আরপিও সংশোধনীতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ কতটা বাস্তবায়িত হলো
Published: 9th, November 2025 GMT
একাত্তরে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একটি নির্বাচনের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে কিছু নির্বাচন ছিল একতরফা ও বিতর্কিত, যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে দলীয় কিংবা সামরিক সরকারের অধীনে। ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে বিগত তিনটি নির্বাচনে জনগণ প্রকৃত অর্থে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর ও জবাবদিহির কাঠামো ভেঙে পড়ে। তাই রাজনীতি ও নির্বাচনী অঙ্গন পরিচ্ছন্ন করা এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান আবশ্যক হয়ে পড়েছিল।
ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয় যে, কতগুলো মৌলিক আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার দীর্ঘদিনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসবে, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে একটি শোষণ ও বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। জনগণের এ আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.
কমিশন গঠিত হওয়ার পর এই কমিশনের ওপর অর্পিত হয় বাংলাদেশের আইনি কাঠামো ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নানাবিধ সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করে অন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে একগুচ্ছ সুপারিশ প্রণয়ন করা, যা বাংলাদেশকে পুনরায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে ফিরিয়ে আনবে এবং একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত রচনা করবে।
যে আস্থার ভিত্তিতে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, সেই আস্থার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সংলাপ এবং কঠোর পরিশ্রম ও এ ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কমিশনের সদস্যগণ একগুচ্ছ যুগোপযোগী সুপারিশ প্রণয়ন করেন, যার মধ্যে রয়েছে কতগুলো আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার। এসব সুপারিশের লক্ষ্য হলো, এগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচনি ও রাজনৈতিক অঙ্গন দুর্বৃত্তমুক্ত করা, টাকার খেলা বন্ধ করা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও দায়বদ্ধ করা, সংশ্লিষ্ট সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করা, বিশেষ করে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা।
এরপর ৩ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে ‘প্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আরপিও’র যেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে তা হলো:
অনুচ্ছেদ-২: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী অন্তর্ভুক্ত। (২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমন বিধান ছিল)
অনুচ্ছেদ-৮: ভোটকেন্দ্রের তালিকা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা প্রস্তুত করবেন এবং কমিশনের অনুমোদন নেবেন।
অনুচ্ছেদ-৯: রিটার্নিং কর্মকর্তা কোনো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করলে নির্বাচন কমিশনকে তা জানাতে হবে।
অনুচ্ছেদ-১২: আদালত কর্তৃক ফেরারি বা পলাতক আসামি ঘোষিত কেউ সংসদ সদস্য হতে পারবেন না; কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিসহ লাভজনক পদে থাকলে প্রার্থী হওয়া যাবে না; হলফনামায় আয়, সম্পদ ও কর-রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক; এবং অসত্য তথ্য দিলে ভোটের পরও ইসি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
অনুচ্ছেদ-১৩: মনোনয়নপত্রের জামানত ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-১৪: রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হলে প্রার্থী ছাড়াও ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সেবাদাতা সংস্থা আপিল করতে পারবে।
অনুচ্ছেদ-১৯: ‘না ভোট’ ফিরেছে। কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ব্যালটে ‘না ভোট’ থাকবে, তবে পুনঃনির্বাচনে এ বিধান থাকবে না।
অনুচ্ছেদ-২০: জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলেও প্রতিটি দল নিজ নিজ প্রতীকে ভোট করবে।
অনুচ্ছেদ-২১: নির্বাচনী এজেন্ট অবশ্যই সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হতে হবে।
অনুচ্ছেদ-২৫: প্রিজাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-২৬: বিতর্কিত ও ব্যয়বহুল ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিধান বাতিল।
অনুচ্ছেদ-২৭: আইটি-সমর্থিত পোস্টাল ভোটিং চালু। প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী ও আটক ভোটাররাও ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন।
অনুচ্ছেদ-২৯ ও ৩৬: গণমাধ্যমকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ ও গণনার সময় উপস্থিত থাকতে পারবেন।
অনুচ্ছেদ-৩৭: প্রিজাইডিং কর্মকর্তা প্রয়োজনে বাতিল ভোট পুনর্গণনা করতে পারবেন।
অনুচ্ছেদ-৩৮: সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দু’জন প্রার্থী সমান ভোট পেলে লটারির পরিবর্তে ওই আসনে পুনরায় ভোট হবে।
অনুচ্ছেদ-৪৪: প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ১০ টাকা নির্ধারণ; রাজনৈতিক দলের ব্যয়ের হিসাব দলের ওয়েবসাইটে প্রকাশ বাধ্যতামূলক; নির্বাচন কর্মকর্তাদের বদলিতে উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শকের অংশগ্রহণ যুক্ত করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-৭৩: মিথ্যা তথ্য, গুজব, অপতথ্য ও এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) অপব্যবহারকে নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে সংযোজন।
অনুচ্ছেদ-৭৪, ৮১, ৮৭ ও ৮৯: এসব অনুচ্ছেদে ছোটখাট পরিমার্জন আনা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-৯০: রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, অনুদান গ্রহণ ও নিবন্ধন স্থগিত হলে প্রতীক স্থগিতের বিধান।
অনুচ্ছেদ-৯১: নির্বাচনি অনিয়মে কেন্দ্রের পাশাপাশি পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের দণ্ডের পাশাপাশি সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। দলের ক্ষেত্রেও জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের পাশাপাশি ইসির ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও ব্যবস্থা নিতে পারবেন- এমন বিধান রাখা হয়েছে। হলফনামায় অসত্য তথ্যে যাচাই ও ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে।
কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, উক্ত আরপিও অধ্যাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। নিচে যেসব সুপারিশ আরপিওতে যুক্ত হয়নি সেগুলো সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এবং এ ক্ষেত্রে যা করা যেত কিংবা করা যেতে পারে সে সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:
এক.
সুপারিশ: ২০২৩ সালে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিবন্ধন দেওয়া রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা।
মন্তব্য: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যাতে একতরফা না হয়, সেজন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। এসব দলের প্রতীক ব্যবহার করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবে।
করণীয়: রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত আরপিও’র ৯০(ক) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনকে তদন্তসাপেক্ষে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতা প্রদান করা আবশ্যক, যাতে এই ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন এ সকল দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে।
দুই.
সুপারিশ: নতুন দল নিবন্ধনের শর্ত শিথিলের লক্ষ্যে ১০% জেলা এবং ৫% উপজেলা/থানায় দলের অফিস এবং ন্যূনতম ৫ হাজার সদস্য থাকার বিধান করা।
মন্তব্য: রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করার ব্যাপক সঙ্গত দাবি রয়েছে।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
তিন.
সুপারিশ: দলের সাধারণ সদস্যদের তালিকা প্রস্তুত করে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এবং উক্ত তালিকা প্রতিবছর একবার হালনাগাদ করা।
মন্তব্য: রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত এই সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
চার.
সুপারিশ: আরপিও’র ১২ ধারা অনুয়ায়ী সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য ব্যক্তিদের কোনো নিবন্ধিত দলের সাধারণ সদস্য/কমিটির সদস্য হওয়ার অযোগ্য করা।
মন্তব্য: আমাদের নির্বাচনী ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করতে হলে বিতর্কিত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ থেকে দূরে রাখার কোনো বিকল্প নেই।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
চার.
সুপারিশ: দলের সাধারণ সদস্যদের গোপন ভোটে দলের স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সকল কমিটির সদস্যদের নির্বাচিত করা।
মন্তব্য: রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণের জন্য আমাদের প্রস্তাবিত এই সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
পাঁচ.
সুপারিশ: দলের সাধারণ সদস্যদের গোপন ভোটে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকা থেকে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তিনজনের একটি প্যানেল তৈরি করা, যা থেকে দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড কর্তৃক দলীয় মনোনয়ন প্রদানের বিধান করা।
মন্তব্য: বর্তমানে আরপিওতে দলীয় সদস্যগণ কর্তৃক প্রস্তুত প্যানেল শুধু বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় সংসদীয় বোর্ডের মনোনয়ন চূড়ান্ত করার কথা বলা আছে। ফলে রাজনৈতিক দলের পক্ষে যে কোনো ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব, যা বাস্তবে ঘটেছেও।
করণীয়: দলের সদস্যদের গোপন ভোটে তৈরি তিনজনের প্যানেল থেকে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড কর্তৃক দলীয় মনোনয়ন দিতে বাধ্য হলে সদস্যদের প্রতি দলের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধের পথ সুগম হবে।
ছয়.
সুপারিশ: দলের সদস্যদের চাঁদা ন্যূনতম ১০০ টাকা ও কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে অনুদান হিসেবে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা নেওয়ার বিধান করা। এ অনুদান ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে গ্রহণের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ট্যাক্স রিটার্নে প্রদর্শনের বিধান করা।
মন্তব্য: নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক দলের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। এই সুপারিশটি আংশিকভাবে আরপিও অধ্যাদেশে রয়েছে।
করণীয়: অনুদান গ্রহণের তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ট্যাক্স রিটার্নে প্রদর্শনের বিধান অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
সাত.
সুপারিশ: দলের তহবিল ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে বিদ্যমান ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিবন্ধিত দল কর্তৃক বাৎসরিকভাবে দাখিলকৃত অডিটেড আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ ও নির্বাচন কমিশনে দাখিলের বিধান করা এবং কমিশনকে এগুলো অডিট করার ক্ষমতা প্রদান করা।
মন্তব্য: নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক দলের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
আট.
সুপারিশ: নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর আওতাভুক্ত করা।
মন্তব্য: দলের স্বচ্ছতা, বিশেষত আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য এটির বিকল্প নেই।
করণীয়: এটি আরপিও বা তথ্য অধিকার আইনে রাজনৈতিক দলকে ‘কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা আবশ্যক ছিল।
নয়.
সুপারিশ: দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন, ভ্রাতৃপ্রতীম বা যে কোনো নামেই হোক না কেন, না থাকার বিধান করা।
মন্তব্য: বর্তমানে আরপিও’র ৯০(খ)(১)(খ)(ই) অনুচ্ছেদে নিবন্ধিত দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন না থাকার বিধান রয়েছে। তা সত্ত্বেও দলগুলো ভাতৃপ্রতীম সংগঠন বলে এগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
করণীয়: এই বিধানের প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক, যাতে রাজনৈতিক দলের ভাতৃপ্রতীম বা অন্য কোনো নামে লেজুড়বৃত্তির ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন না থাকে।
দশ.
সুপারিশ: দলের, যে কোনো নামেই হোক না কেন, বিদেশি শাখা না থাকার বিধান করা।
মন্তব্য: বর্তমানে আরপিও’র ৯০(গ)(১)(ঙ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের অযোগ্য হবে যদি বিদেশে অফিস, শাখা, বা কমিটি গঠন ও পরিচালনার বিধান তাদের দলের গঠনতন্ত্রে থাকে। কিন্তু দলগুলোর গঠনতন্ত্র থেকে এই বিধান বিলুপ্ত করা হলেও কিছু দলের বিদেশি শাখা রয়েছে এবং তাদের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
করণীয়: এই বিধানের ভাষা পরিবর্তনের মাধ্যমে (যেমন, দলের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে) নিবন্ধিত দলের বিদেশি অফিস, শাখা ও কমিটি বিলুপ্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক।
এগারো.
সুপারিশ: মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের তিন বছরের সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক করার বিধান পুনরায় সংযোজন করা।
মন্তব্য: এই বিধান আগে আরপিওতে ছিল। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যাকে ইচ্ছা তাকে মনোনয়ন দিতে পারত না।
করণীয়: নির্বাচনকে সামনে রেখে দলবদলের প্রবণতা বন্ধ করতে এবং মনোনয়ন বাণিজ্য রোধ করতে এটি আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
বারো.
সুপারিশ: জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, ফলাফল গেজেটে প্রকাশের (ক) পূর্বে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ‘সার্টিফাই’ করে তা গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের বিধান করা
মন্তব্য: একটি গণতান্ত্রিক দেশে কেউই দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। এই লক্ষ্যে আমরা কতগুলো ‘গার্ড রেইল’ তৈরির সুপারিশ করেছি, যাতে নির্বাচন কমিশন অতীতের ন্যায় কোনোরূপ প্রহসনমূলক ও জালিয়াতির নির্বাচন আয়োজন না করতে পারে
করণীয়: নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য এটি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
তেরো.
সুপারিশ: নির্বাচন কমিশনের আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রস্তাব কোনো মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের (যদি না হয়, তাহলে বিদ্যমান সংসদের অনুরূপ) স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির নিকট উপস্থাপনের বিধান করা। (সংসদীয় কমিটি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রস্তাবগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করবে।)
মন্তব্য: নির্বাচন কমিশনের আর্থিক দায়বদ্ধতার অভাবে নির্বাচনী ব্যয় ক্রমান্বয়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। যেমন, দশম জাতীয় সংসদে নির্বাচনী ব্যয় ছিল ৩৩৩ কোটি টাকা যা, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বেড়ে হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৯০০ কেটি টাকা। তাই নির্বাচনী ব্যয়ের লাগাম টানা আবশ্যক।
করণীয়: কমিশনের আর্থিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের জন্য এই বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক ছিল।
চৌদ্দ.
সুপারিশ: নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকালে কমিশনারদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে তা সংবিধানের ১১৮ ও ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে সুরাহা করার বিদ্যমান বিধান কার্যকর করা।
করণীয়: একটি গণতান্ত্রিক দেশে কেউই দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। তাই এটি কার্যকর করা আবশ্যক।
পনের.
সুপারিশ: সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথ ভঙ্গ করলে কমিশনারদের মেয়াদ পরবর্তী সময়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে সুপারিশসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের বিধান করা।
মন্তব্য: নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে এটি ‘গার্ড রেইল’ হিসেবে কাজ করব্যে।
করণীয়: নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের জন্য এগুলো আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক ছিল।
ষোল.
সুপারিশ: আরপিও’র ৯০(ক) ধারা সংশোধনপূর্বক নির্বাচনি অপরাধের মামলা দায়েরের সময়সীমা রহিত করা।
করণীয়: নির্বাচন দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতে নির্বাচনী অপরাধের মামলা দায়েরের সময়সীমা রহিত করা আবশ্যক।
সতের.
সুপারিশ: ক. সকল নির্বাচনি ব্যয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা বা আর্থিক প্রযুক্তির (যেমন, বিকাশ, রকেট) মাধ্যমে পরিচালনা করা; খ. নির্বাচনি ব্যয়ের অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এক বা একাধিক নির্বাচনি আসনের জন্য ‘নির্বাচনি ব্যয় মনিটরিং কমিটি’ গঠন এবং নির্বাচনি ব্যয় নিবিড়ভাবে নজরদারি করা; গ. নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থী এবং দলের নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্নের নিরীক্ষা করা এবং হিসাবে অসঙ্গতির জন্য নির্বাচন বাতিলের বিধান করা।
মন্তব্য: বর্তমানে সব প্রার্থীই নির্বাচনী ব্যয়ের সঠিক তথ্য প্রদান করেন না। এমনকি অনেকে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেন না, যা করা বাধ্যতামূলক। এ সম্পর্কিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সংশোধিত আরপিও অধ্যাদেশে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয়েছে।
করণীয়: নির্বাচনে ‘টাকার খেলা’ বন্ধ করতে হলে নির্বাচনী ব্যয়ের প্রদত্ত হিসাব কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে এবং একইসঙ্গে এগুলো পদ্ধতিগতভাবে মনিটরিং করতে হবে।
আঠারো.
সুপারিশ: ক. হলফনামার ছকে দেশি-বিদেশি সম্পত্তিসহ আয়কর রিটার্নের কপি সংযোজনের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা এবং হলফনামার তথ্য ব্যাপকভাবে প্রচার করা, যাতে ভোটাররা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন; খ. হলফনামায় ও আয়কর বিবরণীতে তথ্য গোপন করলে বা ভুল তথ্য দিলে মনোনয়নপত্র/নির্বাচন বাতিল করা; গ. প্রার্থী কর্তৃক দাখিল করা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রত্যেক দলের পক্ষ থেকে তার প্রার্থীদের জন্য প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্রের পরিবর্তে দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বা অনুরূপ পদধারী ব্যক্তি কর্তৃক হলফনামা জমা দেওয়ার বিধান করা, যাতে তাদের দলীয় মনোনীত প্রার্থীর নামের পাশাপাশি মনোনয়ন বাণিজ্য না হয় ও দলীয় প্যানেল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন প্রদানের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে; ঘ. পরবর্তী নির্বাচনের আগে যে কোনো সময় নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচিত ব্যক্তির হলফনামা যাচাই-বাছাই করার এবং হলফনামায় মিথ্যা তথ্য বা তথ্য গোপনের প্রমাণ পেলে তার নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা প্রদানের বিধান করা; ঙ. হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কিংবা তথ্য গোপনের কারণে আদালত কর্তৃক কোনো নির্বাচিত ব্যক্তির নির্বাচন বাতিল করা হলে ভবিষ্যতে তাঁকে নির্বাচনে অযোগ্য করার বিধান করা।
মন্তব্য: হলফনামা এবং দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়নি- এ ধরনের ঘোষণা আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি নির্বাচনের পরে বাধ্যতামূলকভাবে হলফনামা যাচাই-বাছাইয়ের বিধান।
করণীয়: হলফনামায় ৮ ধরনের তথ্য প্রদান এবং এগুলো নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রচার ও প্রকাশের আদালত কর্তৃক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো, প্রার্থী সম্পর্কে তথ্য দিয়ে জনগণকে ক্ষমতায়িত করা, যা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকের বাক্-স্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাই করা দরকার, যাতে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। একইসঙ্গে হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ নির্বাচিত হয়েছে প্রমাণিত হলে তাকে ভবিষ্যতের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া অযোগ্য ঘোষণার বিধান করা আবশ্যক।
উনিশ.
সুপারিশ: অভ্যাসগত ঋণখেলাপি ও বিল খেলাপিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা। বিশেষত ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে তাদের তামাদি ঋণ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ছয় মাস আগে পরিপূর্ণভাবে শোধ করার বিধান করা। নির্বাচনের পরে যারা আবার ঋণখেলাপি হয়েছেন তাদেরকে সংসদ সদস্য পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণার বিধান করা।
মন্তব্য: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ঋণখেলাপিদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে উপরোক্ত প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু আরপিওতে এ ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
করণীয়: ঋণখেলাপিদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে আমাদের প্রস্তাবটি আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
বিশ.
সুপারিশ: ১৯৯০ সালের তিনজোটের রূপরেখার মতো রাজনৈতিক দলের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন করা।
মন্তব্য: নব্বইয়ের তিনজোটের রূপরেখা রাজনৈতিক দলগুলো প্রণয়ন ও অনুসরণ করেছিল। তাই ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন ছিল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। আমরা জানি না নির্বাচন কমিশন কী ধরনের আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে।
করণীয়: নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তিনজোটের রূপরেখায় অন্তর্ভুক্ত আচরণবিধির মতো একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করা আবশ্যক।
একুশ.
সুপারিশ: বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বন্ধ, রাজনৈতিক দলগুলোকে সৎ, যোগ্য এবং ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেওয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনে ‘না-ভোটে’র বিধান প্রবর্তন করা। নির্বাচনে না-ভোট বিজয়ী হলে সেই নির্বাচন বাতিল করা এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাতিলকৃত নির্বাচনের কোনো প্রার্থী নতুন নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারার বিধান করা।
মন্তব্য: ২০০৮ সালের নির্বাচনকালে ‘না- ভোটে’র বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই বিধান বাতিল করা হয়।
করণীয়: একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না- ভোটে’র বিধান থাকলে ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেবে, যার ফলে নির্বাচনের খরচই শুধু বাড়বে। তাই সকল আসনে ‘না-ভোটে’র বিধানকে অর্থবহ করার জন্য ‘না-ভোট’ বিজয়ী হলে সেই নির্বাচন বাতিল করা এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাতিলকৃত নির্বাচনের কোনো প্রার্থী নতুন নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারার বিধান করা আবশ্যক ছিল।
বাইশ.
সুপারিশ: মনোনয়নপত্রের সঙ্গে ৫ বছরের আয়কর রিটার্নের কপি জমা দেওয়ার বিধান করা।
মন্তব্য: এটিকে প্রার্থীর আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতের ব্যাপারে একটি বাধা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
করণীয়: একাধিক বছরের আয়কর রির্টানের কপি জমা দেওয়ার বিধান করা আবশ্যক ছিল।
তেইশ.
সুপারিশ: স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধানের পরিবর্তে ৫০০ ভোটারের সম্মতির বিধান করা এবং এ ক্ষেত্রে একক কিংবা যৌথ হলফনামার মাধ্যমে ভোটারদের সম্মতি জ্ঞাপনের বিধান করা।
মন্তব্য: স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধান ব্যবহার করে সম্ভাব্য প্রার্থীকে অনেক ধরনের হয়রানি ও কারসাজি করা হয়। এই বিধান শিথিল করার ব্যাপারে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ব্যাপক দাবি রয়েছে।
করণীয়: সুপারিশটি আমলে নিয়ে অধ্যাদেশ সংশোধন করা আবশ্যক ছিল।
পরিশেষে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত না হলে ভবিষ্যতে আর এমন সুযোগ তৈরি নাও হতে পারে। তাই বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পরিচ্ছন্ন ও কার্যকর করার জন্য এগুলো যথাযথভাবে আরপিওতে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল বলে আমি মনে করি। আশাকরি, সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
লেখক: কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও ভূতপূর্ব নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কমিশন প্রধানের একান্ত সচিব
ঢাকা/তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ন র ব ধ ন কর ন শ চ ত কর র র র ব ধ ন কর গণত ন ত র ক প রণয়ন কর ন ব ত ল কর প রস ত ব ত র প রস ত ব ব কল প ন ই ন ব যবস থ ব যবস থ র বন ধ করত হলফন ম য় কর মকর ত আচরণব ধ ট র র পর র লক ষ য এই ব ধ ন অন চ ছ দ র আর থ ক উদ দ শ য ত র জন য ব তর ক ত য ক ত কর গ রহণ র ঋণখ ল প র সদস য ব যবহ র র ক ষমত ন র পর কর র ক র পর ব কর র ব ত হয় ছ প রক শ অন দ ন প রব ন র র জন য় মন ন আম দ র দল র প র আইন র গঠন করণ য় হওয় র ধরন র র সময় স গঠন দলগ ল র গণত ব ষয়ট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আরপিও সংশোধনীতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ কতটা বাস্তবায়িত হলো
একাত্তরে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একটি নির্বাচনের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে কিছু নির্বাচন ছিল একতরফা ও বিতর্কিত, যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে দলীয় কিংবা সামরিক সরকারের অধীনে। ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে বিগত তিনটি নির্বাচনে জনগণ প্রকৃত অর্থে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর ও জবাবদিহির কাঠামো ভেঙে পড়ে। তাই রাজনীতি ও নির্বাচনী অঙ্গন পরিচ্ছন্ন করা এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান আবশ্যক হয়ে পড়েছিল।
ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয় যে, কতগুলো মৌলিক আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার দীর্ঘদিনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসবে, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে একটি শোষণ ও বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। জনগণের এ আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন; ‘সুজন’ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’ যার মধ্যে অন্যতম।
কমিশন গঠিত হওয়ার পর এই কমিশনের ওপর অর্পিত হয় বাংলাদেশের আইনি কাঠামো ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নানাবিধ সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করে অন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে একগুচ্ছ সুপারিশ প্রণয়ন করা, যা বাংলাদেশকে পুনরায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে ফিরিয়ে আনবে এবং একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত রচনা করবে।
যে আস্থার ভিত্তিতে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, সেই আস্থার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সংলাপ এবং কঠোর পরিশ্রম ও এ ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কমিশনের সদস্যগণ একগুচ্ছ যুগোপযোগী সুপারিশ প্রণয়ন করেন, যার মধ্যে রয়েছে কতগুলো আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার। এসব সুপারিশের লক্ষ্য হলো, এগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচনি ও রাজনৈতিক অঙ্গন দুর্বৃত্তমুক্ত করা, টাকার খেলা বন্ধ করা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও দায়বদ্ধ করা, সংশ্লিষ্ট সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করা, বিশেষ করে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা।
এরপর ৩ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে ‘প্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আরপিও’র যেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে তা হলো:
অনুচ্ছেদ-২: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী অন্তর্ভুক্ত। (২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমন বিধান ছিল)
অনুচ্ছেদ-৮: ভোটকেন্দ্রের তালিকা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা প্রস্তুত করবেন এবং কমিশনের অনুমোদন নেবেন।
অনুচ্ছেদ-৯: রিটার্নিং কর্মকর্তা কোনো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করলে নির্বাচন কমিশনকে তা জানাতে হবে।
অনুচ্ছেদ-১২: আদালত কর্তৃক ফেরারি বা পলাতক আসামি ঘোষিত কেউ সংসদ সদস্য হতে পারবেন না; কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিসহ লাভজনক পদে থাকলে প্রার্থী হওয়া যাবে না; হলফনামায় আয়, সম্পদ ও কর-রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক; এবং অসত্য তথ্য দিলে ভোটের পরও ইসি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
অনুচ্ছেদ-১৩: মনোনয়নপত্রের জামানত ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-১৪: রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হলে প্রার্থী ছাড়াও ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সেবাদাতা সংস্থা আপিল করতে পারবে।
অনুচ্ছেদ-১৯: ‘না ভোট’ ফিরেছে। কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ব্যালটে ‘না ভোট’ থাকবে, তবে পুনঃনির্বাচনে এ বিধান থাকবে না।
অনুচ্ছেদ-২০: জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলেও প্রতিটি দল নিজ নিজ প্রতীকে ভোট করবে।
অনুচ্ছেদ-২১: নির্বাচনী এজেন্ট অবশ্যই সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হতে হবে।
অনুচ্ছেদ-২৫: প্রিজাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-২৬: বিতর্কিত ও ব্যয়বহুল ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিধান বাতিল।
অনুচ্ছেদ-২৭: আইটি-সমর্থিত পোস্টাল ভোটিং চালু। প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী ও আটক ভোটাররাও ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন।
অনুচ্ছেদ-২৯ ও ৩৬: গণমাধ্যমকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ ও গণনার সময় উপস্থিত থাকতে পারবেন।
অনুচ্ছেদ-৩৭: প্রিজাইডিং কর্মকর্তা প্রয়োজনে বাতিল ভোট পুনর্গণনা করতে পারবেন।
অনুচ্ছেদ-৩৮: সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দু’জন প্রার্থী সমান ভোট পেলে লটারির পরিবর্তে ওই আসনে পুনরায় ভোট হবে।
অনুচ্ছেদ-৪৪: প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ১০ টাকা নির্ধারণ; রাজনৈতিক দলের ব্যয়ের হিসাব দলের ওয়েবসাইটে প্রকাশ বাধ্যতামূলক; নির্বাচন কর্মকর্তাদের বদলিতে উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শকের অংশগ্রহণ যুক্ত করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-৭৩: মিথ্যা তথ্য, গুজব, অপতথ্য ও এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) অপব্যবহারকে নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে সংযোজন।
অনুচ্ছেদ-৭৪, ৮১, ৮৭ ও ৮৯: এসব অনুচ্ছেদে ছোটখাট পরিমার্জন আনা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-৯০: রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, অনুদান গ্রহণ ও নিবন্ধন স্থগিত হলে প্রতীক স্থগিতের বিধান।
অনুচ্ছেদ-৯১: নির্বাচনি অনিয়মে কেন্দ্রের পাশাপাশি পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের দণ্ডের পাশাপাশি সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। দলের ক্ষেত্রেও জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের পাশাপাশি ইসির ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও ব্যবস্থা নিতে পারবেন- এমন বিধান রাখা হয়েছে। হলফনামায় অসত্য তথ্যে যাচাই ও ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে।
কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, উক্ত আরপিও অধ্যাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। নিচে যেসব সুপারিশ আরপিওতে যুক্ত হয়নি সেগুলো সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এবং এ ক্ষেত্রে যা করা যেত কিংবা করা যেতে পারে সে সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:
এক.
সুপারিশ: ২০২৩ সালে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিবন্ধন দেওয়া রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা।
মন্তব্য: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যাতে একতরফা না হয়, সেজন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। এসব দলের প্রতীক ব্যবহার করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবে।
করণীয়: রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত আরপিও’র ৯০(ক) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনকে তদন্তসাপেক্ষে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতা প্রদান করা আবশ্যক, যাতে এই ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন এ সকল দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে।
দুই.
সুপারিশ: নতুন দল নিবন্ধনের শর্ত শিথিলের লক্ষ্যে ১০% জেলা এবং ৫% উপজেলা/থানায় দলের অফিস এবং ন্যূনতম ৫ হাজার সদস্য থাকার বিধান করা।
মন্তব্য: রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করার ব্যাপক সঙ্গত দাবি রয়েছে।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
তিন.
সুপারিশ: দলের সাধারণ সদস্যদের তালিকা প্রস্তুত করে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এবং উক্ত তালিকা প্রতিবছর একবার হালনাগাদ করা।
মন্তব্য: রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত এই সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
চার.
সুপারিশ: আরপিও’র ১২ ধারা অনুয়ায়ী সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য ব্যক্তিদের কোনো নিবন্ধিত দলের সাধারণ সদস্য/কমিটির সদস্য হওয়ার অযোগ্য করা।
মন্তব্য: আমাদের নির্বাচনী ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করতে হলে বিতর্কিত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ থেকে দূরে রাখার কোনো বিকল্প নেই।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
চার.
সুপারিশ: দলের সাধারণ সদস্যদের গোপন ভোটে দলের স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সকল কমিটির সদস্যদের নির্বাচিত করা।
মন্তব্য: রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণের জন্য আমাদের প্রস্তাবিত এই সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
পাঁচ.
সুপারিশ: দলের সাধারণ সদস্যদের গোপন ভোটে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকা থেকে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তিনজনের একটি প্যানেল তৈরি করা, যা থেকে দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড কর্তৃক দলীয় মনোনয়ন প্রদানের বিধান করা।
মন্তব্য: বর্তমানে আরপিওতে দলীয় সদস্যগণ কর্তৃক প্রস্তুত প্যানেল শুধু বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় সংসদীয় বোর্ডের মনোনয়ন চূড়ান্ত করার কথা বলা আছে। ফলে রাজনৈতিক দলের পক্ষে যে কোনো ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব, যা বাস্তবে ঘটেছেও।
করণীয়: দলের সদস্যদের গোপন ভোটে তৈরি তিনজনের প্যানেল থেকে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড কর্তৃক দলীয় মনোনয়ন দিতে বাধ্য হলে সদস্যদের প্রতি দলের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধের পথ সুগম হবে।
ছয়.
সুপারিশ: দলের সদস্যদের চাঁদা ন্যূনতম ১০০ টাকা ও কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে অনুদান হিসেবে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা নেওয়ার বিধান করা। এ অনুদান ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে গ্রহণের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ট্যাক্স রিটার্নে প্রদর্শনের বিধান করা।
মন্তব্য: নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক দলের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। এই সুপারিশটি আংশিকভাবে আরপিও অধ্যাদেশে রয়েছে।
করণীয়: অনুদান গ্রহণের তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ট্যাক্স রিটার্নে প্রদর্শনের বিধান অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
সাত.
সুপারিশ: দলের তহবিল ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে বিদ্যমান ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিবন্ধিত দল কর্তৃক বাৎসরিকভাবে দাখিলকৃত অডিটেড আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ ও নির্বাচন কমিশনে দাখিলের বিধান করা এবং কমিশনকে এগুলো অডিট করার ক্ষমতা প্রদান করা।
মন্তব্য: নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক দলের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
করণীয়: বিষয়টি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
আট.
সুপারিশ: নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর আওতাভুক্ত করা।
মন্তব্য: দলের স্বচ্ছতা, বিশেষত আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য এটির বিকল্প নেই।
করণীয়: এটি আরপিও বা তথ্য অধিকার আইনে রাজনৈতিক দলকে ‘কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা আবশ্যক ছিল।
নয়.
সুপারিশ: দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন, ভ্রাতৃপ্রতীম বা যে কোনো নামেই হোক না কেন, না থাকার বিধান করা।
মন্তব্য: বর্তমানে আরপিও’র ৯০(খ)(১)(খ)(ই) অনুচ্ছেদে নিবন্ধিত দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন না থাকার বিধান রয়েছে। তা সত্ত্বেও দলগুলো ভাতৃপ্রতীম সংগঠন বলে এগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
করণীয়: এই বিধানের প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক, যাতে রাজনৈতিক দলের ভাতৃপ্রতীম বা অন্য কোনো নামে লেজুড়বৃত্তির ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন না থাকে।
দশ.
সুপারিশ: দলের, যে কোনো নামেই হোক না কেন, বিদেশি শাখা না থাকার বিধান করা।
মন্তব্য: বর্তমানে আরপিও’র ৯০(গ)(১)(ঙ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের অযোগ্য হবে যদি বিদেশে অফিস, শাখা, বা কমিটি গঠন ও পরিচালনার বিধান তাদের দলের গঠনতন্ত্রে থাকে। কিন্তু দলগুলোর গঠনতন্ত্র থেকে এই বিধান বিলুপ্ত করা হলেও কিছু দলের বিদেশি শাখা রয়েছে এবং তাদের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
করণীয়: এই বিধানের ভাষা পরিবর্তনের মাধ্যমে (যেমন, দলের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে) নিবন্ধিত দলের বিদেশি অফিস, শাখা ও কমিটি বিলুপ্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক।
এগারো.
সুপারিশ: মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের তিন বছরের সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক করার বিধান পুনরায় সংযোজন করা।
মন্তব্য: এই বিধান আগে আরপিওতে ছিল। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যাকে ইচ্ছা তাকে মনোনয়ন দিতে পারত না।
করণীয়: নির্বাচনকে সামনে রেখে দলবদলের প্রবণতা বন্ধ করতে এবং মনোনয়ন বাণিজ্য রোধ করতে এটি আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
বারো.
সুপারিশ: জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, ফলাফল গেজেটে প্রকাশের (ক) পূর্বে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ‘সার্টিফাই’ করে তা গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের বিধান করা
মন্তব্য: একটি গণতান্ত্রিক দেশে কেউই দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। এই লক্ষ্যে আমরা কতগুলো ‘গার্ড রেইল’ তৈরির সুপারিশ করেছি, যাতে নির্বাচন কমিশন অতীতের ন্যায় কোনোরূপ প্রহসনমূলক ও জালিয়াতির নির্বাচন আয়োজন না করতে পারে
করণীয়: নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য এটি আরপিও অধ্যাদেশে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
তেরো.
সুপারিশ: নির্বাচন কমিশনের আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রস্তাব কোনো মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের (যদি না হয়, তাহলে বিদ্যমান সংসদের অনুরূপ) স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির নিকট উপস্থাপনের বিধান করা। (সংসদীয় কমিটি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রস্তাবগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করবে।)
মন্তব্য: নির্বাচন কমিশনের আর্থিক দায়বদ্ধতার অভাবে নির্বাচনী ব্যয় ক্রমান্বয়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। যেমন, দশম জাতীয় সংসদে নির্বাচনী ব্যয় ছিল ৩৩৩ কোটি টাকা যা, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বেড়ে হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৯০০ কেটি টাকা। তাই নির্বাচনী ব্যয়ের লাগাম টানা আবশ্যক।
করণীয়: কমিশনের আর্থিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের জন্য এই বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক ছিল।
চৌদ্দ.
সুপারিশ: নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকালে কমিশনারদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে তা সংবিধানের ১১৮ ও ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে সুরাহা করার বিদ্যমান বিধান কার্যকর করা।
করণীয়: একটি গণতান্ত্রিক দেশে কেউই দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। তাই এটি কার্যকর করা আবশ্যক।
পনের.
সুপারিশ: সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথ ভঙ্গ করলে কমিশনারদের মেয়াদ পরবর্তী সময়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে সুপারিশসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের বিধান করা।
মন্তব্য: নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে এটি ‘গার্ড রেইল’ হিসেবে কাজ করব্যে।
করণীয়: নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের জন্য এগুলো আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক ছিল।
ষোল.
সুপারিশ: আরপিও’র ৯০(ক) ধারা সংশোধনপূর্বক নির্বাচনি অপরাধের মামলা দায়েরের সময়সীমা রহিত করা।
করণীয়: নির্বাচন দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতে নির্বাচনী অপরাধের মামলা দায়েরের সময়সীমা রহিত করা আবশ্যক।
সতের.
সুপারিশ: ক. সকল নির্বাচনি ব্যয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা বা আর্থিক প্রযুক্তির (যেমন, বিকাশ, রকেট) মাধ্যমে পরিচালনা করা; খ. নির্বাচনি ব্যয়ের অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এক বা একাধিক নির্বাচনি আসনের জন্য ‘নির্বাচনি ব্যয় মনিটরিং কমিটি’ গঠন এবং নির্বাচনি ব্যয় নিবিড়ভাবে নজরদারি করা; গ. নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থী এবং দলের নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্নের নিরীক্ষা করা এবং হিসাবে অসঙ্গতির জন্য নির্বাচন বাতিলের বিধান করা।
মন্তব্য: বর্তমানে সব প্রার্থীই নির্বাচনী ব্যয়ের সঠিক তথ্য প্রদান করেন না। এমনকি অনেকে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেন না, যা করা বাধ্যতামূলক। এ সম্পর্কিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সংশোধিত আরপিও অধ্যাদেশে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয়েছে।
করণীয়: নির্বাচনে ‘টাকার খেলা’ বন্ধ করতে হলে নির্বাচনী ব্যয়ের প্রদত্ত হিসাব কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে এবং একইসঙ্গে এগুলো পদ্ধতিগতভাবে মনিটরিং করতে হবে।
আঠারো.
সুপারিশ: ক. হলফনামার ছকে দেশি-বিদেশি সম্পত্তিসহ আয়কর রিটার্নের কপি সংযোজনের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা এবং হলফনামার তথ্য ব্যাপকভাবে প্রচার করা, যাতে ভোটাররা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন; খ. হলফনামায় ও আয়কর বিবরণীতে তথ্য গোপন করলে বা ভুল তথ্য দিলে মনোনয়নপত্র/নির্বাচন বাতিল করা; গ. প্রার্থী কর্তৃক দাখিল করা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রত্যেক দলের পক্ষ থেকে তার প্রার্থীদের জন্য প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্রের পরিবর্তে দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বা অনুরূপ পদধারী ব্যক্তি কর্তৃক হলফনামা জমা দেওয়ার বিধান করা, যাতে তাদের দলীয় মনোনীত প্রার্থীর নামের পাশাপাশি মনোনয়ন বাণিজ্য না হয় ও দলীয় প্যানেল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন প্রদানের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে; ঘ. পরবর্তী নির্বাচনের আগে যে কোনো সময় নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচিত ব্যক্তির হলফনামা যাচাই-বাছাই করার এবং হলফনামায় মিথ্যা তথ্য বা তথ্য গোপনের প্রমাণ পেলে তার নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা প্রদানের বিধান করা; ঙ. হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কিংবা তথ্য গোপনের কারণে আদালত কর্তৃক কোনো নির্বাচিত ব্যক্তির নির্বাচন বাতিল করা হলে ভবিষ্যতে তাঁকে নির্বাচনে অযোগ্য করার বিধান করা।
মন্তব্য: হলফনামা এবং দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়নি- এ ধরনের ঘোষণা আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি নির্বাচনের পরে বাধ্যতামূলকভাবে হলফনামা যাচাই-বাছাইয়ের বিধান।
করণীয়: হলফনামায় ৮ ধরনের তথ্য প্রদান এবং এগুলো নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রচার ও প্রকাশের আদালত কর্তৃক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো, প্রার্থী সম্পর্কে তথ্য দিয়ে জনগণকে ক্ষমতায়িত করা, যা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকের বাক্-স্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাই করা দরকার, যাতে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। একইসঙ্গে হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ নির্বাচিত হয়েছে প্রমাণিত হলে তাকে ভবিষ্যতের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া অযোগ্য ঘোষণার বিধান করা আবশ্যক।
উনিশ.
সুপারিশ: অভ্যাসগত ঋণখেলাপি ও বিল খেলাপিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা। বিশেষত ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে তাদের তামাদি ঋণ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ছয় মাস আগে পরিপূর্ণভাবে শোধ করার বিধান করা। নির্বাচনের পরে যারা আবার ঋণখেলাপি হয়েছেন তাদেরকে সংসদ সদস্য পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণার বিধান করা।
মন্তব্য: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ঋণখেলাপিদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে উপরোক্ত প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু আরপিওতে এ ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
করণীয়: ঋণখেলাপিদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে আমাদের প্রস্তাবটি আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক ছিল।
বিশ.
সুপারিশ: ১৯৯০ সালের তিনজোটের রূপরেখার মতো রাজনৈতিক দলের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন করা।
মন্তব্য: নব্বইয়ের তিনজোটের রূপরেখা রাজনৈতিক দলগুলো প্রণয়ন ও অনুসরণ করেছিল। তাই ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন ছিল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। আমরা জানি না নির্বাচন কমিশন কী ধরনের আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে।
করণীয়: নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তিনজোটের রূপরেখায় অন্তর্ভুক্ত আচরণবিধির মতো একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করা আবশ্যক।
একুশ.
সুপারিশ: বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বন্ধ, রাজনৈতিক দলগুলোকে সৎ, যোগ্য এবং ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেওয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনে ‘না-ভোটে’র বিধান প্রবর্তন করা। নির্বাচনে না-ভোট বিজয়ী হলে সেই নির্বাচন বাতিল করা এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাতিলকৃত নির্বাচনের কোনো প্রার্থী নতুন নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারার বিধান করা।
মন্তব্য: ২০০৮ সালের নির্বাচনকালে ‘না- ভোটে’র বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই বিধান বাতিল করা হয়।
করণীয়: একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না- ভোটে’র বিধান থাকলে ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেবে, যার ফলে নির্বাচনের খরচই শুধু বাড়বে। তাই সকল আসনে ‘না-ভোটে’র বিধানকে অর্থবহ করার জন্য ‘না-ভোট’ বিজয়ী হলে সেই নির্বাচন বাতিল করা এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাতিলকৃত নির্বাচনের কোনো প্রার্থী নতুন নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারার বিধান করা আবশ্যক ছিল।
বাইশ.
সুপারিশ: মনোনয়নপত্রের সঙ্গে ৫ বছরের আয়কর রিটার্নের কপি জমা দেওয়ার বিধান করা।
মন্তব্য: এটিকে প্রার্থীর আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতের ব্যাপারে একটি বাধা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
করণীয়: একাধিক বছরের আয়কর রির্টানের কপি জমা দেওয়ার বিধান করা আবশ্যক ছিল।
তেইশ.
সুপারিশ: স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধানের পরিবর্তে ৫০০ ভোটারের সম্মতির বিধান করা এবং এ ক্ষেত্রে একক কিংবা যৌথ হলফনামার মাধ্যমে ভোটারদের সম্মতি জ্ঞাপনের বিধান করা।
মন্তব্য: স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধান ব্যবহার করে সম্ভাব্য প্রার্থীকে অনেক ধরনের হয়রানি ও কারসাজি করা হয়। এই বিধান শিথিল করার ব্যাপারে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ব্যাপক দাবি রয়েছে।
করণীয়: সুপারিশটি আমলে নিয়ে অধ্যাদেশ সংশোধন করা আবশ্যক ছিল।
পরিশেষে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত না হলে ভবিষ্যতে আর এমন সুযোগ তৈরি নাও হতে পারে। তাই বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পরিচ্ছন্ন ও কার্যকর করার জন্য এগুলো যথাযথভাবে আরপিওতে যুক্ত করা আবশ্যক ছিল বলে আমি মনে করি। আশাকরি, সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
লেখক: কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও ভূতপূর্ব নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কমিশন প্রধানের একান্ত সচিব
ঢাকা/তারা//