ঢাকার ফুসফুসকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে
Published: 13th, October 2025 GMT
একটি শহরকে বাসযোগ্য হতে গেলে যেখানে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ সবুজ অঞ্চল রাখতে হয়, সেখানে ঢাকায় সবুজ অঞ্চল ৭ শতাংশের কম। বৈশ্বিক মানদণ্ডে যেখানে জলাভূমি থাকতে হয় ১২ শতাংশ, সেখানে ঢাকায় তা কমতে কমতে ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে। ঢাকাকে কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত করার এ প্রতিযোগিতায় কারও অবদানই কম নয়। তাপীয় দ্বীপ হয়ে ওঠা ঢাকা বাসযোগ্যতার দিক থেকে এখন বিশ্বের তলানিতে থাকা নগর। ফলে ঢাকায় এখনো নিবু নিবু হয়ে টিকে থাকা সবুজ অঞ্চল বিরান করে ও জলাভূমি ভরাট করে নতুন স্থাপনা নির্মাণ মানেই স্বেচ্ছায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মতো ব্যাপার।
এমন রূঢ় বাস্তবতায় ঢাকার ফুসফুসখ্যাত ওসমানী উদ্যানে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় স্থাপনা নির্মাণের যে প্রকল্প শুরু করেছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে আমরা পারি না। বিগত সরকারের আমলে উন্নয়নের নামে ঢাকার একের পর এক পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠকে যেভাবে কংক্রিটের স্থাপনায় পরিণত করা হয়েছে, সেটা এককথায় রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ও স্বেচ্ছাচারিতার ধ্রুপদি উদাহরণ। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে উন্মুক্ত জনপরিসরকে নাগরিকদের প্রবেশাধিকারও সীমিত করে ফেলা হয়েছে। পরিবেশকর্মী, নগর–পরিকল্পনাবিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগ, সতর্কতা ও পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই একই ধারাবাহিকতা কেন দেখতে হবে? বিগত সরকারের আমলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ করে ওসমানী উদ্যানকে ইতিমধ্যে কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত করা হয়েছে। ২১ দশমিক ৮৫ একরের এ উদ্যানে এখনো নানা প্রজাতির গাছ ও দুটি জলাশয় আছে, যা এ নগরের বিলুপ্তপ্রায় সবুজ অঞ্চল ও জলাভূমির শেষ চিহ্ন। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, পার্ক বা উদ্যানের পুরো আয়তনের ৫ শতাংশ জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে। অথচ ওসমানী উদ্যানে এরই মধ্যে ৫ শতাংশের বেশি আয়তনের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আবার বিধিমালায় ১৬ ফুটের বেশি উঁচু স্থাপনা করা যাবে না বলা হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণের যে প্রকল্প নিয়েছে, সেটার উচ্চতা ৯০ ফুট। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, যে জায়গায় এ স্থাপনা নির্মাণ চলছে, সেটা শিশুদের খেলার জায়গা। এ নগরে সামান্য একটু খেলার জায়গার অভাবে লাখ লাখ শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য যেখানে মারাত্মক ঝুঁকিতে, সেখানে এই উদ্যোগের অর্থ কী?
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা যুক্তি দিয়েছেন, ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিকে স্মরণ করে ঢাকার বড় বড় পার্কে স্থাপনা নির্মাণের নজির আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অতীতে ঢাকার উদ্যান ও পার্কে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদাহরণ কি বর্তমানের পরিবেশবিনাশী প্রকল্পের পক্ষে যুক্তি হতে পারে? বিশ্বজুড়েই পার্ক-উদ্যানে অবকাঠামো তৈরি করতে হলে তা জনসমক্ষে প্রথমে উপস্থাপন করতে হয়। জনগণ ও পেশাজীবীদের মতামত সাপেক্ষে নকশা চূড়ান্ত করে পরে বাস্তবায়নে যেতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ চর্চার কোনো নজির কোনো সরকারই স্থাপন করেনি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পুরোনো চর্চা থেকে তারা বের হতে পারেনি।
ওসমানী উদ্যানে নতুন স্থাপনার ব্যাপারে পরিবেশকর্মী ও নগর–পরিকল্পনাবিদদের উদ্বেগকে সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের কারণে এরই মধ্যে উদ্যানটি নিজস্ব চরিত্র হারিয়েছে। নতুন স্থাপনা নির্মিত হলে উদ্যানের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব হবে মারাত্মক। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি কেউই অস্বীকার করবে না, কিন্তু সেটা অন্য কোনোখানে হওয়াটাই যৌক্তিক। ঢাকার ফুসফুসকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রকল প সরক র র উদ য ন উদ ব গ ওসম ন
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকার ফুসফুসকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে
একটি শহরকে বাসযোগ্য হতে গেলে যেখানে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ সবুজ অঞ্চল রাখতে হয়, সেখানে ঢাকায় সবুজ অঞ্চল ৭ শতাংশের কম। বৈশ্বিক মানদণ্ডে যেখানে জলাভূমি থাকতে হয় ১২ শতাংশ, সেখানে ঢাকায় তা কমতে কমতে ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে। ঢাকাকে কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত করার এ প্রতিযোগিতায় কারও অবদানই কম নয়। তাপীয় দ্বীপ হয়ে ওঠা ঢাকা বাসযোগ্যতার দিক থেকে এখন বিশ্বের তলানিতে থাকা নগর। ফলে ঢাকায় এখনো নিবু নিবু হয়ে টিকে থাকা সবুজ অঞ্চল বিরান করে ও জলাভূমি ভরাট করে নতুন স্থাপনা নির্মাণ মানেই স্বেচ্ছায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মতো ব্যাপার।
এমন রূঢ় বাস্তবতায় ঢাকার ফুসফুসখ্যাত ওসমানী উদ্যানে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় স্থাপনা নির্মাণের যে প্রকল্প শুরু করেছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে আমরা পারি না। বিগত সরকারের আমলে উন্নয়নের নামে ঢাকার একের পর এক পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠকে যেভাবে কংক্রিটের স্থাপনায় পরিণত করা হয়েছে, সেটা এককথায় রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ও স্বেচ্ছাচারিতার ধ্রুপদি উদাহরণ। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে উন্মুক্ত জনপরিসরকে নাগরিকদের প্রবেশাধিকারও সীমিত করে ফেলা হয়েছে। পরিবেশকর্মী, নগর–পরিকল্পনাবিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগ, সতর্কতা ও পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই একই ধারাবাহিকতা কেন দেখতে হবে? বিগত সরকারের আমলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ করে ওসমানী উদ্যানকে ইতিমধ্যে কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত করা হয়েছে। ২১ দশমিক ৮৫ একরের এ উদ্যানে এখনো নানা প্রজাতির গাছ ও দুটি জলাশয় আছে, যা এ নগরের বিলুপ্তপ্রায় সবুজ অঞ্চল ও জলাভূমির শেষ চিহ্ন। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, পার্ক বা উদ্যানের পুরো আয়তনের ৫ শতাংশ জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে। অথচ ওসমানী উদ্যানে এরই মধ্যে ৫ শতাংশের বেশি আয়তনের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আবার বিধিমালায় ১৬ ফুটের বেশি উঁচু স্থাপনা করা যাবে না বলা হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণের যে প্রকল্প নিয়েছে, সেটার উচ্চতা ৯০ ফুট। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, যে জায়গায় এ স্থাপনা নির্মাণ চলছে, সেটা শিশুদের খেলার জায়গা। এ নগরে সামান্য একটু খেলার জায়গার অভাবে লাখ লাখ শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য যেখানে মারাত্মক ঝুঁকিতে, সেখানে এই উদ্যোগের অর্থ কী?
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা যুক্তি দিয়েছেন, ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিকে স্মরণ করে ঢাকার বড় বড় পার্কে স্থাপনা নির্মাণের নজির আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অতীতে ঢাকার উদ্যান ও পার্কে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদাহরণ কি বর্তমানের পরিবেশবিনাশী প্রকল্পের পক্ষে যুক্তি হতে পারে? বিশ্বজুড়েই পার্ক-উদ্যানে অবকাঠামো তৈরি করতে হলে তা জনসমক্ষে প্রথমে উপস্থাপন করতে হয়। জনগণ ও পেশাজীবীদের মতামত সাপেক্ষে নকশা চূড়ান্ত করে পরে বাস্তবায়নে যেতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ চর্চার কোনো নজির কোনো সরকারই স্থাপন করেনি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পুরোনো চর্চা থেকে তারা বের হতে পারেনি।
ওসমানী উদ্যানে নতুন স্থাপনার ব্যাপারে পরিবেশকর্মী ও নগর–পরিকল্পনাবিদদের উদ্বেগকে সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের কারণে এরই মধ্যে উদ্যানটি নিজস্ব চরিত্র হারিয়েছে। নতুন স্থাপনা নির্মিত হলে উদ্যানের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব হবে মারাত্মক। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি কেউই অস্বীকার করবে না, কিন্তু সেটা অন্য কোনোখানে হওয়াটাই যৌক্তিক। ঢাকার ফুসফুসকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।