স্বাস্থ্য খাতে সমতা নিশ্চিত করা জরুরি
Published: 9th, November 2025 GMT
বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশ আজ একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। দুই দশক আগেও প্রতি লাখ শিশু জন্ম দিতে মারা যেতেন চার শতাধিক মা, এখন তা কমে এসেছে অর্ধেকের বেশি। নবজাতকের মৃত্যুও প্রতি হাজারে ৪৪ থেকে কমে ২০-এ নেমে এসেছে। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের এই অর্জন কোনো একক প্রকল্পের ফল নয়। সত্তরের দশকে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম শুরুর সময়েই এই পরিবর্তনের বীজ বোনা হয়েছিল। পরিবার পরিকল্পনা, প্রসবকালীন জরুরি সেবা, নারীশিক্ষার প্রসার থেকে গ্রামীণ উন্নয়ন ও প্রায় শতভাগ নবজাতককে টিকার আওতায় আনা—এসব ধারাবাহিক প্রচেষ্টাতেই আজকের এই অগ্রযাত্রা।
বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ ৬৫ থেকে কমে ৫১ শতাংশ হয়েছে ও গর্ভকালে অন্তত একবার চিকিৎসা গ্রহণ ৩৪ থেকে বেড়ে ৮৮ শতাংশে পৌঁছেছে। একই সময়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের হার ৮ থেকে বেড়ে ৬৫ শতাংশ হয়েছে আর কিশোরী গর্ভধারণ ৩৫ থেকে ২৩ শতাংশে নেমেছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধি, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিও এই সাফল্যে অবদান রেখেছে। আমাদের নারী সাক্ষরতার হার ৫৪ থেকে ৮৬ শতাংশ হয়েছে। অধিকাংশ ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ আর মুঠোফোন।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও অসামান্য। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দারিদ্র্য কমে ৪৯ থেকে ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণও ২৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২ শতাংশ। সমন্বিত সামাজিক অগ্রগতি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমাতে ভূমিকা রাখলেও গবেষণা বলছে, ২০১০ সালের পর এ গতি মন্থর হয়ে এসেছে। গবেষকদের মতে, এর মূলে আছে বৈষম্য।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীর প্রায় সব সমস্যার মূলেই আছে কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য।’
স্বাস্থ্যে বৈষম্য মানে শুধু এই নয় যে কেউ অসুস্থ আর কেউ সুস্থ। এর অর্থ, কারও আছে বাঁচার সুযোগ, কারও নেই। কেউ হাতের নাগালে চিকিৎসা পান, কেউ সেই একই সেবার জন্য পাড়ি দেন মাইলের পর মাইল। কারও সন্তান জন্মায় চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আর কারও সন্তান চিকিৎসাসুবিধার অভাবে জন্মের আগেই হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সাফল্যের গল্প যেমন আছে, তেমনি রয়েছে সতর্কতার বার্তাও। সেবার মানোন্নয়ন, দারিদ্র্য, শিক্ষা ও ভৌগোলিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং বেসরকারি খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মৃত্যুহ্রাসের গতি ধরে রাখা কঠিন। রাষ্ট্র অনেকের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সেবার মান ও সমতা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি।
নারী, পুরুষ এবং অন্যান্যবাংলাদেশে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নারীকেন্দ্রিক হলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার অভাব, পারিবারিক ও সামাজিক অনুমতি ও আর্থিক নির্ভরশীলতা নারীদের সেবা গ্রহণে বড় বাধা। এ বৈষম্য মানে শুধু নারীদের ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, পরবর্তী প্রজন্মেও পড়ে এর প্রভাব। শিশু প্রসবের সময় মা যথাযথ সেবা না পেলে নবজাতকের জীবনের প্রথম মাসটিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। গর্ভকালীন যত্ন, নিরাপদ প্রসব এবং অসংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও নারী বৈষম্যের শিকার হন। পরিসংখ্যান বলছে, ৩৫ বছর বা তদূর্ধ্ব নারীদের ৩৬ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, যেখানে পুরুষদের এই হার ২৩ শতাংশ।
অন্যদিকে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী এখনো দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এক অদৃশ্য পরিসরে বাস করে। সরকারি নথিতে ‘হিজড়া’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বাস্তবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল বা সরকারি কর্মসূচিতে তারা প্রায় অনুপস্থিত। সামাজিক বৈষম্য, অবজ্ঞা ও ভয়ের কারণে অনেকেই চিকিৎসা নিতে উৎসাহী হন না। ফলে প্রজনন ও মানসিক স্বাস্থ্য, এইচআইভি প্রতিরোধ ও হরমোন চিকিৎসা, সব ক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত ও অবহেলিত।
বেসরকারি সংস্থা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ২০১৯ সালের সমীক্ষায় প্রায় ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় কোনো প্রবেশাধিকার নেই; অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা এখন বহুমাত্রিক বৈষম্যের শিকার। একদিকে যেমন নারী ও পুরুষ এখনো স্বাস্থ্যসেবায় পূর্ণ সমতা পাননি, অন্যদিকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা এখনো স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাইরের নাগরিক।
শহর বনাম গ্রামনারী–পুরুষের মতোই গ্রামীণ নাগরিকেরাও শহরের মানুষের তুলনায় স্বাস্থ্যবৈষম্যের শিকার। শহরে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ফার্মেসি বাড়লেও অনেক গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিকই এখনো একমাত্র ভরসা। ফলে স্বাস্থ্যসেবা আজও গ্রামের অনেকের কাছে দূরবর্তী এক প্রতিশ্রুতিমাত্র। ২০২২ সালের বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, শহরে ৭৬ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, যেখানে গ্রামে এ হার ৬১ শতাংশ। শহরে চিকিৎসক, হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্স সহজলভ্য। অন্যদিকে দূরত্ব, ব্যয় ও সামাজিক বাধায় অনেক সময় ঘরেই সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হন গ্রামীণ নারী। শহরের নারীরা চাইলেই চিকিৎসকের পরামর্শ এবং জরুরি অবস্থায় দ্রুত সেবা পান, সেখানে গ্রামীণ নারীর জন্য সেই পথ এখনো দীর্ঘ, ব্যয়বহুল ও অনিশ্চিত।
মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা আজও গ্রামের অনেকের কাছে দূরবর্তী এক প্রতিশ্রুতিমাত্র.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
একঝলক (৯ নভেম্বর’২০২৫)
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা