একটি শহরকে বাসযোগ্য হতে গেলে যেখানে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ সবুজ অঞ্চল রাখতে হয়, সেখানে ঢাকায় সবুজ অঞ্চল ৭ শতাংশের কম। বৈশ্বিক মানদণ্ডে যেখানে জলাভূমি থাকতে হয় ১২ শতাংশ, সেখানে ঢাকায় তা কমতে কমতে ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে। ঢাকাকে কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত করার এ প্রতিযোগিতায় কারও অবদানই কম নয়। তাপীয় দ্বীপ হয়ে ওঠা ঢাকা বাসযোগ্যতার দিক থেকে এখন বিশ্বের তলানিতে থাকা নগর। ফলে ঢাকায় এখনো নিবু নিবু হয়ে টিকে থাকা সবুজ অঞ্চল বিরান করে ও জলাভূমি ভরাট করে নতুন স্থাপনা নির্মাণ মানেই স্বেচ্ছায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মতো ব্যাপার।

এমন রূঢ় বাস্তবতায় ঢাকার ফুসফুসখ্যাত ওসমানী উদ্যানে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় স্থাপনা নির্মাণের যে প্রকল্প শুরু করেছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে আমরা পারি না। বিগত সরকারের আমলে উন্নয়নের নামে ঢাকার একের পর এক পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠকে যেভাবে কংক্রিটের স্থাপনায় পরিণত করা হয়েছে, সেটা এককথায় রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ও স্বেচ্ছাচারিতার ধ্রুপদি উদাহরণ। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে উন্মুক্ত জনপরিসরকে নাগরিকদের প্রবেশাধিকারও সীমিত করে ফেলা হয়েছে। পরিবেশকর্মী, নগর–পরিকল্পনাবিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগ, সতর্কতা ও পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি।

প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই একই ধারাবাহিকতা কেন দেখতে হবে? বিগত সরকারের আমলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ করে ওসমানী উদ্যানকে ইতিমধ্যে কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত করা হয়েছে। ২১ দশমিক ৮৫ একরের এ উদ্যানে এখনো নানা প্রজাতির গাছ ও দুটি জলাশয় আছে, যা এ নগরের বিলুপ্তপ্রায় সবুজ অঞ্চল ও জলাভূমির শেষ চিহ্ন। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, পার্ক বা উদ্যানের পুরো আয়তনের ৫ শতাংশ জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে। অথচ ওসমানী উদ্যানে এরই মধ্যে ৫ শতাংশের বেশি আয়তনের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আবার বিধিমালায় ১৬ ফুটের বেশি উঁচু স্থাপনা করা যাবে না বলা হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণের যে প্রকল্প নিয়েছে, সেটার উচ্চতা ৯০ ফুট। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, যে জায়গায় এ স্থাপনা নির্মাণ চলছে, সেটা শিশুদের খেলার জায়গা। এ নগরে সামান্য একটু খেলার জায়গার অভাবে লাখ লাখ শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য যেখানে মারাত্মক ঝুঁকিতে, সেখানে এই উদ্যোগের অর্থ কী?

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা যুক্তি দিয়েছেন, ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিকে স্মরণ করে ঢাকার বড় বড় পার্কে স্থাপনা নির্মাণের নজির আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অতীতে ঢাকার উদ্যান ও পার্কে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদাহরণ কি বর্তমানের পরিবেশবিনাশী প্রকল্পের পক্ষে যুক্তি হতে পারে? বিশ্বজুড়েই পার্ক-উদ্যানে অবকাঠামো তৈরি করতে হলে তা জনসমক্ষে প্রথমে উপস্থাপন করতে হয়। জনগণ ও পেশাজীবীদের মতামত সাপেক্ষে নকশা চূড়ান্ত করে পরে বাস্তবায়নে যেতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ চর্চার কোনো নজির কোনো সরকারই স্থাপন করেনি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পুরোনো চর্চা থেকে তারা বের হতে পারেনি।

ওসমানী উদ্যানে নতুন স্থাপনার ব্যাপারে পরিবেশকর্মী ও নগর–পরিকল্পনাবিদদের উদ্বেগকে সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের কারণে এরই মধ্যে উদ্যানটি নিজস্ব চরিত্র হারিয়েছে। নতুন স্থাপনা নির্মিত হলে উদ্যানের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব হবে মারাত্মক। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি কেউই অস্বীকার করবে না, কিন্তু সেটা অন্য কোনোখানে হওয়াটাই যৌক্তিক। ঢাকার ফুসফুসকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প সরক র র উদ য ন উদ ব গ ওসম ন

এছাড়াও পড়ুন:

কুতুবদিয়াবাসী কবে অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে রক্ষা পাবে

‎সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার দেশের ১০টি অনুন্নত উপজেলাকে উন্নত করতে একটা বাজেট রেখেছে। সেই বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। কিন্তু কক্সবাজার জেলার অনুন্নত সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলাকে সেখানে বাদ দেওয়া হয়েছে।

‎কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত কুতুবদিয়া উপজেলাকে বলা হয় বাতিঘরের দ্বীপ। এখানে বসবাস করে দেড় লক্ষাধিক মানুষ। এই দ্বীপের বর্তমান আয়তন ১৮ মাইলের কম। একসময় এর আয়তন ছিল ১০০ বর্গমাইলের বেশি। বর্ষায় বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে নদীভাঙনের কারণে দ্বীপটি এখন অস্তিত্বসংকটের মুখে পতিত হয়েছে। হয়নি কোনো উন্নয়ন।

৩৪ বছরেও কোনো টেকসই বেড়িবাঁধ পায়নি দ্বীপটি। যুগের পর যুগ জিও ব্যাগ দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস ঠেকানো হয়েছে। কিন্তু এই জিও ব্যাগ সমুদ্রের বিশাল ঢেউ আর জোয়ারের ফলে ভেঙে গিয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপ প্লাবিত হয়। যাতায়াতের মাধ্যমে কোনো নিরাপত্তা নেই। নেই ফেরি কিংবা যাত্রীবাহী লঞ্চ। মেডিকেলে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। রাস্তাঘাটের অবস্থা বেহাল।

‎অন্যদিকে পাশেই রয়েছে মাতারবাড়ী ও মহেশখালী। মাতারবাড়ীতে রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। মহেশখালীর সঙ্গে কক্সবাজারে যাতায়াতের জন্য রয়েছে ফেরি। কিন্তু বিপুল খনিজ সম্পদের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়াকে সব সময় অবহেলার চোখে দেখেছেন সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।

‎কুতুবদিয়ায় রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, যা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। রয়েছে গন্ধক ও চুনাপাথর, যা কুতুবদিয়ার ভূপৃষ্ঠের একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান। এ ছাড়া কুতুবদিয়ায় কালোবালির মতো খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়। দ্বীপটি তেল, গ্যাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস হিসেবে পরিচিত, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এ ছাড়া কুতুবদিয়া উপজেলা পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় একটি দ্বীপ। দ্বীপের পশ্চিমে ‘মায়া দ্বীপ’ নামের আরও একটি চর জেগে উঠছে। এই চরটিকে পর্যটনের জন্য পরিকল্পনা করা যেতে পারে। আর এখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বাতিঘর ও বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে সমুদ্রসৈকত, যা উত্তর-দক্ষিণে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রায়।

‎যদি সরকার ও দেশি-বিদেশি ভ্রমণ-সংস্থাগুলো এগিয়ে আসে, তাহলে বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পের জন্য দ্বীপটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

‎আর এখানকার মানুষের প্রধান পেশা সাগর থেকে মাছ আহরণ ও লবণ উৎপাদন করা। এখানকার লবণচাষিরা প্রতিবছর ৫৯০ একর জমিতে ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টনের অধিক লবণ উৎপাদন করে থাকেন, যা দেশে লবণশিল্পের জন্য বিশাল অবদান।

এত কিছু থাকার পরও কুতুবদিয়া নিয়ে কোনো মহাপরিকল্পনা নেই। দ্বীপবাসীরা পায়নি কোনো টেকসই বেড়িবাঁধ। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে নানা ভোগান্তিতে বসবাস করতে হচ্ছে কুতুবদিয়াবাসীকে।

কোনো ইমার্জেন্সি রোগীকে মেডিকেলে নিয়ে গেলে সেখানেও উন্নত চিকিৎসা পাওয়া যায় না। মেডিকেলের কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম মেডিকেলে ইমার্জেন্সি রোগীকে রেফার করে দেন। এরপর রোগীকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার সময় আরেক সিন্ডিকেটের মুখে পড়তে হয়। কুতুবদিয়া-মগনামা চ্যানেলে কোনো ফেরি না থাকায় ডেনিসবোটের মালিকেরা ভাড়া বাড়িয়ে নেন। এভাবেই নানা ভোগান্তি ও সিন্ডিকেটের মধ্য দিয়ে কুতুবদিয়াবাসীকে পারাপার হতে হয় নিত্যদিন।

অন্তর্বর্তী সরকারকে এই দ্বীপ নিয়ে মহাপরিকল্পনা করতে হবে। এই দ্বীপের দেড় লক্ষাধিক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য টেকসই বেড়িবাঁধ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কুতুবদিয়া-মগনামা চ্যানেলে ফেরি চালুর মধ্য দিয়ে যাতায়াতব্যবস্থায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

‎এ ছাড়া উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে কুতুবদিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অক্সিজেন, অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম দিতে হবে। রাস্তাঘাট সংস্কার করতে হবে। তবেই কুতুবদিয়াবাসী অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে রক্ষা পাবে।

আবদুল্লাহ নাজিম আল মামুন

‎কুতুবদিয়া দ্বীপ, কক্সবাজার

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কুতুবদিয়াবাসী কবে অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে রক্ষা পাবে