প্রাথমিক শিক্ষা শুধু একটি স্তর নয়, এটি সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি। এই ভিত্তি যত মজবুত হবে, তার ওপর দাঁড়িয়ে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা তত বেশি শক্তিশালী হবে। পরিণতিতে যা আমাদের ভবিষ্যৎ জাতি গঠনে সহায়ক হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের এই ভিত্তিই এখন নড়বড়ে। প্রাথমিক শিক্ষায় ক্রমর্বধমান বৈষম্য, শিক্ষক–সংকট, ঝরে পড়া, নানা ধরনের বিদ্যালয়ের মধ্যে মানের পার্থক্য—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে গভীর এক সংকট। এর প্রভাব কেবল শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান, দক্ষতা ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও পড়ছে।

আমরা এখনো প্রাথমিক শিক্ষায় সমতাভিত্তিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারিনি। করোনার ধাক্কায় একসময় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গিয়েছিল, এখন কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয় একটিও বাড়েনি, বেড়েছে কেবল বেসরকারিভাবে পরিচালিত নানা ধরনের বিদ্যালয়। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় বহুমুখী সংকট এবং বেসরকারি শিক্ষার অনভিপ্রেত বিস্তার—এই দ্বৈত বাস্তবতা আমাদের শিক্ষাবৈষম্যকে আরও গভীর করে তুলেছে। যেসব পরিবার সচ্ছল, তারা শিশুদের শহরে-বন্দরে বেসরকারি ভালো বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে। কিন্তু দরিদ্র, প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার শিশুরা সরকারি বিদ্যালয়ে সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়েই পড়াশোনা করছে।

শিক্ষার্থীর সংখ্যায়ও একধরনের ওঠানামা দেখা গেছে। ২০২০ সালে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ। ২০২৩ সালে তা নেমে আসে ২ কোটির নিচে, ২০২৪ সালে কিছুটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ১ লাখ ৮৩ হাজারে। এই সামান্য বৃদ্ধিও কোনো আশাবাদী বার্তা দেয় না। কারণ, গুণগত মান ও ধারাবাহিকতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাচ্ছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ঝরে পড়ার হার। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কমলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশে (সূত্র: বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি)। ছেলেদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি—১৯ শতাংশের কাছাকাছি; অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন ছেলের একজন প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারছে না। ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট বিভাগে ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি; বিশেষ করে নেত্রকোনায়, সেখানে এই হার ৪৪ শতাংশ! এটি কোনো সংখ্যার খেলা নয়—এটি হাজারো শিশুর এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ার গল্প।

শিশুদের কেন ধরে রাখা যাচ্ছে না? 

আমাদের অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে, কেন শিশুদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখা যাচ্ছে না? প্রথমত, শিক্ষকের সংকট ভয়াবহ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো ৩৪ হাজারের বেশি প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য; সাড়ে ২৪ হাজার সহকারী শিক্ষকের পদও খালি। অনেক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককেই ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। শিক্ষক যদি ক্লান্ত, অপ্রস্তুত ও অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে শিশুদের শেখার আগ্রহও ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও পরিবেশে বৈষম্য। শহরের বিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভালো ভবন ও সুযোগ-সুবিধা থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়ে এখনো বিদ্যুৎ, টয়লেট কিংবা নিরাপদ পানির ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য এসব মৌলিক সুবিধার অভাব প্রাথমিক পর্যায়েই ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। সঙ্গে দারিদ্র্য তো আছেই।

প্রাথমিক শিক্ষা একটি জাতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ, যা আমাদের ভবিষ্যৎ জাতি গঠনে সহায়ক.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

প্রাথমিক শিক্ষায় বৈষম্য আমাদের ভবিষ্যৎকেই ঝুঁকিতে ফেলবে

প্রাথমিক শিক্ষা শুধু একটি স্তর নয়, এটি সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি। এই ভিত্তি যত মজবুত হবে, তার ওপর দাঁড়িয়ে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা তত বেশি শক্তিশালী হবে। পরিণতিতে যা আমাদের ভবিষ্যৎ জাতি গঠনে সহায়ক হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের এই ভিত্তিই এখন নড়বড়ে। প্রাথমিক শিক্ষায় ক্রমর্বধমান বৈষম্য, শিক্ষক–সংকট, ঝরে পড়া, নানা ধরনের বিদ্যালয়ের মধ্যে মানের পার্থক্য—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে গভীর এক সংকট। এর প্রভাব কেবল শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান, দক্ষতা ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও পড়ছে।

আমরা এখনো প্রাথমিক শিক্ষায় সমতাভিত্তিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারিনি। করোনার ধাক্কায় একসময় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গিয়েছিল, এখন কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয় একটিও বাড়েনি, বেড়েছে কেবল বেসরকারিভাবে পরিচালিত নানা ধরনের বিদ্যালয়। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় বহুমুখী সংকট এবং বেসরকারি শিক্ষার অনভিপ্রেত বিস্তার—এই দ্বৈত বাস্তবতা আমাদের শিক্ষাবৈষম্যকে আরও গভীর করে তুলেছে। যেসব পরিবার সচ্ছল, তারা শিশুদের শহরে-বন্দরে বেসরকারি ভালো বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে। কিন্তু দরিদ্র, প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার শিশুরা সরকারি বিদ্যালয়ে সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়েই পড়াশোনা করছে।

শিক্ষার্থীর সংখ্যায়ও একধরনের ওঠানামা দেখা গেছে। ২০২০ সালে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ। ২০২৩ সালে তা নেমে আসে ২ কোটির নিচে, ২০২৪ সালে কিছুটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ১ লাখ ৮৩ হাজারে। এই সামান্য বৃদ্ধিও কোনো আশাবাদী বার্তা দেয় না। কারণ, গুণগত মান ও ধারাবাহিকতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাচ্ছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ঝরে পড়ার হার। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কমলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশে (সূত্র: বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি)। ছেলেদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি—১৯ শতাংশের কাছাকাছি; অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন ছেলের একজন প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারছে না। ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট বিভাগে ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি; বিশেষ করে নেত্রকোনায়, সেখানে এই হার ৪৪ শতাংশ! এটি কোনো সংখ্যার খেলা নয়—এটি হাজারো শিশুর এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ার গল্প।

শিশুদের কেন ধরে রাখা যাচ্ছে না? 

আমাদের অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে, কেন শিশুদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখা যাচ্ছে না? প্রথমত, শিক্ষকের সংকট ভয়াবহ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো ৩৪ হাজারের বেশি প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য; সাড়ে ২৪ হাজার সহকারী শিক্ষকের পদও খালি। অনেক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককেই ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। শিক্ষক যদি ক্লান্ত, অপ্রস্তুত ও অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে শিশুদের শেখার আগ্রহও ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও পরিবেশে বৈষম্য। শহরের বিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভালো ভবন ও সুযোগ-সুবিধা থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়ে এখনো বিদ্যুৎ, টয়লেট কিংবা নিরাপদ পানির ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য এসব মৌলিক সুবিধার অভাব প্রাথমিক পর্যায়েই ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। সঙ্গে দারিদ্র্য তো আছেই।

প্রাথমিক শিক্ষা একটি জাতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ, যা আমাদের ভবিষ্যৎ জাতি গঠনে সহায়ক

সম্পর্কিত নিবন্ধ