দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবির শিক্ষা–ভাবনা
Published: 13th, November 2025 GMT
মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষার পুনর্জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি বৈপ্লবিক শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা করেন।
তাঁর জীবন ও কর্ম ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ আজও বিশ্বব্যাপী ইসলামি শিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত।
তিনি এক বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব। ভারতবর্ষে ধর্মীয় শিক্ষার একটি নতুন, অনন্য, যুগোপযোগী, কার্যকর এবং ব্যতিক্রমী ধারা চালু করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা–ভাবনা ছিল ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রচার এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন। সে লক্ষ্যে তিনি ১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ শহরে একটি দারুল উলুম প্রতিষ্ঠা করেন; যা ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তাঁর শিক্ষাদর্শনের মূলে ছিল ইসলামি আইন, দর্শন, তাফসির ও হাদিসের গভীর জ্ঞান এবং ধর্মীয় শিক্ষার পুনরুজ্জীবন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ: খণ্ড ২, পৃ.
মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) ১৮৪৯ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তখন মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। ব্রিটিশরা বিভিন্ন প্রদেশ দখল করে দিল্লি পৌঁছেছিল। বাহাদুর শাহ জাফরকে লালকেল্লায় অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে পরাধীন হলো। এদিকে মুসলমানরাও সচেতন হলেন। তারা সর্বস্ব ত্যাগ স্বীকার করে হলেও দেশ স্বাধীন করতে চাইলেন।
ইংরেজরা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দখলে নিতে সম্ভাব্য সব চেষ্টা চালায়। দিল্লি, আগ্রা, মুলতান, খায়রাবাদ, বাংলা ও বিহারের মাদ্রাসাগুলো দিল্লির সুলতান ও অভিজাতদের দানকৃত সম্পত্তি থেকে পরিচালিত হতো। ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকার সেগুলো বাজেয়াপ্ত করল। (ডক্টর সাদেক হুসাইন, হামারে হিন্দুস্তানি মুসলমান, পৃষ্ঠা ২০০)।
সে সময় মুসলমানদের শিক্ষার পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর ভাষণ থেকে অনুমান করা যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের আগে দেশে ৩০ হাজার মাদ্রাসা ছিল। যেখানে দুই লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। আজ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় হাজার মাদ্রাসার কথা খুব কমই উল্লেখ করতে পারে।’ (আগ্রা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র মুসাফির: ৩ ডিসেম্বর, ১৯২০)
তখন ইংরেজ সরকার আধুনিক শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করছিল। ধর্মীয় শিক্ষাকে নির্মূল করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) এমন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার গুরুত্ব অনুভব করলেন, যা হবে সরকারি সাহায্যমুক্ত। যেন ভবিষ্যতে এগুলো কোনো হুমকির মুখে না পড়ে।
তাই দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার ‘উসুলে হাশতেগানা’ বা অষ্ট মূলনীতিতে মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) বলেছেন, ‘দারুল উলুমকে সরকারি সাহায্যমুক্ত রাখা হবে।’ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ধর্মীয় শিক্ষা প্রচারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এতে জনগণ ও আলেমদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হবে।
সরকারি হস্তক্ষেপ না থাকায় শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ, তখন ধর্মীয় শিক্ষার সুরক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে একে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল। (মাওলানা আসির আদরবি, মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি—হায়াত আওর কারনামে, পৃ. ১৫৮)
আরও পড়ুনআল্লামা শিবলি নোমানির ভাবনায় আধুনিক শিক্ষা০৭ অক্টোবর ২০২৫পাঠ্যক্রম নিয়ে চিন্তা-দর্শনসেকালে খায়রাবাদ ও লক্ষ্ণৌর মাদ্রাসাগুলোয় যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন পড়ানো হতো। ফিরিঙ্গি মহল্লে আইনশাস্ত্রের শিক্ষাও পরিচালিত হতো। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.) ও তাঁর পরিবার দিল্লি ও তাঁর আশপাশে হাদিস-তাফসিরের খেদমত করছিলেন। কিন্তু এ খেদমত তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) ছিলেন সর্বজনীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও মধ্যপন্থী আলেম। তিনি দারুল উলুমের পাঠ্যক্রমে যুক্তি ও দর্শনের ওপর জোর কমিয়ে দিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.)-এর হাদিস ও তাফসিরের কিতাবপত্র পাঠ্যক্রমে যুক্ত করলেন। ফিকহ ও অন্যান্য ধর্মীয় শাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবে তাঁর তৈরি করা পাঠ্যক্রম অনন্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়। (মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব নানুতবি, হালাতে তাইয়িব—হজরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি, পৃ. ৫২)
সমসাময়িক শিক্ষা ও পাঠ্যধারায় পরিবর্তন প্রসঙ্গমাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) দারুল উলুমের পাঠ্যক্রমে আরবি, ফারসি, কোরআন-হাদিস, আইনশাস্ত্র ইত্যাদি অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি গণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসা ও বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করেন। দেওবন্দি চিন্তাধারার ভাষ্যকার ও ব্যাখ্যাকার হিসেবে পরিচিত মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি (রহ.) লেখেন, ‘এ পাঠ্যক্রমে পড়াশোনা করে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা আধুনিক জ্ঞানার্জনের দক্ষতা হাসিল করতে পারেন।’ (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮০)
আমরা আধা গাঙে সাঁতার কাটা জনবল তৈরি করতে পারি না। উভয় ধারার শিক্ষা মিশ্রণের ফলে শিক্ষার্থী কোনো জ্ঞানে পূর্ণতা পাবে না। সে আধুনিক জ্ঞান বা প্রাচীন জ্ঞানও অর্জন করতে পারবে না।মাওলানা আসির আদরবি (রহ.)নানুতবি (রহ.)-এর শিক্ষা–ভাবনার সারসংক্ষেপ এবং মাওলানা গিলানি (রহ.)-এর বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয়, তিনি আধুনিক শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিলেন না। পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা ও সমসাময়িক বিষয়গুলোও পাঠ্যক্রমের অংশ করা বিষয়ে তিনি অজ্ঞ ছিলেন না। তাঁর দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এ সম্পর্কে সচেতন ছিল।
তাই এর স্পষ্ট উত্তর দিয়েছিলেন তিনি। যা মাওলানা আসির আদরবি (রহ.) উদ্ধৃত করেছেন, ‘আমরা আধা গাঙে সাঁতার কাটা জনবল তৈরি করতে পারি না। উভয় ধারার শিক্ষা মিশ্রণের ফলে শিক্ষার্থী কোনো জ্ঞানে পূর্ণতা পাবে না। সে আধুনিক জ্ঞান বা প্রাচীন জ্ঞানও অর্জন করতে পারবে না।’ (মাওলানা আসির আদরবি, মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি—হায়াত আওর কারনামে, পৃ. ১৬২)।
মাওলানা নানুতবি (রহ.) বলেছেন, ‘একই সময়ে অনেক জ্ঞানার্জন করা সমস্ত জ্ঞানে দক্ষতা হারানোর মতো।’ (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮৩)
প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষা বিষয়ে ভাবনানানুতবি (রহ.) যখন দারুল উলুম প্রতিষ্ঠা করেন, তখন ধর্মীয় শিক্ষার সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য ধর্মীয় শিক্ষায় গুরুত্বারোপ দরকার ছিল। এ কারণে তিনি দারুল উলুমের পাঠ্যক্রম কয়েকটি সমসাময়িক বইয়ে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।
কিন্তু আধুনিক শিক্ষার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন না; বরং স্যার সৈয়দের গড়া প্রতিষ্ঠানের যথাসম্ভব প্রশংসা করেছিলেন। মাওলানা আসির আদরবি (রহ.) লিখেছেন, ‘নানুতবি (রহ.) ইংরেজি শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রতি অসম্মতি প্রকাশ করেননি; বরং স্যার সৈয়দ ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে প্রথম, যিনি চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁর সংগ্রাম ও অধ্যবসায় প্রশংসিত হয়েছিল।’ (মাওলানা আসির আদরবি, মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি—হায়াত আওর কারনামে, পৃ. ২১৯)।
আরও পড়ুনশিক্ষা নিয়ে ইবনে খালদুনের ভাবনা০৪ অক্টোবর ২০২৫যদিও নানুতবি (রহ.) ধর্মীয় ও সমসাময়িক জ্ঞানের মিশ্রণ করেননি; কিন্তু তিনি কখনো এর গুরুত্ব অস্বীকার করেননি; বরং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল—যাঁরা সমসাময়িক জ্ঞানার্জন করতে চান, মাদ্রাসা পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করে তা হাসিল করা উচিত। তিনি এটিকে উৎসাহিত করতেন। বলতেন, ‘দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাক্রম সম্পন্ন করার পর যদি শিক্ষার্থীরা সরকারি মাদ্রাসায় যায় এবং আধুনিক জ্ঞানার্জন করে, তাহলে তাদের আরও পূর্ণতা আসবে।’ (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮১)
মাওলানা গিলানি (রহ.) এ কথার ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘প্রথমে ধর্মীয় ও ইসলামি জ্ঞানের পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কারণ, এগুলো ছাড়া বিশুদ্ধ ইসলামি জ্ঞান, তাফসির, হাদিসের ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র ইত্যাদি অধ্যয়নের যথাযথ দক্ষতা বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়। এরপর আধুনিক জ্ঞানার্জনের জন্য সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়া উচিত।’ (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮৫)
ধর্মীয় স্কুলের পাঠ্যক্রমে এমন কিছু বইপত্র যোগ করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে শিশুরা সমসাময়িক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারবে। যদি তারা আধুনিক স্কুলে যায়, তাহলে সহজেই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে।শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শমাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.)-এর শিক্ষা–ভাবনা ছিল সুদূরপ্রসারী চিন্তাপ্রসূত। সেগুলোর আলোকে মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি (রহ.) শিক্ষাধারায় অন্তর্ভুক্ত করার মতো কিছু প্রস্তাব রেখেছেন। যেমন—
ধর্মীয় শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। কারণ, ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে অস্তিত্ব, বিশ্বাস ও সভ্যতা সংকটে পড়বে। তা ছাড়া ধর্মীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত কেউ মুসলমান থাকতে পারে না। তাই শিশুদের প্রথমে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া উচিত। আল্লামা ইকবাল কত সুন্দর বলেছেন, ‘যদি সে আল্লাহর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়, তাহলে শিক্ষাও ফেতনা। যদি সে অন্যায়কারীদের পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে তরবারিও ফেতনা। অথচ তাকবিরের স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত তরবারিও কি ফেতনা?’
স্যার সৈয়দ যখন আধুনিক জ্ঞানের প্রতিষ্ঠান করলেন, তখন মাওলানা নানুতবি (রহ.) তাঁর প্রশংসা করেছিলেন। তাই আধুনিক প্রতিষ্ঠান করা দরকার। এতে উৎসাহিত করা চাই। এমনকি আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মীয় শিক্ষা সিলেবাস যুক্ত থাকা চাই। যেন শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।
প্রথমে জেনারেল শিক্ষা, তারপর ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, শৈশবে প্রদত্ত শিক্ষা হৃদয়ে এমনভাবে ছাপিয়ে যায়, পরে সে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয় না। প্রায়ই এমন ঘটে, শিশুদের আধুনিক শিক্ষা দেওয়া হয় এবং কোরআন ও প্রয়োজনীয় মৌলিক শিক্ষা বাড়িতে একজন আলেম বা হাফেজ দ্বারা শেখানো হয়; কিন্তু এতে খুব বেশি লাভবান হয় না। শিশুদের মধ্যে ইসলামি চেতনা জাগে না।
আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা সম্পন্ন করার পর, শিক্ষার্থীরা আধুনিক জ্ঞান অধ্যয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে যেতে পারে। একইভাবে আধুনিক জ্ঞান অধ্যয়নের পর, শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় আসা উচিত। যেখানে তারা তাদের শিক্ষার প্রভাব প্রতিষ্ঠা করবে এবং তাদের দক্ষতা আরও বিকশিত করবে। ধর্ম ও শরিয়াহর পণ্ডিত হওয়ার পাশাপাশি তারা সময়ের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জগুলোও গ্রহণ করতে পারবে।
ধর্মীয় স্কুলের পাঠ্যক্রমে এমন কিছু বইপত্র যোগ করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে শিশুরা সমসাময়িক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারবে। যদি তারা আধুনিক স্কুলে যায়, তাহলে সহজেই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে। আর যদি তারা আধুনিক স্কুলে না–ও যায়, তবু এ শিক্ষা তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
কিন্তু এ অন্তর্ভুক্তি এমন পরিমাণে হওয়া উচিত, যেন ধর্মীয় শিক্ষার পরিপক্বতায় কোনো অন্তরায় না হয়। উদাহরণস্বরূপ—প্রথম কয়েকটি ক্লাসে কয়েকটি মৌলিক ইংরেজি বইপত্র পড়ানো উচিত। যেন শিক্ষার্থীরা এ ভাষার সঙ্গে কিছুটা পরিচিতি অর্জন করতে পারে এবং সামান্য হলেও তাদের পার্থিব চাহিদা পূরণ করতে পারে। (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮০-২৮৫)
আরও পড়ুন ইমাম গাজালি ও তাঁর শিক্ষাদর্শন১২ এপ্রিল ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ক জ ঞ ন র জন র জন করত কর ছ ল ন ম সলম ন র জন য ক ত কর প রথম ন করত আরও প ইসল ম সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবির শিক্ষা–ভাবনা
মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষার পুনর্জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি বৈপ্লবিক শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা করেন।
তাঁর জীবন ও কর্ম ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ আজও বিশ্বব্যাপী ইসলামি শিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত।
তিনি এক বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব। ভারতবর্ষে ধর্মীয় শিক্ষার একটি নতুন, অনন্য, যুগোপযোগী, কার্যকর এবং ব্যতিক্রমী ধারা চালু করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা–ভাবনা ছিল ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রচার এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন। সে লক্ষ্যে তিনি ১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ শহরে একটি দারুল উলুম প্রতিষ্ঠা করেন; যা ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তাঁর শিক্ষাদর্শনের মূলে ছিল ইসলামি আইন, দর্শন, তাফসির ও হাদিসের গভীর জ্ঞান এবং ধর্মীয় শিক্ষার পুনরুজ্জীবন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ: খণ্ড ২, পৃ. ২৭০-২৭১)
দিল্লি, আগ্রা, মুলতান, খায়রাবাদ, বাংলা ও বিহারের মাদ্রাসাগুলো দিল্লির সুলতান ও অভিজাতদের দানকৃত সম্পত্তি থেকে পরিচালিত হতো। ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকার সেগুলো বাজেয়াপ্ত করল।শিক্ষা নিয়ে ভাবনার প্রেক্ষাপটমাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) ১৮৪৯ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তখন মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। ব্রিটিশরা বিভিন্ন প্রদেশ দখল করে দিল্লি পৌঁছেছিল। বাহাদুর শাহ জাফরকে লালকেল্লায় অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে পরাধীন হলো। এদিকে মুসলমানরাও সচেতন হলেন। তারা সর্বস্ব ত্যাগ স্বীকার করে হলেও দেশ স্বাধীন করতে চাইলেন।
ইংরেজরা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দখলে নিতে সম্ভাব্য সব চেষ্টা চালায়। দিল্লি, আগ্রা, মুলতান, খায়রাবাদ, বাংলা ও বিহারের মাদ্রাসাগুলো দিল্লির সুলতান ও অভিজাতদের দানকৃত সম্পত্তি থেকে পরিচালিত হতো। ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকার সেগুলো বাজেয়াপ্ত করল। (ডক্টর সাদেক হুসাইন, হামারে হিন্দুস্তানি মুসলমান, পৃষ্ঠা ২০০)।
সে সময় মুসলমানদের শিক্ষার পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর ভাষণ থেকে অনুমান করা যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের আগে দেশে ৩০ হাজার মাদ্রাসা ছিল। যেখানে দুই লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। আজ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় হাজার মাদ্রাসার কথা খুব কমই উল্লেখ করতে পারে।’ (আগ্রা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র মুসাফির: ৩ ডিসেম্বর, ১৯২০)
তখন ইংরেজ সরকার আধুনিক শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করছিল। ধর্মীয় শিক্ষাকে নির্মূল করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) এমন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার গুরুত্ব অনুভব করলেন, যা হবে সরকারি সাহায্যমুক্ত। যেন ভবিষ্যতে এগুলো কোনো হুমকির মুখে না পড়ে।
তাই দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার ‘উসুলে হাশতেগানা’ বা অষ্ট মূলনীতিতে মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) বলেছেন, ‘দারুল উলুমকে সরকারি সাহায্যমুক্ত রাখা হবে।’ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ধর্মীয় শিক্ষা প্রচারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এতে জনগণ ও আলেমদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হবে।
সরকারি হস্তক্ষেপ না থাকায় শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ, তখন ধর্মীয় শিক্ষার সুরক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে একে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল। (মাওলানা আসির আদরবি, মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি—হায়াত আওর কারনামে, পৃ. ১৫৮)
আরও পড়ুনআল্লামা শিবলি নোমানির ভাবনায় আধুনিক শিক্ষা০৭ অক্টোবর ২০২৫পাঠ্যক্রম নিয়ে চিন্তা-দর্শনসেকালে খায়রাবাদ ও লক্ষ্ণৌর মাদ্রাসাগুলোয় যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন পড়ানো হতো। ফিরিঙ্গি মহল্লে আইনশাস্ত্রের শিক্ষাও পরিচালিত হতো। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.) ও তাঁর পরিবার দিল্লি ও তাঁর আশপাশে হাদিস-তাফসিরের খেদমত করছিলেন। কিন্তু এ খেদমত তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) ছিলেন সর্বজনীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও মধ্যপন্থী আলেম। তিনি দারুল উলুমের পাঠ্যক্রমে যুক্তি ও দর্শনের ওপর জোর কমিয়ে দিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.)-এর হাদিস ও তাফসিরের কিতাবপত্র পাঠ্যক্রমে যুক্ত করলেন। ফিকহ ও অন্যান্য ধর্মীয় শাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবে তাঁর তৈরি করা পাঠ্যক্রম অনন্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়। (মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব নানুতবি, হালাতে তাইয়িব—হজরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি, পৃ. ৫২)
সমসাময়িক শিক্ষা ও পাঠ্যধারায় পরিবর্তন প্রসঙ্গমাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) দারুল উলুমের পাঠ্যক্রমে আরবি, ফারসি, কোরআন-হাদিস, আইনশাস্ত্র ইত্যাদি অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি গণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসা ও বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করেন। দেওবন্দি চিন্তাধারার ভাষ্যকার ও ব্যাখ্যাকার হিসেবে পরিচিত মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি (রহ.) লেখেন, ‘এ পাঠ্যক্রমে পড়াশোনা করে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা আধুনিক জ্ঞানার্জনের দক্ষতা হাসিল করতে পারেন।’ (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮০)
আমরা আধা গাঙে সাঁতার কাটা জনবল তৈরি করতে পারি না। উভয় ধারার শিক্ষা মিশ্রণের ফলে শিক্ষার্থী কোনো জ্ঞানে পূর্ণতা পাবে না। সে আধুনিক জ্ঞান বা প্রাচীন জ্ঞানও অর্জন করতে পারবে না।মাওলানা আসির আদরবি (রহ.)নানুতবি (রহ.)-এর শিক্ষা–ভাবনার সারসংক্ষেপ এবং মাওলানা গিলানি (রহ.)-এর বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয়, তিনি আধুনিক শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিলেন না। পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা ও সমসাময়িক বিষয়গুলোও পাঠ্যক্রমের অংশ করা বিষয়ে তিনি অজ্ঞ ছিলেন না। তাঁর দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এ সম্পর্কে সচেতন ছিল।
তাই এর স্পষ্ট উত্তর দিয়েছিলেন তিনি। যা মাওলানা আসির আদরবি (রহ.) উদ্ধৃত করেছেন, ‘আমরা আধা গাঙে সাঁতার কাটা জনবল তৈরি করতে পারি না। উভয় ধারার শিক্ষা মিশ্রণের ফলে শিক্ষার্থী কোনো জ্ঞানে পূর্ণতা পাবে না। সে আধুনিক জ্ঞান বা প্রাচীন জ্ঞানও অর্জন করতে পারবে না।’ (মাওলানা আসির আদরবি, মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি—হায়াত আওর কারনামে, পৃ. ১৬২)।
মাওলানা নানুতবি (রহ.) বলেছেন, ‘একই সময়ে অনেক জ্ঞানার্জন করা সমস্ত জ্ঞানে দক্ষতা হারানোর মতো।’ (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮৩)
প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষা বিষয়ে ভাবনানানুতবি (রহ.) যখন দারুল উলুম প্রতিষ্ঠা করেন, তখন ধর্মীয় শিক্ষার সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য ধর্মীয় শিক্ষায় গুরুত্বারোপ দরকার ছিল। এ কারণে তিনি দারুল উলুমের পাঠ্যক্রম কয়েকটি সমসাময়িক বইয়ে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।
কিন্তু আধুনিক শিক্ষার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন না; বরং স্যার সৈয়দের গড়া প্রতিষ্ঠানের যথাসম্ভব প্রশংসা করেছিলেন। মাওলানা আসির আদরবি (রহ.) লিখেছেন, ‘নানুতবি (রহ.) ইংরেজি শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রতি অসম্মতি প্রকাশ করেননি; বরং স্যার সৈয়দ ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে প্রথম, যিনি চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁর সংগ্রাম ও অধ্যবসায় প্রশংসিত হয়েছিল।’ (মাওলানা আসির আদরবি, মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি—হায়াত আওর কারনামে, পৃ. ২১৯)।
আরও পড়ুনশিক্ষা নিয়ে ইবনে খালদুনের ভাবনা০৪ অক্টোবর ২০২৫যদিও নানুতবি (রহ.) ধর্মীয় ও সমসাময়িক জ্ঞানের মিশ্রণ করেননি; কিন্তু তিনি কখনো এর গুরুত্ব অস্বীকার করেননি; বরং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল—যাঁরা সমসাময়িক জ্ঞানার্জন করতে চান, মাদ্রাসা পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করে তা হাসিল করা উচিত। তিনি এটিকে উৎসাহিত করতেন। বলতেন, ‘দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাক্রম সম্পন্ন করার পর যদি শিক্ষার্থীরা সরকারি মাদ্রাসায় যায় এবং আধুনিক জ্ঞানার্জন করে, তাহলে তাদের আরও পূর্ণতা আসবে।’ (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮১)
মাওলানা গিলানি (রহ.) এ কথার ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘প্রথমে ধর্মীয় ও ইসলামি জ্ঞানের পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কারণ, এগুলো ছাড়া বিশুদ্ধ ইসলামি জ্ঞান, তাফসির, হাদিসের ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র ইত্যাদি অধ্যয়নের যথাযথ দক্ষতা বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়। এরপর আধুনিক জ্ঞানার্জনের জন্য সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়া উচিত।’ (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮৫)
ধর্মীয় স্কুলের পাঠ্যক্রমে এমন কিছু বইপত্র যোগ করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে শিশুরা সমসাময়িক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারবে। যদি তারা আধুনিক স্কুলে যায়, তাহলে সহজেই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে।শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শমাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.)-এর শিক্ষা–ভাবনা ছিল সুদূরপ্রসারী চিন্তাপ্রসূত। সেগুলোর আলোকে মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি (রহ.) শিক্ষাধারায় অন্তর্ভুক্ত করার মতো কিছু প্রস্তাব রেখেছেন। যেমন—
ধর্মীয় শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। কারণ, ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে অস্তিত্ব, বিশ্বাস ও সভ্যতা সংকটে পড়বে। তা ছাড়া ধর্মীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত কেউ মুসলমান থাকতে পারে না। তাই শিশুদের প্রথমে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া উচিত। আল্লামা ইকবাল কত সুন্দর বলেছেন, ‘যদি সে আল্লাহর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়, তাহলে শিক্ষাও ফেতনা। যদি সে অন্যায়কারীদের পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে তরবারিও ফেতনা। অথচ তাকবিরের স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত তরবারিও কি ফেতনা?’
স্যার সৈয়দ যখন আধুনিক জ্ঞানের প্রতিষ্ঠান করলেন, তখন মাওলানা নানুতবি (রহ.) তাঁর প্রশংসা করেছিলেন। তাই আধুনিক প্রতিষ্ঠান করা দরকার। এতে উৎসাহিত করা চাই। এমনকি আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মীয় শিক্ষা সিলেবাস যুক্ত থাকা চাই। যেন শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।
প্রথমে জেনারেল শিক্ষা, তারপর ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, শৈশবে প্রদত্ত শিক্ষা হৃদয়ে এমনভাবে ছাপিয়ে যায়, পরে সে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয় না। প্রায়ই এমন ঘটে, শিশুদের আধুনিক শিক্ষা দেওয়া হয় এবং কোরআন ও প্রয়োজনীয় মৌলিক শিক্ষা বাড়িতে একজন আলেম বা হাফেজ দ্বারা শেখানো হয়; কিন্তু এতে খুব বেশি লাভবান হয় না। শিশুদের মধ্যে ইসলামি চেতনা জাগে না।
আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা সম্পন্ন করার পর, শিক্ষার্থীরা আধুনিক জ্ঞান অধ্যয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে যেতে পারে। একইভাবে আধুনিক জ্ঞান অধ্যয়নের পর, শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় আসা উচিত। যেখানে তারা তাদের শিক্ষার প্রভাব প্রতিষ্ঠা করবে এবং তাদের দক্ষতা আরও বিকশিত করবে। ধর্ম ও শরিয়াহর পণ্ডিত হওয়ার পাশাপাশি তারা সময়ের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জগুলোও গ্রহণ করতে পারবে।
ধর্মীয় স্কুলের পাঠ্যক্রমে এমন কিছু বইপত্র যোগ করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে শিশুরা সমসাময়িক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারবে। যদি তারা আধুনিক স্কুলে যায়, তাহলে সহজেই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে। আর যদি তারা আধুনিক স্কুলে না–ও যায়, তবু এ শিক্ষা তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
কিন্তু এ অন্তর্ভুক্তি এমন পরিমাণে হওয়া উচিত, যেন ধর্মীয় শিক্ষার পরিপক্বতায় কোনো অন্তরায় না হয়। উদাহরণস্বরূপ—প্রথম কয়েকটি ক্লাসে কয়েকটি মৌলিক ইংরেজি বইপত্র পড়ানো উচিত। যেন শিক্ষার্থীরা এ ভাষার সঙ্গে কিছুটা পরিচিতি অর্জন করতে পারে এবং সামান্য হলেও তাদের পার্থিব চাহিদা পূরণ করতে পারে। (মাওলানা সাইয়িদ মানাজির আহসান গিলানি, সাওয়ানেহে কাসেমি, খণ্ড ২, পৃ. ২৮০-২৮৫)
আরও পড়ুন ইমাম গাজালি ও তাঁর শিক্ষাদর্শন১২ এপ্রিল ২০২৫