লে মে খুব ভালো করেই জানতেন, জনবহুল এলাকায় ন্যাপাম ফেলার মানে কী। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘যদি আমরা যুদ্ধে হেরে যেতাম, তাহলে আমাদের সবাইকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হতো।’

আরও পড়ুনযে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে হামলা চালাল ইসরায়েল১৪ জুন ২০২৫

লে মে শুধু জাপানেই থেমে থাকেননি। ১৯৮৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন, মার্কিন বোমা উত্তর কোরিয়ার ২০ শতাংশ জনগণকে হত্যা করেছিল এবং ‘যা নড়াচড়া করেছে’—এ রকম সবকিছুকে তারা লক্ষ্যবস্তু করেছিল।

ইতিহাসবিদ ব্রুস কামিংস নিউজউইকে বলেছিলেন, ‘বেশির ভাগ আমেরিকান জানেনই না যে আমরা উত্তর কোরিয়ার শহরগুলো জাপান বা জার্মানির তুলনায় বেশি ধ্বংস করেছিলাম।…কিন্তু প্রত্যেক উত্তর কোরীয় জানেন। তাঁদের মগজে সেটা গেঁথে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা কখনো এসব শুনি না।’

সম্মিলিত শাস্তির নীতি

লে মে একসময় কিউবার বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন, যদিও প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তাঁকে আটকে দেন। কিন্তু ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় ন্যাপাম হামলার সময় তিনি ‘মানুষকে পাথরযুগে ফেরত পাঠানোর’ বোমাবর্ষণ নীতিতে বিশ্বাস করতেন।

গালফ যুদ্ধ (১৯৯১) শুরুর আগেই লে মে মারা যান। কিন্তু আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এবং আরও বহু মার্কিন আগ্রাসনে তাঁর তত্ত্ব বেঁচে আছে। আকাশ থেকে নির্বিচারে গণসন্ত্রাস চাপিয়ে দিয়ে স্থানীয় জনগণকে অমানবীয় করে তোলা হয়, যেখানে সবাইকে দোষী ধরা হয় এবং সম্মিলিত শাস্তি দেওয়া হয়।

সাম্প্রতিক মার্কিন বক্তব্যও এ ধারাই বজায় রেখেছে। ৮ সেপ্টেম্বর জেরুজালেমে এক বাসস্ট্যান্ডে দুই ফিলিস্তিনির হামলায় ছয়জন ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি ঘোষণা করেন, ‘এই বর্বরতার বিরুদ্ধে আমরা ইসরায়েলের পাশে আছি।’

এখানে প্রশ্ন ওঠে: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কি সত্যিই স্বাধীন, নাকি ইসরায়েলপন্থী লবিগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? একই সঙ্গে কি দুটি বিষয় সত্য হতে পারে? আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খামখেয়ালি মন্তব্য বা ‘শান্তি উদ্যোগ’ আসলে কী বোঝায়?

বিশ্বনেতারা শোক প্রকাশ করেন, আর বিশ্লেষক মুইন রাব্বানির ভাষায় ‘সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা’ আবারও সক্রিয় হয়—‘টেরর টাওয়ার’, ‘ব্রিডিং গ্রাউন্ড’ ইত্যাদি প্রোপাগান্ডা শব্দগুচ্ছ ছড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধ আড়াল করার প্রচেষ্টা চলে।

এখানে প্রশ্ন ওঠে: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কি সত্যিই স্বাধীন, নাকি ইসরায়েলপন্থী লবিগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? একই সঙ্গে কি দুটি বিষয় সত্য হতে পারে? আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খামখেয়ালি মন্তব্য বা ‘শান্তি উদ্যোগ’ আসলে কী বোঝায়?

আরও পড়ুনট্রাম্প ও নেতানিয়াহু মূলত ‘জেনোসাইড পুরস্কারের’ যোগ্য ২৭ আগস্ট ২০২৫প্রত্যাখানেযাগ্যতা বনাম বাস্তবতা

একসময় ‘প্লজিবল ডিনায়েবিলিটি’ (প্রত্যাখ্যানযোগ্যতা) ছিল মার্কিন কৌশলের কেন্দ্রীয় উপাদান। কিন্তু এডওয়ার্ড স্নোডেন, চেলসি ম্যানিং ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ফাঁস করা তথ্য সেই মুখোশ খুলে দিয়েছে। তবু ইসরায়েলের অস্বাভাবিক প্রভাব—মার্কিন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে—আরও জটিল অস্বীকারযোগ্যতার কাঠামো তৈরি করেছে।

বাইডেন–হ্যারিস প্রশাসন ‘গাজা পিয়ার প্রকল্প’-এর মতো হাস্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে আর ট্রাম্প–ভ্যান্সের দল ‘উইটকফ প্ল্যান’ বা ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ হুমকির মতো কৌতুকময় নাটক করেছে। কিন্তু উভয় প্রশাসনই জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে এবং ইসরায়েলকে অব্যাহত সামরিক সহায়তা দিয়েছে। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে এক ফোনকল বা নির্বাহী আদেশেই গাজার গণহত্যা থামাতে পারত।

কিন্তু বাস্তবতা হলো মার্কিন রাজনীতি ও নিরাপত্তাকাঠামো ইসরায়েলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আইপ্যাকের নির্বাচনী তহবিল থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশিক্ষণ, নজরদারি প্রযুক্তি—সবখানেই ইসরায়েলি প্রভাব দৃশ্যমান।

প্রক্সি রাষ্ট্র ও মার্কিন আধিপত্য

এতে প্রশ্ন ওঠে, ইসরায়েলি জায়নবাদী আদর্শ, প্রযুক্তি ও রাজনীতির এই অতিরিক্ত প্রভাব আসলে কি যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক নীতির জন্যই এক ‘অস্বীকারযোগ্য’ প্রক্সি কাঠামো?

সিরিয়ার শাসন পরিবর্তন, লেবাননকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, ইরানকে লক্ষ্য করে যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা, মিসরকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ দিয়ে শ্বাসরোধ করা, আব্রাহাম চুক্তি—সবই সেই ইঙ্গিত দেয়।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান ইহুদি সমাজ কোথায় দাঁড়াবে? সমর্থনকারী বা বিরোধী উভয় পক্ষের জন্যই এটি এক কঠিন বাস্তবতা। নেতানিয়াহু, যিনি আমেরিকায় বহু বছর কাটিয়েছেন, একদিকে প্রগতিশীলদের কাছে সমালোচিত, অন্যদিকে জায়নবাদীদের কাছে নায়ক হিসেবে বিবেচিত হন।

শেষ পর্যন্ত, বর্তমান কাঠামো কেবল ইসরায়েলকে মার্কিন প্রক্সি হিসেবে ধরে রাখছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত বিশ্বভূমিকা নিয়ে গভীরভাবে প্রশ্ন না ওঠে। একই সঙ্গে এই প্রক্সি ভূমিকা মার্কিন ইহুদি সমাজের জন্য নতুন বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা নিয়ে তাদের ভাবনা শুরুই হয়নি।

আমিয়েল আলকালাই মার্কিন কবি, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার, সমালোচক ও গবেষক।

মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল ব স তবত প রক স র জন ত আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

দর্শক–সংকটে বগুড়ার ‘মধুবন সিনেপ্লেক্স’ আবারও বন্ধ ঘোষণা

আবারও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো বগুড়ার ‘মধুবন সিনেপ্লেক্স’। দর্শক–সংকটে লোকসানের কারণে সিনেমা হলটি বন্ধ ঘোষণা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালিক আর এম ইউনুস রুবেল। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি বন্ধের কথা জানান।

ফেসবুকে আর এম ইউনুস লেখেন, ‘১৯৭৪ সালের কোরবানির ঈদে যাত্রা শুরু করা মধুবন নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়েছে। “ডাকু মনসুর” সিনেমা দিয়ে যাত্রা শুরু করা মধুবনে হাউসফুল চলেছে উত্তমকুমার ও মালা সিনহা অভিনীত “পৃথিবী আমারে চায়”, “গোপী গাইন বাঘা বাইন”, “সূর্যকন্যা”, “সীমানা পেরিয়ে”, “বসুন্ধরা”, “নাগ নাগীনি”, “লাইলী মজনু”, “রসের বাঈদানী”, “গোলাপী এখন ট্রেনে”, “সুজন সখী”সহ দর্শকনন্দিত বহু সিনেমা। এরপর নানা সংকটে ২০০৬ সালে মধুবন প্রথম বন্ধ হয়। ২০১৪ সালে মধুবন পুনরায় চালু হয়। ২০২১ সালে নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু করে মধুবন। মধুবন সিনেপ্লেক্সকে টিকিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে। কারণ, এর প্রতিটি ইটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার বাবার হাতের ছোঁয়া, পরিবারের আবেগ ও অনুভূতি।’

প্রেক্ষাগৃহ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর ‘বাজি’ সিনেমা প্রদর্শনের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু করে মধুবন সিনেপ্লেক্স। ৩৩৬ আসন নিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করা মধুবন রীতিমতো দর্শকজোয়ারে ভাসতে থাকে। প্রদর্শন ব্যবসায় রীতিমতো বাজিমাত করে ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘প্রিয়তমা’, ‘তুফান’, ‘রাজকুমার’, ‘বরবাদ’ সিনেমা। ব্যবসাসফল হয়েছে হিন্দি সিনেমা ‘জওয়ান’ ও ‘পাঠান’। সব শেষ ‘তান্ডব’ সিনেমা প্রদর্শনকালে দর্শক সামাল দিতে নিয়মিত শো ছাড়াও মধ্যরাতে শো চালাতে হয়েছে। এরপর ভালো ছবি মুক্তি না পাওয়ায় দর্শকের অভাবে হলটির প্রদর্শন ব্যবসায় ছন্দপতন ঘটে।

বগুড়া জেলাজুড়ে একসময় সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৩৮। তবে জেলাটি সিনেমার সেই জৌলুশ হারিয়েছে অনেক দিন। ভাঙা পড়েছে ৩১টি হল। শহরে ২টিসহ পুরো জেলায় মোটে ৭টি সিনেমা হল টিকে আছে। শুধু জেলা শহরেই একসময় ১০টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল। সবশেষ শহরে চালু ছিল মধুবন সিনেপ্লেক্স ও সোনিয়া হল।

আরও পড়ুনআজ ‘বাজি’ দিয়ে নতুন করে মধুবন সিনেপ্লেক্সের যাত্রা শুরু১৫ অক্টোবর ২০২১

একে একে বন্ধ হয়ে গেছে শহরের সাতমাথায় অবস্থিত মাধু ও মেট্রো সিনেমা, মেরিনা টকিজ, কবি নজরুল ইসলাম সড়কে উত্তরা টকিজ, চারমাথায় বীথি সিনেমা, জাহাঙ্গীরাবাদ ক্যান্টনমেন্টে সেনা অডিটরিয়াম, মাঝিরা ক্যান্টনমেন্টে উল্লাস সিনেমা হল, চক সূত্রাপুর মাসুম সিনেমা হল এবং বনানী সিনেমা হল। সর্বশেষ বন্ধ হয়েছে বাম্বি সিনেমা হল। মাধু, মেট্রো ও মেরিনা ভেঙে বহুতল শপিং সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে।

মধুবন সিনেপ্লেক্সের মালিক আর এম ইউনুস রুবেল বলেন, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল, রক্ষণাবেক্ষণে গড়ে প্রতি মাসে খরচ দুই লাখ টাকা। গত ঈদুল আজহায় শাকিব খান অভিনীত ‘তান্ডব’ সিনেমার পর ভালো ছবি না থাকায় দর্শক নেই। ধুঁকে ধুঁকে চলছিল সিনেপ্লেক্সটি। ছবি চালিয়েও খরচ ওঠেনি। বিদ্যুৎ বিল বকেয়া। ঋণ করে কর্মচারীদের বেতন শোধ করতে হয়েছে। এভাবে মাসের পর মাস লোকসান গুনতে গুনতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বাধ্য হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য মধুবন সিনেপ্লেক্স বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। এরপর নির্বাচিত সরকার বিদেশি সিনেমা আমদানির উদ্যোগ নিলে চালু করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • একসময় ছিলেন অবৈতনিক শিক্ষক, এখন সব শিক্ষার্থীর টিউশন ফি পরিশোধ করেন তিনি
  • দর্শক–সংকটে বগুড়ার ‘মধুবন সিনেপ্লেক্স’ আবারও বন্ধ ঘোষণা
  • সুপারিগাছের ফেলনা খোলে থালা–বাটি, তৈজস, বদলাচ্ছে গ্রামটি
  • ইসরায়েলের সঙ্গে যে কারণে আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে ভারত
  • আগামী তিন দিন বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভের আহ্বান হামাসের
  • লেবু ফুল
  • গাজায় নিহতের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়াল