এক জাপানি গবেষক, লালন–ভক্ত মাসাহিকো তোগাওয়া। বারবার বাংলাদেশে এসেছেন লালন ফকিরের টানে। ছুটে গেছেন বারবার কুষ্টিয়ার আখড়ায়। লালন শাহের মাজার ঘেঁষে কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা ও বাস্তব কাজ তাঁকে আহত করেছে। বিস্তর বাদ-প্রতিবাদের পর সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী সেই নির্মাণকাজ বন্ধের ঘোষণা দিলেন। কিন্তু মাসাহিকো গত ২৬ নভেম্বর আখড়া ঘুরে এসে প্রথম আলোকে জানালেন, প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর নিজেই আমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন নিচের নিবন্ধটি। ওপরে প্রকাশিত ছবিটিও ২৬ নভেম্বর তাঁরই তোলা।

জাপানের সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ হিসেবে বাউল সংগীতের ওপর গবেষণামূলক কাজের প্রয়োজনে বেশ কয়েকবারই আমি বাংলাদেশ সফর করেছি। এখানে এসেই ফকির লালন শাহের গান শুনে, তাঁর মাজারের কাছে গিয়ে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। তাঁর প্রতি জন্মেছে আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। লালন শাহের শিক্ষা থেকে আমি অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি। আমি তাঁর সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে কুষ্টিয়ার এক গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছি। লালন শাহের সংগীতের মায়াজালে আবদ্ধ হয়েই জাপানে বসে আমি রচনা করেছি বেশ কয়েকটি নিবন্ধ।

যে কেউই লালন শাহের কর্মকাণ্ডের সান্নিধ্যে এলেই তাঁর কবিতা, গান এবং ধর্মীয় চিন্তাচেতনায় বিস্মিত হবেন। বেশির ভাগ জাপানি মনে করেন, বাংলাদেশ হচ্ছে একটি দরিদ্র দেশ। যেখানে সব সময়ই লেগে থাকে বন্যা আর দুর্ভিক্ষ। সেতু এবং সড়ক নির্মাণে বিদেশি সাহায্য ছাড়া বুঝি গত্যন্তর নেই। কিন্তু আমার বন্ধুরাই লালনের কবিতা পড়ে বিস্মিত হয়েছেন। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির প্রতি তাঁদের জন্মেছে অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ।

আমি গত ২১ আগস্ট পরিদর্শন করেছি সেই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের মাজার। কুষ্টিয়ার সেই মাজারের পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে আমি ব্যথিত না হয়ে পারিনি। বাউল সংগীতের পথিকৃতের মাজার কত অবহেলিত! মাজারের পার্শ্ববর্তী দেয়াল ধ্বংসের পথে। আর অসংখ্য ট্রাক বিকট আওয়াজে মাজারের পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। মাজারের আশপাশেই চলছে কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের কাজ। সেখানকার বাউল ও ফকিরদের পক্ষে এ বেদনাদায়ক নির্মাণ দেখে যাওয়া ছাড়া কিছুই যেন আর করার নেই! কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় ফিরে যথাসম্ভব অনেককেই নিজের যন্ত্রণার কথা জানিয়েছি।

লালন কমপেক্সের পরিকল্পনাকারীরা আমাকে জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞ এবং বিদেশি পর্যটকদের সুবিধার জন্যই এখানে ভবন নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু আমি লালন শাহের ভালোবাসায় সিক্ত একজন ভক্ত। বেশ অনেকবার মাজার ঘুরে আসা সত্ত্বেও কংক্রিটের সুদৃশ্য ভবনে থাকার একবারও প্রয়োজন পড়েনি আমার।মাসাহিকো তোগাওয়া

চলতি মাসে আবারও আমাকে বাংলাদেশে আসতে হলো। গত ২৬ নভেম্বর লালনের মাজারেও আমি গেলাম। কিন্তু সেখানে বিস্মিত হয়ে দেখলাম, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও মাজারের গা ঘেঁষে কমপেক্সের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়নি।

লালন কমপেক্সের পরিকল্পনাকারীরা আমাকে জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞ এবং বিদেশি পর্যটকদের সুবিধার জন্যই এখানে ভবন নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু আমি লালন শাহের ভালোবাসায় সিক্ত একজন ভক্ত। বেশ অনেকবার মাজার ঘুরে আসা সত্ত্বেও কংক্রিটের সুদৃশ্য ভবনে থাকার একবারও প্রয়োজন পড়েনি আমার। মাজারের পাশে আমার দীক্ষাগুরু বাউলের বাড়িতেই আমি থাকি। মাটির ঘরের বারান্দায় বসে সাধারণ খাবার খাই। আমার গুরুর ছোট্ট কন্যা আমিনার কণ্ঠে লালন শাহের গান শুনি। একতারা বাজিয়ে আমি তাকে সঙ্গ দিই। মাটির ঘরের পরিবেশে যে সংগীত আমি উপভোগ করি, বিশাল মিলনায়তনে তা কখনোই উপভোগ্য হতো না।

লালনের মাজারের সেই পুরোনো চিরপরিচিত স্নিগ্ধ পরিবেশ আমি ফিরে চাই। সেখানেই আমি বারবার শুনতে চাই—

কেমন ন্যায় বিচারক খোদা
বল গো আমায়।
তাহা হলে ধনী-গরিব
কেন এ ভুবনে রয় \
ভালো-মন্দ সমান হলে
আমরা কেন পড়ি তলে
কেউ দালান কোঠার কোলে
শুয়ে আরাম পায় \
সেই আমরা মরণের পরে
যাব নাকি স্বর্গপুরে
কে মানিবে এসব হেরে
এই দুনিয়ার \
ভোগ করে ত্যাগ ভালো কথা
এ সংসারে কে করে তা
লালন বলে নাড়ি মাথা
আন্দাজে সবায় \

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

আসিম মুনির: পাকিস্তানের নতুন ‘সুলতান’

প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি কিংবা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নন, পাকিস্তানে এই সময়ে সবচেয়ে বড় ‘ভিআইপি’র নাম ফিল্ড মার্শাল সৈয়দ আসিম মুনির আহমেদ শাহ। ৫৭ বছর বয়সী ‘হাফেজে কোরআন’ এই সেনা কর্মকর্তা চার তারকা জেনারেল থেকে পাঁচ তারকা ফিল্ড মার্শাল, সেনাপ্রধান থেকে ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ বা (সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান) হয়েছেন। ধাপে ধাপে উঠে এখন তিনি পাকিস্তানের সংবিধানের ২৭তম সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত আইনের ঊর্ধ্বে থাকা একজন ব্যক্তি।

আসিম মুনির একই সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘প্রিয় বন্ধু’, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘আয়রন ব্রাদার’। উল্টো দিকে ভারতের মতে, ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ এবং আফগান তালেবানের দৃষ্টিতে ‘এক নম্বর শত্রু’।

বর্তমানে পাকিস্তানের সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, পারমাণবিক কমান্ড—সবই আসিম মুনিরের হাতে। সব মিলিয়ে নতুন একধরনের সামরিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছেন আসিম মুনির, যাকে অনেকেই বলছেন ‘মুনিরবাদ’।

যে পথে তিনি এলেন

১৯৬৮ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে আসিম মুনিরের জন্ম। তাঁর পরিবার ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর পাঞ্জাবের জলন্ধর থেকে পাকিস্তানে আসে। প্রথমে তারা টোবা টেক সিংয়ে বসবাস করে, পরে রাওয়ালপিন্ডির ধেরি হাসানাবাদে স্থায়ী হয়।

ছোটবেলায় আসিম মুনির গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, যেখানে জীবন ছিল সহজ কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ। স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ছিল দারুণ আকর্ষণ। ফাস্ট বোলিংয়ে তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়, যা তাঁর শারীরিক সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের পরিচয় দেয়। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল তীব্র।

আসিম মুনিরের বাবা সৈয়দ সরওয়ার মুনির ছিলেন রাওয়ালপিন্ডির এফজি টেকনিক্যাল হাইস্কুলের প্রিন্সিপাল এবং একজন ইমাম। তাঁর বাবার ধর্মীয় ও শিক্ষকতার ভূমিকা পরিবারে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নৈতিক পরিবেশ তৈরি করে। মা সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। সৈয়দ বংশের এই পরিবারে ইসলামি মূল্যবোধ ছিল গভীরভাবে প্রোথিত।

আসিম মুনিরের স্ত্রী সৈয়দা ইরুম আসিম এবং তাঁদের তিন সন্তান রয়েছেন। তাঁরা রাওয়ালপিন্ডিতে থাকেন। তবে তাঁদের জীবন প্রকাশ্যে আসে না। এ বছরের আগস্টে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়েছিল; কিন্তু এর সত্যতা যাচাই করা যায়নি।

আসিম মুনির প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির মারকাজ মাদ্রাসা দারুল তাওহিদে ধর্মীয় পরিবেশে। পরবর্তী সময়ে তিনি অ্যাবোটাবাদের পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

শৈশবেই পুরো পবিত্র কোরআন মুখস্থ করা মুনিরের ব্যক্তিগত পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

মঙ্গলা মিলিটারি কলেজে পড়ার সময় আসিম মুনির হিফজ সম্পন্ন করেন। আইএসপিআর ও অফিশিয়াল জীবনীতে এটি বিশেষভাবে উল্লেখিত। ফিল্ড মার্শাল হওয়ার পর পাকিস্তানের মূলধারা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই পরিচয় আরও জোরালোভাবে উপস্থিত হয়েছে। আসিম মুনির সামরিক একাডেমিতে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ‘সোর্ড অব অনার’ লাভ করেন।

ভারতের সঙ্গে সংঘাতের সময় সেনাদের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন আসিম মুনির: ১ মে ২০২৫, মঙ্গলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হাসলে কি অজু ভেঙে যায়
  • সৌদি আরবে শান্তি আলোচনায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তান
  • অবকাঠামো বৈষম্য ও প্রবেশাধিকার সমতা 
  • ইচ্ছা না থাকলেও ১৫ বছর পর যে টুর্নামেন্টে খেলবেন কোহলি
  • সব খাবারে কি কারও অ্যালার্জি হতে পারে?
  • আসিম মুনির: পাকিস্তানের নতুন ‘সুলতান’
  • দ্বিতীয় দিনে সেন্ট মার্টিন গেলেন আরও ১ হাজার ১৯৪ পর্যটক
  • নীল জলের সেন্ট মার্টিন দেখে মুগ্ধ হাজারো পর্যটক, পরিবেশ রক্ষার তাগিদ
  • ট্রাভেল পাস ছাড়া টিকিট বিক্রি, সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা
  • ট্রাভেল পাস ছাড়া সেন্টমার্টিনের টিকিট বিক্রি: কেয়ারি সিন্দাবাদকে জরিমানা