স্থপতি থেকে অভিনেতা হোমায়ুন এরশাদি
Published: 13th, November 2025 GMT
তেহরানের শহরতলির নির্জন রাস্তা। একজন চুপচাপ রেঞ্জ রোভার গাড়ি চালাচ্ছেন। না, নেই কোনো ভয়ার্ত বা উৎকণ্ঠার অবয়ব। নির্লিপ্ত। তবে এ পাশে–ও পাশে তাকাচ্ছেন। খুঁজছেন তিনি কাউকে। কে তিনি? একের পর এক ল্যান্ডস্কেপ। মরুভূমিও রয়েছে। তাঁর নাম বাদি। তিনি আত্মহত্যা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এমন কাউকে খুঁজে ফিরছেন, যিনি তাঁকে একটি চেরিগাছের নিচে সমাহিত করবেন। কিন্তু এমন মানুষ চিনবেন কীভাবে?
প্রথম যে দুই ব্যক্তিকে তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন, তাঁরা রাজি নন। টাকার বিনিময়ে তাঁরা আত্মহত্যায় সহযোগিতা করতে পারবেন না। ধর্মবিশ্বাস এ কাজে তাঁদের বাধা। তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে রাজি করালেন। এই তৃতীয় ব্যক্তি একজন অধ্যাপক। নাম বাঘেরি। অধ্যাপকের রাজি হওয়ার কারণ, তাঁর ছেলে অসুস্থ। সুস্থ করতে অনেক টাকা দরকার। তাঁরও তেমন ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু তিনি রাজি হলেন এ কাজে। টাকার দরকার।
কাজটা তেমন কঠিন নয়। তেহরানের এক জনবিরল এলাকায় বাদি নিজের কবর খুঁড়ে রেখেছেন। অনেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে রাতে কবরে শুয়ে পড়বেন। টাকাপয়সা আর গাড়ি কাছেই রাখবেন। ভোরবেলা অধ্যাপক কেবল তাঁকে মাটিচাপা দেবেন। জাস্ট এটুকুই কাজ। কাজ হলে টাকা আর গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন। তবে তিনি কেন আত্মহত্যা করতে চান, সেটা কাউকেই বলেন না।
মানুষের জীবনে মৃত্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে তা বেদনাদায়কও বটে। কিন্তু বেদনার চেয়েও বড় ট্র্যাজেডি সম্ভবত মৃতের মতো জীবনযাপন। কথাটি চরিত্রগুলোর জন্য যেমন সত্য, তেমনি ছবিটির জন্যও সত্য। কিন্তু জগতের অন্য অনেক কাজের মতো মৃত্যুবরণ করতেও সাহায্যের দরকার হয় (বাদি চাননি তাঁর মৃতদেহটি উন্মুক্ত থাকুক)। স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা কি বলা হয়েছে তবে এ সিনেমায়? আত্মহত্যা করতে চাওয়া বাদি যখন বলেন, ইউ ক্যান্ট ফিল হোয়াট আই ফিল।
কিয়ারোস্তামি পেশাদার অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেননি। তাঁর ছবির অপেশাদার অভিনেতারা ভবিষ্যতে তাঁদের ক্যারিয়ার চালিয়ে যাননি। আমি বলতে পারি যে আমিই একমাত্র অপেশাদার অভিনেতা, যে কিয়ারোস্তামির ছবিতে অভিনয় করার পরেও অভিনয় ক্যারিয়ার চালিয়ে গেছি।হোমায়ুন এরশাদিআব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমা ‘টেস্ট অব চেরি’র মূল গল্প এতটুকুই। বাদির চরিত্রে অভিনয় করেছেন হোমায়ুন এরশাদি।
আব্বাস কিয়ারোস্তামি পরিচালিত ‘টেস্ট অব চেরি’ ছবির সেই অভিনেতা হোমায়ুন এরশাদি আর নেই। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘টেস্ট অব চেরি’ সিনেমার বাদি চরিত্রে অভিনয় করে হোমায়ুন এরশাদি বিশ্বখ্যাতি পান। পরবর্তীকালে ‘দ্য কাইট রানার’ সিনেমায়ও তিনি সফল। এরশাদি ১১ নভেম্বর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
যাঁরা আব্বাস কিয়ারোস্তামির কাজ সম্পর্কে জানেন, তাঁদের কাছে প্রশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু নেতিবাচক পর্যালোচনাও কম হয়নি। দ্য শিকাগো সান-টাইমসে রজার এবার্টের লেখাটি ছিল সবচেয়ে সমালোচনামুখর। ছবিটিকে ফোর স্টারের মধ্যে ওয়ান স্টার দিয়েছেন। এবার্ট ছবিটিকে ‘অত্যন্ত বিরক্তিকর’ বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বুঝতে পারছি, কিয়ারোস্তামি কী করছেন। আমি অধৈর্য হয়ে অ্যাকশন বা ঘটনার জন্য অনুরোধ করছি না। তবে আমার মনে হয়, এখানে কিয়ারোস্তামির স্টাইল একটা আবেগপ্রবণতা; বিষয়বস্তু এটিকে প্রয়োজন মনে করে না এবং এর দ্বারা উপকৃতও হয় না। যদি আমরা বাদির প্রতি সহানুভূতি বোধ করি, তাহলে কি তার সম্পর্কে আরও জানা সাহায্য করবে না? আসলে, তার সম্পর্কে কিছু জানা? প্রথমেই তাকে সমকামী বলে মনে করার উদ্দেশ্য কী?’
পরে এবার্ট ছবিটিকে তাঁর সর্বকালের সবচেয়ে ঘৃণ্য সিনেমার তালিকায় যুক্ত করেন।
রজার এবার্টের কাছে বাদি চরিত্রকে সমকামীও মনে হয়েছে। রজার এবার্টের কথা সত্য মানলে প্রশ্ন জাগবে, বাদি কি তবে রক্ষণশীল সমাজে সমকামিতার গ্লানির জন্য আত্মহত্যার চিন্তায় তাড়িত হয়েছিলেন? এ বিষয়েও পরিষ্কার কোনো বার্তা নেই সিনেমায়।
হোমায়ুন এরশাদি ১৯৪৭ সালের ২৬ মার্চ ইস্পাহানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভেনিসের কা’ ফস্কারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য ইতালিতে চলে যান এবং ১৯৭০ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ইরানি বিপ্লবের পর ১৯৭৯ সালে কানাডায় যাওয়ার আগে তিনি ইরানে ও ইতালিতে স্থপতি হিসেবে কাজ করেন।রেডডিটে ট্রু ফিল্মের সমালোচনায় বলা হয়েছে, আব্বাস কিয়ারোস্তামি বাদি চরিত্রের মাধ্যমে আত্মঘাতী চরিত্রটি অন্বেষণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কখনো সেই জায়গায় ছিলেন না এবং তাই তিনি কেবল একটি অস্পষ্ট ব্যঙ্গচিত্র তৈরি করতে চেয়েছেন সফলভাবে। এ ক্ষেত্রে কিয়ারোস্তামি একেবারেই সফল।
অন্যদিকে হোমায়ুন এরশাদি অভিনীত আরেকটি বিখ্যাত সিনেমা হচ্ছে ‘দ্য কাইট রানার’। এ সিনেমায় দেখা যায়, আফগানিস্তানে সত্তরের দশক থেকে তালেবান শাসনের উত্থান। এই সিনেমার গল্পটি মূলত দুই বন্ধু, আমির ও হাসানের মধ্যকার সম্পর্ক এবং তাদের জীবনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা সোভিয়েত আগ্রাসন, শরণার্থী সংকট এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রে আফগানদের দেশত্যাগের প্রেক্ষাপট কীভাবে রচিত হয়—এ বিষয়ে।
‘দ্য কাইট রানার’ একটি আমেরিকান সিনেমা। মার্ক ফরস্টার পরিচালিত এবং ডেভিড বেনিওফের চিত্রনাট্য থেকে এবং খালেদ হোসেইনির ২০০৩ সালের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এ সিনেমায়ও অভিনয় করে হোমায়ুন এরশাদি প্রশংসিত হন।
মার্ক ফরস্টার পরিচালিত ‘দ্য কাইট রানার’ (২০০৭) ছবিতে হোমায়ুন এরশাদি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ য ক ইট র ন র ন এরশ দ চর ত র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
দিল্লি বিস্ফোরণ নিয়ে অতীতের মতো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কেন দায়ী করছে না মোদি সরকার
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন ভুটান সফরে থাকা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিল্লিতেও একই কথা বললেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। দুজনের কথাতেই স্পষ্ট, দিল্লি পুলিশের অভিমতও তা–ই।
পুলিশ বলছে, সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লির লাল কেল্লার কাছে ভয়াবহ গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু কে বা কারা এর জন্য দায়ী, তা সরকার এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। এখন পর্যন্ত কেউ দায়ও স্বীকার করেনি।
গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন।
প্রধানমন্ত্রী মোদি আজ মঙ্গলবার ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, তদন্তকারী সংস্থাগুলো এই ষড়যন্ত্রের গোড়া পর্যন্ত যাবে। অপরাধীদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
একই সুর শোনা গেছে দিল্লিতে রাজনাথ সিংয়ের কথাতেও। প্রত্যেকেই ষড়যন্ত্র ও নাশকতা নিয়ে সন্দিহান হলেও এই প্রথম দেখা যাচ্ছে, সরকারের কোনো মহল থেকেই চক্রান্তকারী হিসেবে এখনো পাকিস্তান অথবা পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী কোনো সংগঠনকে খাড়া করানো হয়নি।
এই সাবধানতার কারণ কি পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নমনীয় অবস্থান ও জোরালো সমর্থন? জেনারেল আসিম মুনিরের প্রতি পক্ষপাতিত্ব? ট্রাম্পের হুমকিতে পেহেলগামকাণ্ডের পর সামরিক হানা চালানো হুট করে বন্ধ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ বন্ধ করা হয়নি, স্থগিত রাখা হয়েছে শুধু। যেকোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটলে তা আবার শুরু করা হবে। সেই অধিকার ভারতের থাকছে।
পাকিস্তান অথবা ওই দেশে ঘাঁটি গেড়ে থাকা কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে সরাসরি অপরাধী না ঠাওরানোর কারণও কি তাহলে প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণা? কেননা, মোদি সরকারের ভাষায় সীমান্তপারের সন্ত্রাসীদের অপরাধী ঠাওরালে সে ক্ষেত্রে নতুন করে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালু করতে হয়। ট্রাম্পের নেকনজরে থাকা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সে ব্যবস্থা নিতে মোদি এখন প্রস্তুত নন?
বিস্ফোরণের পর এসব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। যেমন উঠে গেছে এই তত্ত্বও, ‘অপারেশন সিঁদুর’–এ লস্কর–ই–তাইয়েবার অবিসংবাদিত নেতা মাসুদ আজহারের পরিবারের ১০ সদস্যের মৃত্যুর বদলা নিতেই এই বিস্ফোরণ। মূল চক্রান্তকারী মাসুদ আজহারের বোন সাদিয়া আজহার, যাঁর স্বামী ইউসুফ আজহার ছিলেন নিহত ১০ জনের একজন।
কারণ যা–ই হোক, সোমবারের ঘটনা যে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর চরম ব্যর্থতা, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিরোধী মহল এ বিষয়ে একমত হলেও এখনই তা বড় করে তুলে ধরতে চাইছে না। কারণটা হলো বিহার নির্বাচন। বিরোধীরা এমন কিছু করতে চায় না, যাতে ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটে। মঙ্গলবার ছিল বিহার ভোটের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে গত কয়েক দিনে ২ হাজার ৯০০ কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার, রোববার ফরিদাবাদের এক বাড়ি থেকে ২৬০ কেজি বিস্ফোরক, একটি একে ৪৭ ও ৮০ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার, একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পরদিনই এই গাড়ি বিস্ফোরণ। এগুলোর একটি অপরটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলেই গোয়েন্দাদের অভিমত। ফলে প্রশ্ন উঠছে, এসব ঘটনা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অজান্তে কী করে ঘটল? কারা এর জন্য দায়ী?
যে গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে, তার মালিকানা অনেকবার বদল হয়েছে। তাঁদের আটক করা হয়েছে। ভুল স্থানে দাঁড় করানোর জন্য গত ২০ সেপ্টেম্বর ওই গাড়ির দেড় হাজার রুপি জরিমানাও হয়। আটক একজন পুলিশি জেরায় জানান, গাড়িটি তিনি পুলওয়ামার একজনকে বিক্রি করেছেন। যদিও কাগজপত্র এখনো হাতবদল হয়নি। যাঁর কাছে বিক্রি করা হয়, তিনি এক চিকিৎসক। নাম উমর মোহাম্মদ।
লাল কেল্লার কাছে থাকা সব সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখে জানা যাচ্ছে, ওই গাড়ি সোমবার লাল কেল্লার কাছে এক জায়গায় প্রায় তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে রওনা দেওয়ার কিছু পরই এক ট্রাফিক সিগন্যালে তা বিস্ফোরণে উড়ে যায়।
ওই বিস্ফোরণের ঘটনা আত্মঘাতী হামলা কি না, তদন্তে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা না হলেও তদন্তকারীরা নিশ্চিত, বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক উদ্ধারের সঙ্গে এ ঘটনা সরাসরি যুক্ত।