রাষ্ট্র হিসেবে ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও খুব প্রাথমিক কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন আমরা এখনো হচ্ছি। এসব বিষয় সুরাহা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল আরও অনেক আগেই। কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক জগতেও যে বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশ পেয়েছে, তাঁদের বড় অংশই যাঁর যাঁর আদর্শিক ঘরানায় বিচরণ করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন—ভিন্নচিন্তার জগৎগুলোর মধ্যে আদান–প্রদান প্রায় হয়নি। এরই অনিবার্য পরিণতিতে ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে আবারও আমরা জাতিগত আত্মপরিচয়ের কিছু টানাপোড়েন—আমরা কতটা বাঙালি, কতটা মুসলমান; কারা নমস্য, কারা ত্যাজ্য; কাদের নাম মুখে আনা বারণ ইত্যাদির মুখোমুখি নিজেদের দেখতে পাচ্ছি। এই বুদ্ধিবৃত্তিক লেনদেনের অভাবের পরিণাম হলো পরস্পরকে পরিত্যাজ্য করার একটি জাতীয় সংস্কৃতি।
সামনের দিনগুলো কতটা বিপৎসংকুল, তা নিয়ে নানাজনের নানান ভাবনা আছে। কিন্তু ‘বিপদ’গুলো কী প্রকার ও কী কী, তার একটা বিশ্লেষণ করলে এমন একটা ভাবনায় আসা যেতে পারে যে আমরা জাতিগতভাবে নিজেদের পরিচয় বিষয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি। পূর্বসূরিদের ভাবনার সূত্র ধরে আত্মমর্যাদা নিয়ে কী পরিচয়ে আমরা বিশ্বের সামনে আবির্ভূত হতে চাই, সেই বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। কোনো রাষ্ট্রীয় কমিশন গঠন করে এ ঘটনা ঘটানো সম্ভবও নয়।
যা সম্ভব, তা হলো আমাদের ভূখণ্ডের ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা গভীরভাবে আত্মস্থ করে, পাঠ করে, যে ঐতিহাসিক ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না, সেগুলো চিহ্নিত করে, ইতিহাসের ক্রান্তিকালে মানুষের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে চিহ্নিত করে তার ভিত্তিতে নিজেদের প্রশ্ন করা, আর কিছু গভীর ট্রমা ও দ্বন্দ্বের ফয়সালা করা। আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা বলি; কিন্তু কী অর্থ এই নীতিগুলোর? তার স্বরূপ আজকের জন্য সংজ্ঞায়িত করতে হলে পেছন ফিরে তাকিয়ে আমাদের আত্মপরিচয় গঠনের যাত্রাকে আগে বুঝতে হবে সততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে।
এই প্রক্রিয়াকে জোরদারভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে যে কটি হাতিয়ার অপরিহার্যভাবে দরকার, তার মধ্যে জরুরিতম হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নির্মোহ ও নির্ভেজাল জ্ঞানচর্চার পরিবেশ আর স্থানীয় ও বৈশ্বিক জ্ঞানের ভান্ডারকে মানুষের নাগালের মধ্যে আনার বন্দোবস্ত।
একটা বিষয় স্পষ্ট, যে দেশগুলো তাদের জাতি গঠনের কাজে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়েছে, তারাই আজ বিশ্বে স্বীয় মর্যাদায় আসীন। এশিয়া মহাদেশেই জাপান, চীন, ইরান, তুরস্ক, কাতার, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকালে আমরা এমন উজ্জ্বল প্রয়াস পাই। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নানান বিষয়ে জ্ঞানচর্চাকে প্রধানতম হাতিয়ার হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়ার ফলে ৫-৬ দশকে তারা এখন শিক্ষা, উদ্ভাবন, অর্থনীতি—সব ক্ষেত্রেই নিজেদের নেতৃত্ব বা মর্যাদার জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে, বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করেছে এবং নিজের দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েদের জন্য দেশেই কর্মসংস্থান দিতে পেরেছে।
যে বিষয়গুলো এসব দেশে আমরা দেখি, তার মধ্যে অন্যতম হলো—১.
২. দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ধারাবাহিকভাবে সংগতি রক্ষা করে এগিয়েছে।
৩. ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, দর্শন, ধর্মচর্চা, ভাষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক জ্ঞান ও পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ করেছে, যত্নের সঙ্গে সেগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বিনিয়োগ করেছে।
বাংলাদেশে আমরা দেখছি, শিক্ষা খাতে চলতি বছরের বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ (২০২৪-২৫ অর্থবছরে যা ছিল ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ)। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেলেও এই হার আন্তর্জাতিক মানের নিচে, ইউনেসকো প্রস্তাবিত মানেরও (জিডিপির ৪-৬ শতাংশ) অনেক নিচে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ১ শতাংশ! এই বেদনাদায়ক বাজেট আর বরাদ্দের ক্ষেত্রে যেসব চর্চা ও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বহাল আছে, তাতে আমাদের শিক্ষা ও জ্ঞানের ইকোসিস্টেমকে মাটিতে পুঁতে ফেলার ভাবনাই প্রকট।
সমাজ পুনর্গঠনে বই ও কার্যকর গ্রন্থনীতিএকটি সৃজনশীল বা জ্ঞানভিত্তিক বই একজন নাগরিককে উৎকৃষ্ট মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার এবং মনন তৈরির হাতিয়ার, শিক্ষার অপরিহার্য উপকরণ, এর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী, একই সঙ্গে এটি একটি মেধাসম্পদ ও অর্থনৈতিক পণ্য, যা তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় নানা ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও কায়িক শ্রম। সৃজনশীল ও জ্ঞানভিত্তিক প্রকাশনা যাঁরা করেন, তাঁদের প্রায় সবাই ব্যবসায়িক লাভের আশায় নয়, একরকম প্রাণের তাগিদে, সমাজে কিছু অবদান রাখার তাগিদে এই পেশায় যুক্ত হন। এসব কারণেই একটি রাষ্ট্র যদি সত্যিকারভাবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণে আগ্রহী থাকে, তাহলে তার ওপর দায়িত্ব বর্তায় অত্যন্ত সহায়ক ও শক্তিশালী নীতির মাধ্যমে পাঠককে সহায়তা করার পাশাপাশি সৃজনশীল ও জ্ঞানভিত্তিক প্রকাশনাকে উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া, এই খাতের পেশাদারত্বের দিকে নজর দেওয়া। শক্তিশালী নীতিকে কাজে রূপান্তরিত করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যার রূপরেখা খসড়া গ্রন্থনীতিতে বিস্তারিতভাবে আছে।
বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থ পরিষদ গঠন২০১৪ সালে প্রণীত জাতীয় গ্রন্থনীতির খসড়ায়, কোনো দিন যা সংসদে আলোচিত বা গৃহীত হয়নি, ইউনেসকোর প্রস্তাবের আলোকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ গ্রন্থ উন্নয়ন পরিষদ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপদান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আজকের বাস্তবতায় বিবেচনা করলেও এই প্রস্তাবের যৌক্তিকতা পরিষ্কার। আগেই যেমন বলা হয়েছে, পণ্য হিসেবে গ্রন্থ যেমন জটিল, এর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বও নানামুখী। গ্রন্থ খাতকে তাই কাজ করতে হয় অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। বই একই সঙ্গে পণ্য, শিক্ষা উপকরণ, সাংস্কৃতিক উপকরণ; আবার বৈশ্বিক পরিসরে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতাও এর রয়েছে। তাই স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদায় কাজ করার সুযোগ করে দিলে গ্রন্থ উন্নয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনভাবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রণোদনা পাবে।
জাতীয় গ্রন্থ পরিষদ তার কর্মপরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আন্তমন্ত্রণালয় যোগাযোগগুলোও প্রয়োজনমতো এগিয়ে নিতে পারবে। এই পরিষদের বাজেট এবং কীভাবে এই প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় রাখা হবে, সেই রূপরেখা গঠন করাও খুব কঠিন কাজ হবে না। সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে, এমন স্বায়ত্তশাসিত গ্রন্থ পরিষদের নজির ভারত, সিঙ্গাপুর, মিসর, নাইজেরিয়া ও ফিলিপাইনে আছে।
সমাজ বা রাষ্ট্রের মধ্যে বহু চিন্তা, ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির মানুষকে আমরা যতটা যত্নের সঙ্গে লালন করব, আর্থসামাজিক অবস্থাননির্বিশেষে তাদের কাছে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোকবর্তিকা পৌঁছে দেব, ততটাই জ্ঞানভিত্তিক হিসেবে গড়ে উঠবে সেই সমাজ বা রাষ্ট্র।
বাংলাদেশের নানান সময়ের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও অগ্রাধিকারেও কখনো কখনো ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ’-এর বুলিসর্বস্ব প্রতিশ্রুতি দেখা গেছে, কিন্তু কার্যত তার প্রতিফলন ঘটতে আমরা দেখিনি। শিক্ষাক্ষেত্র নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে একের পর এক, এখনো এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা আমরা প্রণয়ন করতে পারিনি, যাকে বলা যায় গণমুখী, বৈষম্যহীন এবং দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ তৈরির জন্য উপযুক্ত একটি ব্যবস্থা। সংস্কৃতি ও শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেট বরাদ্দের পরিস্থিতি দেখলেই মনে হয় যে লেখক, গবেষক, প্রকাশক, গায়ক, শিল্পী, আঁকিয়ে, চলচ্চিত্র নির্মাতা, থিয়েটারকর্মী—এঁদের সবাইকে রাষ্ট্র একরকম দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করে।
অথচ জাতির আত্মপরিচয় ও স্বকীয়তা নির্মাণে এই গোষ্ঠীর অবদান ও প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। আমাদের হৃত আত্মপরিচয় ও ঐতিহাসিক মর্যাদা পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষার মেলবন্ধন ঘটানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী একটি গ্রন্থনীতি, মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও পেশাদার প্রকাশক গোষ্ঠী, যাদের একাংশ অবশ্যই জ্ঞানভিত্তিক বই নির্মাণে নেতৃত্ব দেবে।
মাহ্রুখ মহিউদ্দিন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ত য় গ রন থ প রস ত ব বর দ দ র জন য আম দ র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম চার ব্যাটসম্যানের ৮০ ছাড়ানো ইনিংস, পাঁচ ফিফটি—বাংলাদেশের যত রেকর্ড
মাহমুদুল হাসান ১৭১
সাদমান ইসলাম ৮০
মুমিনুল হক ৮২
নাজমুল হোসেন ১০০
সিলেট টেস্টে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে নিজেদের প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের প্রথম চার ব্যাটসম্যানের রান।
টেস্টে এই প্রথম এক ইনিংসে বাংলাদেশের প্রথম চার ব্যাটসম্যানই ফিফটি পেলেন। তবে টেস্ট ইতিহাসে এক ইনিংসে কোনো দলের প্রথম চার ব্যাটসম্যানের ফিফটি পাওয়া নতুন কিছু নয়। এ পর্যন্ত ৮৩ বার এক ইনিংসে প্রথম চার ব্যাটসম্যানকে ফিফটি করতে দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট।
প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানই ফিফটি পেয়েছেন ২৪ট ইনিংস। প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের ফিফটি পাওয়ার ঘটনা ৬টি। প্রথম সাত ব্যাটসম্যানের ফিফটি পাওয়ার ঘটনাও আছে একটি।
২০০৫ সালে করাচিতে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম সাত ব্যাটসম্যানই ৫০ ছাড়িয়েছিলেন