যুক্তরাষ্ট্রে প্রার্থীরা কীভাবে জোহরান মামদানির প্রচার কৌশল কাজে লাগাচ্ছেন
Published: 13th, November 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র জোহরান মামদানি ৪ নভেম্বরের নির্বাচনে এক বিশেষ অনলাইন প্রচার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। এটি এখন ডিজিটাল যুগের প্রার্থীদের জন্য অনুকরণীয় মডেল হয়ে উঠেছে।
২০২৫ সালের প্রচার-প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রার্থী ক্যামেরার দিকে ঝুঁকে কথা বলছেন, হাত নাড়ছেন, হাঁটতে হাঁটতে ব্যস্ত রাস্তা বা দোকানের ভেতর কথা বলছেন। ভিডিওগুলোতে উষ্ণ রঙের আলো বা ‘ওয়ার্ম ফিল্টার’ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ছবিকে প্রাণবন্ত করে তুলছে। প্রার্থীরাও এক নিঃশ্বাসে বলছেন নানা প্রতিশ্রুতি ও নীতির কথা।
নিচে দেখা যাক, কীভাবে কিছু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অনলাইনে জোহরান মামদানির কৌশল অনুসরণ করছেন।
মামদানির নান্দনিক ধরন
মামদানির ভিডিওগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো এর উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় রং। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আধেয়ের ভিড়ের মধ্যেও সহজেই চোখে পড়ে।
এসব ভিডিওতে থাকে দ্রুত দৃশ্যের পরিবর্তন আর বড় বড় হাতের অঙ্গভঙ্গি। এক ভিডিওতে মামদানি নিজেই মজা করে বলছিলেন, ‘আমার টিম বলে, আমি নাকি হাত বেশি নাড়ি!’
মামদানির ভিডিওগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো এর উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় রং। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আধেয়ের ভিড়ের মধ্যেও সহজেই চোখে পড়ে।এ ধরন সফল হয়েছে অন্য অনেক ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর ক্ষেত্রেও। মিশিগানের ডেমোক্রেটিক সিনেট প্রাইমারির দুই প্রগতিশীল প্রার্থী এর ভালো উদাহরণ।
ডেট্রয়েটের সাবেক জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবদুল এল-সায়েদ একটি ভিডিও বানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ‘বার্গার’ ব্যবহার করে বিলিয়নিয়ারদের অতিরিক্ত ভোগবিলাস বোঝান, যেমন মামদানি একটি ভিডিওতে ‘ম্যাঙ্গো লাসিস’ (দক্ষিণ এশীয় একটি জনপ্রিয় পানীয়) দিয়ে নিউইয়র্কের ‘র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং’ ব্যাখ্যা করেছিলেন।
অন্যদিকে, মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট সিনেটর ম্যালরি ম্যাকমরো তৈরি করেছিলেন এমন একটি ভাইরাল ভিডিও, যেখানে তিনি নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে কথা বলেন। এটি মামদানির বডেগা বা ছোট দোকান ভ্রমণের দৃশ্যগুলো মনে করিয়ে দেয়।
ম্যাকমরো ও টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য জেমস টালারিকোর (২০২৬ সালের সিনেট নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী) উপদেষ্টা ডেমোক্র্যাট কৌশলবিদ অ্যান্ড্রু মামো বলেন, ভিডিওর ভিজ্যুয়াল আকর্ষণই এখন মূল বিষয়।
প্রচার কৌশলটা প্রকৃতপক্ষে মূল বিষয় থেকে জন্ম নেয়। যদি এমন কোনো বার্তা ও কর্মসূচি না থাকে, যা মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, যা দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে কথা বলে, যা এই ভাঙা ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য কিছু উপস্থাপন করে—তাহলে সেটি কাজ করবে না।অ্যান্ড্রু এপস্টাইন, জোহরান মামদানির প্রচার শিবিরের শীর্ষ সহযোগীঅ্যান্ড্রু মামো বলেন, ‘আপনি শুধু প্রাইমারিতে অন্য ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করছেন না। আপনি প্রতিযোগিতা করছেন রিপাবলিকানদের সঙ্গেও নয়; বরং কুকুরের ভিডিও, খেলাধুলার হাইলাইটস, নেটফ্লিক্সে চলা শো, ফেসটাইম কল, গ্রুপ চ্যাট—সবকিছুর সঙ্গেই। এখন ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব—সব স্ক্রিনে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণের লড়াই।’
মূলবার্তা: জীবনযাত্রার খরচ
মামদানির প্রচার শিবির বলছে, শুধু ভিজ্যুয়াল নয়, তাঁর সফলতার মূলে ছিল ‘সহনীয় জীবনযাত্রার খরচ’কে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক বার্তা।
প্রচার শিবিরের শীর্ষ সহযোগী অ্যান্ড্রু এপস্টাইন বলেন, ‘প্রচার কৌশলটা প্রকৃতপক্ষে মূল বিষয় থেকে জন্ম নেয়। যদি এমন কোনো বার্তা ও কর্মসূচি না থাকে; যা মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, যা দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে কথা বলে, যা এই ভাঙা ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য কিছু উপস্থাপন করে—তাহলে সেটি কাজ করবে না।’
মামদানির প্রচার শিবির বলছে, শুধু ভিজ্যুয়াল নয়, তাঁর সফলতার মূলে ছিল ‘সহনীয় জীবনযাত্রার খরচ’কে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক বার্তা।আবদুল এল-সায়েদের যোগাযোগ পরিচালক রক্সি রিচনারও মামদানির দলের মতোই বিষয়বস্তুর গুরুত্বের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত মানুষ আসলে বিষয়বস্তুকেই গুরুত্ব দেয়। যেমন এল-সায়েদ এক ভিডিওতে মিশিগানের বে সিটির সেতুগুলো কীভাবে বেসরকারিকরণ করা হয়েছে, সেটি এমনভাবে বুঝিয়েছেন যে সাধারণ মানুষও সহজেই ধরতে পেরেছেন; এমনকি যাঁরা অন্য অঞ্চলের, তাঁরাও নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন।’
আরও পড়ুনদাড়ি রেখে ইতিহাসে স্থান করে নিতে চলেছেন জোহরান মামদানি২২ ঘণ্টা আগেরাজনীতিকদের মধ্যে এখন অর্থনীতি নিয়ে ভোটারদের উদ্বেগের প্রসঙ্গে কথা বলা নতুন কিছু নয়। কিন্তু কৌশলবিদেরা বলছেন, মামদানি দেখিয়েছেন, কীভাবে বিষয়টি নির্দিষ্ট ও বাস্তব করে তুলতে হয়, যেমন বাড়িভাড়া, বাসভাড়া বা দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম।
অ্যান্ড্রু মামো বলেন, ‘প্রচারে শুধু সার্বিক “অর্থনৈতিক সংকট” নিয়ে কথা বললে হবে না। এটা এমন হতে হবে যে, “আমার নতুন ডিওডোরেন্ট দরকার, দাম ১৩ দশমিক ৯৯ ডলার। ডিওডোরেন্টের দাম এত কবে হলো?” বলতে হবে এভাবে। আপনি যদি কোথাও বসে কাউকে বলতেন, এমন করেই বলতেন। তাই ভিডিওতেও একইভাবে বলা উচিত, যেমন আপনি প্রতিবেশী বা অপরিচিত কাউকে সরাসরি বুঝিয়ে বলতেন।’
এবারের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে, ডেমোক্র্যাট পার্টির এখন প্রয়োজন এমন দক্ষ বক্তা ও যোগাযোগকারীদের, যাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেন।রক্সি রিচনার, মিশিগানের ডেমোক্রেটিক সিনেট প্রাইমারির প্রগতিশীল প্রার্থী আবদুল এল-সায়েদের যোগাযোগ পরিচালকঅনুকরণ, অনুলিপি নয়
এই গ্রীষ্মে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে মামদানির কাছে হেরে যাওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমোও হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা এবং মৃদু আলোতে ফিল্টার করা ভিডিও বানাতে শুরু করেন। মামদানির দল তা খেয়াল করেছে।
অ্যান্ড্রু এপস্টাইন বলেন, ‘বলা হয়, অনুকরণই নাকি প্রশংসার সেরা রূপ। কিন্তু অ্যান্ড্রুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা প্রশংসার চেয়ে অনেক বেশি করুণ।’
অন্য কৌশলবিদেরা বলছেন, প্রচারে সত্যিকারের বিশ্বাসযোগ্যতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রান্তের প্রার্থীদের পটভূমি, ইস্যু ও বাস্তবতা আলাদা।
মামো বলেন, ‘এটা (প্রচার কৌশল) আপনার নিজের মতো হতে হবে।’ তিনি উদাহরণ দেন ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর অ্যাডাম শিফের। তিনি একজন আইনজীবী, অধ্যাপক, ব্যাখ্যাকার। তাই তাঁর ভিডিওতেও সেই ‘আইনজীবী-অধ্যাপক-ব্যাখ্যাকার’ স্টাইলটা থাকে। অ্যাডাম শিফ যেমন কংগ্রেসে কী হচ্ছে, সেটি বুঝিয়ে থাকেন।
আরও পড়ুনজোহরান মামদানির সাফল্যে ডেমোক্র্যাটদের উচ্ছ্বাস; কিন্তু ক্ষমতায় ফেরা কি সহজ হবে০৮ নভেম্বর ২০২৫রক্সি রিচনার বলেন, এবারের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে, ডেমোক্র্যাট পার্টির এখন প্রয়োজন এমন দক্ষ বক্তা ও যোগাযোগকারীদের, যাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেন।
রিচনার বলেন, ‘হোক সেটা নিউ জার্সিতে বিদ্যুতের বিল কমানো কিংবা নিউইয়র্কে বাস দ্রুত ও বিনা ভাড়ায় চালানো। মানুষ এখন কষ্টে আছে। তাঁরা বিশ্বাস করতে চান, পরিস্থিতি বদলাতে পারে। আর সেই বিশ্বাস জাগাতে দরকার এমন নেতাদের, যাঁরা তা দেখাতে পারেন।’
আরও পড়ুনজোহরান মামদানিকে ভোট দিয়েছেন ৯৭ শতাংশ মুসলিম ভোটার১১ নভেম্বর ২০২৫আরও পড়ুনজোহরান মামদানির কাজে কীভাবে ট্রাম্প বাগড়া দিতে পারেন ১১ নভেম্বর ২০২৫.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দাড়ি রেখে ইতিহাসে স্থান করে নিতে চলেছেন জোহরান মামদানি
নিউইয়র্ক সিটি এবার শুধু প্রথম মুসলিম মেয়রই পাচ্ছে না। জোহরান মামদানি হচ্ছেন শহরের প্রথম দক্ষিণ এশীয়, প্রথম আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মেয়র; সঙ্গে এক শতাব্দীর বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ মেয়রও।
অভিষেকের আগে যদি হঠাৎ চুল-দাড়ি কাটার বড় কোনো সিদ্ধান্ত না নেন, তবে জোহরান হবেন ১৯১৩ সালে মারা যাওয়া উইলিয়াম জে গেনরের পর নিউইয়র্কের প্রথম শ্মশ্রুমণ্ডিত মেয়র। যদিও শতভাগ নিশ্চিত করে বলা কঠিন যে এরপর কোনো মেয়রের মুখে দাড়ি ছিল না। তবে মেয়রদের অফিশিয়াল প্রতিকৃতি ঘেঁটে দেখা যায়, সবাই ছিলেন দাড়ি–গোঁফ ছাড়া। শুধু ডেভিড ডিঙ্কিন্সের গোঁফ ছিল ব্যতিক্রম।
জোহরানের দাড়ি দেখতে জে গেনরের মতো হলেও তার বিশেষত্ব একেবারেই ভিন্ন। গেনর যখন ১৯০৯ সালে নির্বাচিত হন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৬০ বছর। তাঁর ধূসর-সাদা, ছাঁটা দাড়ি আর সিল্কের টুপি তাঁকে এক পরিণত মানুষ হিসেবে তুলে ধরত।
আরও পড়ুনজোহরান মামদানির কাজে কীভাবে ট্রাম্প বাগড়া দিতে পারেন ১৯ ঘণ্টা আগেতখনকার সংস্কৃতিও ছিল অন্য রকম। গেনরকে নিয়ে ১৯৫১ সালের এক জীবনীতে বলা হয়, সে সময় যাঁরা পূর্ণ ‘ভ্যানডাইক’ দাড়ি রাখতেন, তাঁদের অনেকে সমাজে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন। এ দাড়ি তাঁকে একজন সফল ব্যবসায়ী, ওয়াল স্ট্রিটের মধ্যস্থতকারী কিংবা অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবেই উপস্থাপন করত।
২০১৩ সালে একটি প্রবন্ধে জোহরান লিখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এক বছর আগেই দাড়ি রাখতে শুরু করেন তিনি। মূলত এটা ছিল দেশে প্রচলিত সেই ধারণার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতীকী প্রতিবাদ, যা অনেক সময় প্রকাশ্যে বলা হয় না, কিন্তু অনেকেই মেনে নেন—‘বাদামি গায়ের রং আর দাড়ি? মানে সন্ত্রাসী!’অন্যদিকে জোহরান এখন ৩৪ বছরের তরুণ, মিলেনিয়াল প্রজন্মের প্রতিনিধি। তাঁর দাড়ি যেন পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামো বদলে দেওয়ার অঙ্গীকারের প্রতীক। এ অর্থে তাঁর দাড়ি বর্তমান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স কিংবা কিছুটা বয়স্ক ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রের দাড়ির মতোও নয়।
আরও পড়ুনজোহরান মামদানিকে ভোট দিয়েছেন ৯৭ শতাংশ মুসলিম ভোটার১১ নভেম্বর ২০২৫ওই দুই ব্যক্তি (ভ্যান্স ও ট্রাম্প জুনিয়র) শ্বেতাঙ্গ আর জোহরান একজন বাদামি চামড়ার মুসলিম। যুক্তরাষ্ট্রে শ্মশ্রুমণ্ডিত বাদামি মুসলমান হওয়া মানে কী, সেটি তিনি খুব ভালোভাবেই বোঝেন। নিজের ভাবমূর্তি বা জনমত গঠনের কৌশলও তিনি ভালোই জানেন।
১৯১৩ সালে মারা যাওয়া নিউইয়র্কের শ্মম্রুমণ্ডিত মেয়র উইলিয়াম জে গেনরের প্রতিকৃতি