বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মনেই থাকে উজ্জ্বল এক স্বপ্ন। উচ্চশিক্ষা, স্বাধীনতা আর নতুন জীবনের উত্তেজনায় তারা পা রাখে নতুন পরিবেশে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নের দীপ্তি ম্লান হয়ে যায় অনেকের কাছেই। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) বহু শিক্ষার্থীর গল্পেও আছে সেই বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

এ বিষয়ে একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে রাইজিংবিডি। জানা গেছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণে মানসিকভাবে ভীষণ চাপে আছেন। কেউ চাপ সামলাতে পারছেন, কেউ আবার চুপচাপ ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছেন। তবে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।

আরো পড়ুন:

বাঁচতে চান কুবি শিক্ষার্থী প্রভা

‘প্রভোস্টের ছাত্রী’র ত্রাসে কাঁপছে জবির হল

যবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের এই গল্পগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয়, এগুলো পুরো প্রজন্মের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। যেখানে একদিকে স্বপ্ন ভেঙে পড়ছে বাস্তবতার চাপে। অন্যদিকে উঠে আসছে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, নতুনভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। কেউ নামাজে শান্তি খোঁজেন, কেউ বইয়ে, কেউবা ছোট ব্যবসায় নিজের ভরসা খুঁজে নেন।

সব কষ্টের মাঝেও তারা এগিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। কারণ হয়তো তারাই জানেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুধু একাডেমিক পাঠ নয়, এটা জীবনের সবচেয়ে কঠিন কিন্তু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পাঠ ও বটে।

হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে তার অনেক আশা ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা পূরণ হয়নি। সবচেয়ে বড় বাধা এসেছে অর্থনৈতিক সংকট থেকে। বহু চেষ্টা করেও কোনো টিউশন না পেয়ে এবং পরিবারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না থাকায় শুরু থেকেই মানসিক চাপে ভুগছেন তিনি। এই চাপ শুধু পড়াশোনায় নয়, বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি জানান, নিয়মিত ক্লাসে মন বসে না; শুধু সেমিস্টারের আগে কিছুটা পড়ার চেষ্টা করি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে অন্যদের মতো ঘুরতে বা আনন্দ করতে পারি না, বরং ভাবি কীভাবে কিছু আয় করা যায়।

বর্তমানে টিকে থাকার তাগিদে ছোট একটি ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি। কিন্তু এতে পড়াশোনায় মনোযোগ কমেছে, বেড়েছে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। কষ্টের সুরে তিনি বলেন, “অনেক সময় মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটাই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।”

ফিশারিস অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বাস্তবতা তার জন্যও স্বপ্নভঙ্গের মতো। তার ভাষায়, “বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে অনেক স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এখানে এসে সেই স্বপ্নগুলোকে যেন ধীরে ধীরে হারাতে বসেছি। পরিবার থেকে দূরে থাকা, অর্থকষ্ট, পড়ালেখার চাপ—সবমিলিয়ে কখনো কখনো নিজেকে খুব একা লাগে।”

তিনি বলেন, “ক্যাম্পাসজুড়ে প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলে—ফলাফল, সিজিপিএ, অবস্থান—এসব দিয়েই মূল্যায়ন হয়। আমার ফলাফল তুলনামূলক কম হওয়ায় নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগও কম পাই। এটা ভীষণ কষ্ট দেয়।”

হলের সংকীর্ণ পরিবেশও মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। চারজন মিলে ছোট রুম ভাগ করে নেওয়ায় ব্যক্তিগত সময়ের অভাব তৈরি হয়। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। বলেন, “যখন খুব খারাপ লাগে, তখন বই পড়াই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা এখনো প্রত্যাশার মতো সুখকর নয়।”

ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সুলতানার অভিজ্ঞতাও কিছুটা একই রকম। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় আমার তেমন কোনো বিশেষ আশা ছিল না। তবুও এখানে এসে যা পেয়েছি, সেটাকে মোটামুটি সন্তোষজনকই বলব। পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকা শুরুতে কষ্ট দিত, কিন্তু ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছি। তবে পরীক্ষার সময় তার মানসিক চাপ বেড়ে যায় দ্বিগুণ। আর হলে নিম্নমানের খাবার সেই চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়।”

বাসা থেকে হলে ফিরেই যখন এমন খাবার সামনে পান, খেতে কষ্ট হয় বলে জানান তিনি। তবুও তিনি হাল ছাড়েন না—ভাবেন, হয়তো জীবন এমনই। কিছু সংগ্রাম নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। এছাড়া তিনি যখন খুব বেশি চাপে থাকেন, তখন নামাজে মানসিক শান্তি খুঁজে নেন বলে জানান।

ফিশারিস অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী জানান, ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়ার। কিন্তু নানা কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, “আমি ভাবলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে চাকরির প্রস্তুতি নেব, কিন্তু বাস্তবে তা পারিনি। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় দায়িত্বও বেড়েছে। আর প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার অপরাধবোধ সবসময় তাড়া করে।”

তিনি ক্লান্তির সুরে বলেন, “এই মানসিক চাপ ধীরে ধীরে শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে। খুব বেশি চিন্তা হলে আমি একা থাকতে চাই। কখনো কখনো মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা আরেকটু বেশি আশাব্যঞ্জক হতে পারত।”

শিক্ষার্থীদের এই মানসিক সংকট সম্পর্কে অবগত আছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক ড.

মো. রাফিউল হাসান বলেন, “আমাদের অনেক শিক্ষার্থী বাংলা মাধ্যম থেকে আসে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনায় মানিয়ে নিতে না পেরে অনেকেই সমস্যায় পড়ে যায়। রেজাল্ট খারাপ হলে তারা ভেঙে যায়, হীনমন্যতায় ভোগে।”

“শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মনোযত্ন’ নামে একটি ডেস্ক চালু করা হয়েছে, যেখানে আবেদন করে সরাসরি সেবা নেওয়া যায়। পাশাপাশি আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। বৃত্তি প্রদান ও ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সেমিস্টার ফি কমানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে,” বলেন তিনি।

যবিপ্রবি ইতোমধ্যে আদ-দ্বীন সাকিনা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল, আহছানিয়া মিশন ও ফিউচার নেশন নামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতায় চলছে, যারা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগিতা করবে বলেও জানান ড. রাফিউল।

ঢাকা/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ব র জ বন র সবচ য় ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

‘শিল্পবোধ ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটেছিল আনিস চৌধুরীর লেখায়’

‘খেয়াল খেলা কাজ’, ‘পড়বার নিয়ম’ অথবা ‘পাশের কামরার লোকটি’ এসব শিরোনামের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল চল্লিশের দশকে। আজাদ, মুকুলের মহফিল, ইত্তেহাদ বা অগত্যা পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠক সমাদৃত এসব বিষয়ের লেখক প্রয়াত আনিস চৌধুরী। সেসব লেখা একসঙ্গে করে প্রকাশিত হয়েছে ‘আনিস চৌধুরী হয়ে ওঠার লেখাজোখা’ বইটি। তাঁর লেখায় ধরা আছে সময় পরিক্রমার ইতিহাস। বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উঠে এল এসব কথা। শনিবার বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে আয়োজিত হয় মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানটি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন লেখক ও শিল্পসমালোচক হাসনাত আবদুল হাই। তিনি বলেন, ‘আনিস চৌধুরী আমাদের সাহিত্যিকদের পূর্বসূরি। একসময় উপন্যাস বের হওয়া ছিল আলোড়ন তোলা। তখনই তিনি আমাদের কাছে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন।’ হাসনাত আবদুল হাই আরও বলেন, আনিস চৌধুরীর লেখায় শিল্পবোধ ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ছিল। ডকুমেন্টেশনের ক্ষেত্রে এ বই এক দৃষ্টান্তমূলক প্রকাশনা।

কথাসাহিত্যিক পিয়াস মজিদ আনিস চৌধুরীর বইয়ের বিভিন্ন অংশ থেকে পাঠ ও আলোচনা করেন। তিনি রমনীয়তা ও রম্যতার বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরেন। আনিস চৌধুরীর কবিতা নিয়ে কম আলোচনা থাকলেও তিনি যথেষ্ট সিরিয়াস কবি ছিলেন বলে উল্লেখ করেন এই আলোচক।

প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ বলেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে মানুষেরা সাহিত্য দিয়ে সমাজ নির্মাণ করে দেশকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, আনিস চৌধুরী তাঁদেরই একজন। তাঁরা স্বাধীন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য সম্মিলিত লড়াই করেছেন। আনিস চৌধুরীর লেখার প্রসঙ্গ ধরে আলম খোরশেদ স্মরণ করেন সদ্য প্রয়াত ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে।

আলোচনা পর্ব শেষে মোড়ক উন্মোচন হয় ‘আনিস চৌধুরী হয়ে ওঠার লেখাজোখা’ বইটির। পুরো আয়োজনের সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। প্রয়াত আনিস চৌধুরী তাঁর বাবা।

আনিস চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন ১৯৯০ সালে। নাট্যকার, গল্পকার, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং কবি আনিস চৌধুরী রেডিও, টেলিভিশনে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।

১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণকারী আনিস চৌধুরী নিজের সময়কালের টুকরো টুকরো ইতিহাস ধরে রেখেছিলেন সে সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও সাময়িকীতে নিজের লেখা দিয়ে। সেসব লেখাই তিনি সংরক্ষণ করতেন সযত্নে। সেই সব লেখা নিয়েই ‘আনিস চৌধুরী হয়ে ওঠার লেখাজোখা’ নামক গ্রন্থটি। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু, প্রয়াত ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সহধর্মিণী সিদ্দিকা জামান, শিল্পী ঢালী আল মামুন, সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক, প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফসহ আরও অনেক বিশিষ্টজন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ