বন্ধু হারিয়ে একাকিত্বে ভুগে অভিনয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন তিনি
Published: 13th, November 2025 GMT
ছবি: আইএমডিবি
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অস্বাস্থ্যকর খাবারের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি: আমাদের করণীয়
অংশগ্রহণকারী
মোহাম্মদ শোয়েব
সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
মো. মাহবুবুর রহমান
পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ
মোস্তফা ফারুক আল বান্না
গবেষণা পরিচালক (পুষ্টি), খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট
নাজমা শাহীন
অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খালেদা ইসলাম
অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান , ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শ্যামল কুমার রায়
সহকারী পরিচালক, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান
আনজুমান আরা সুলতানা
সাবেক লাইন ডিরেক্টর, জাতীয় পুষ্টিসেবা
ফারিয়া শবনম
ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (পুষ্টি), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
খালিকুজ্জামান রোমেন রায়হান
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
আসফিয়া আজিম
ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল
মো. আজিজ খান
পুষ্টি কর্মকর্তা (ইসিসিডি), ইউনিসেফ বাংলাদেশ
জি এম রেজা সুমন
প্রজেক্ট ম্যানেজার, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভমড নিউট্রিশন (গেইন)
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনামোহাম্মদ শোয়েব
সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
আমাদের লক্ষ্য জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার কাছে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য পৌঁছে দেওয়া। নিরাপদ খাদ্য শুধু ভেজাল বা দোষযুক্ত খাবারের বিষয় নয়, বরং খাদ্যে অবশ্যই পুষ্টিগুণ থাকা প্রয়োজন।
যদি খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ, চিনি, ট্রান্সফ্যাট বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, সেই খাদ্য অস্বাস্থ্যকর ও তাতে পুষ্টিগুণ নেই।
বাংলাদেশে ‘মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা ২০১৭’ আছে। এই প্যাকেটজাত যেকোনো খাদ্যে পুষ্টি উপাদান যেমন চিনি, লবণ, কার্বোহাইড্রেট ও শক্তির মান স্পষ্টভাবে লেখা থাকতে হবে। ফন্টের সাইজ ১০০ মিলিমিটারের বেশি, যাতে ক্রেতা সহজে পড়তে পারে। উৎপাদন ও মেয়াদকালের তথ্যও থাকতে হবে। এ ছাড়া বাংলা ভাষায় লেবেল থাকা বাধ্যতামূলক। বিদেশি পণ্যেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। আমরা বর্তমানে এই প্রবিধানমালা আধুনিক করছি। এই উদ্যোগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণার ভিত্তিতে আমরা লেবেল ডিজাইন করেছি। এতে সামনের দিকে লেখা থাকবে, যদি চিনি, লবণ বা ফ্যাট বেশি থাকে, ক্রেতা তা সহজে দেখতে পাবে এবং সঠিকভাবে বাছাই করতে পারবে।
জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী সোডিয়াম বেঞ্চমার্ক নির্ধারণের কাজও চলছে। সবকিছুই বাংলাদেশের পরিপ্রক্ষিতে নির্ধারিত হচ্ছে, যাতে অস্বাস্থ্যকর খাদ্য থেকে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সম্ভব হয়।
শিশুদের খাদ্যে লটারির মতো প্রলোভন বন্ধ করা উচিত। নিয়মিত খাদ্য পরীক্ষা করে, অতিরিক্ত নিউট্রিয়েন্ট থাকলে সংশোধন ও জনসচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। টিভি, রেডিও ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। একসঙ্গে কাজ করলে আমরা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য সবার জন্য নিশ্চিত করতে পারব।
মো. মাহবুবুর রহমান
পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ
আমরা, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ মূলত বিভিন্ন সেক্টরের কাজের মধ্যে সমন্বয়, পরিকল্পনা ও নীতি পর্যায়ের অ্যাডভোকেসি করি। আমরা বিশ্বাস করি, পুষ্টি একটি একক খাতের কাজ নয়; এটি বহুমাত্রিক ও আন্তখাতভিত্তিক উদ্যোগের ফল।
আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই, বর্তমানে আমরা ২২টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছি এবং প্রয়োজনে আরও অনেক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই সমন্বিত উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করব। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই সমন্বিতভাবে কাজ করলেই সঠিক ফলাফল পাওয়া সম্ভব।
কৃষিক্ষেত্রে বৈচিত্র এসেছে। আমরা এখন একক ফসলের পরিবর্তে বহুমাত্রিক ফসলের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি, যাতে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য আসে। স্থানীয় সরকার ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা এই কাজগুলোকে আরও বিস্তৃত করতে চাই।
‘ডিস্ট্রিক্ট নিউট্রিশন স্কোরকার্ড’ এখন প্রতিটি জেলায় আছে, যা আমাদের জানাতে সাহায্য করে কোথায় কাজ ভালো হচ্ছে, কোথায় ঘাটতি আছে। এই ডেটা থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, কোন জেলায় কীভাবে আরও উন্নতি করা সম্ভব।
বাজেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ প্রসঙ্গে আমি এটাও স্পষ্টভাবে বলতে চাই, যদি বাজেট না থাকে, তাহলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হবে না। পুষ্টি, খাদ্যনিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিশ্চিত করতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে আলাদা বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে।
আমরা চাই পুষ্টিবিষয়ক কাজ শুধু নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে যাক। একজন কৃষক, একজন শিক্ষক কিংবা একজন অভিভাবক—যে কেউ পুষ্টি নিয়ে কাজ করলে তাঁর গল্পটি সামনে আসুক। এই ইতিবাচক গল্পগুলো অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে। গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে মিডিয়া ও সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মোস্তফা ফারুক আল বান্না
গবেষণা পরিচালক (পুষ্টি), খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির হার ২৪ শতাংশ। নিম্ন আয়ের পরিবারে এই হার ৩৪ শতাংশ, আর ধনী পরিবারের মধ্যে ১৫ শতাংশ। এটি একটি স্পষ্ট চিত্র দেয় যে আর্থিক অবস্থার সঙ্গে পুষ্টিনিরাপত্তার সরাসরি সম্পর্ক আছে। ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের ন্যূনতম খাদ্যবৈচিত্র্য নির্দেশকও উদ্বেগজনক। সবচেয়ে দরিদ্র গোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ শিশু পুষ্টিকর পাঁচ ধরনের খাবার গ্রহণ করতে পারছে না। ধনী শিশুরাও পিছিয়ে নেই—৪৬ শতাংশ এই পাঁচ ধরনের খাবার গ্রহণে ব্যর্থ।
অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রবণতাও সমানভাবে উদ্বেগজনক। ধনী শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ এবং দরিদ্র শিশুদের মধ্যে ৫১ শতাংশ অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করছে। এই প্রেক্ষাপট থেকে বোঝা যায়, পুষ্টিকর খাবার সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করতে আমাদের পদক্ষেপ অপরিহার্য। জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা
ইতিমধ্যে রয়েছে, যেখানে ১০টি নির্দেশিকা ও বয়সভিত্তিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
গত বছর কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে শাকসবজি ও ফলমূল খোলাবাজারে কম দামে বিক্রি করা হয়েছিল। এটি যদি টেকসইভাবে চালানো হয়, তাহলে নিম্ন আয়ের মানুষ নিয়মিতভাবে ফলমূল ও শাকসবজি পাবে। একইভাবে প্রাণিসম্পদ বিভাগের মাধ্যমে মাছ, মাংস ও ডিম সাশ্রয়ী মূল্যে দরিদ্রদের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন।
খাদ্যব্যবস্থার সব স্তরে মনোযোগ দেওয়া দরকার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া উচিত, যাতে তাঁরা বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন করেন। আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার—সাশ্রয়ী মূল্যে পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করে, সব শিশুকে সুস্থ ও ভবিষ্যতের অধিকারী করে তোলা।
শ্যামল কুমার রায়
সহকারী পরিচালক, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান
সম্প্রতি এক কারখানায় গিয়েছিলাম,
যেখানে গেইনের উদ্যোগে কম দামে কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে, যাতে ছিল কম চিনি, কম লবণ, কম ট্রান্সফ্যাট। এ উদ্যোগ আমাকে আশাবাদী করেছে। যদি গোটা দেশেই এমন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে দেশের চেহারাটাই বদলে যেত।
আমি কিছুদিন আগে এসবিসি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম। তার আয়োজক ছিল ইউনিসেফ। সেখানে শিখেছি, আমাদের প্রচারণা সফল হবে তখনই, যখন সমাজের সব অংশীজনকে যুক্ত করতে পারব। ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় প্রভাবশালী—সবাইকে এ প্রচারণায় যুক্ত করতে হবে কারও চেতনায় আঘাত না দিয়ে। তাঁদের মাধ্যমে যদি সঠিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সচেতনতা অনেক বাড়বে।
পুষ্টিবিষয়ক প্রচারে আমাদের মানসিকতাটা ঠিকভাবে তৈরি হয়নি। সে জন্যই বলছি যে আমাদের ভেতর থেকে আসতে হবে। আমাদের মাইন্ডসেট চেঞ্জ করতে হবে। এই প্রচারণা ঘর থেকেই শুরু হওয়া দরকার। মেয়েশিশু, ছেলেশিশু—উভয়কে সমান পুষ্টি দিতে হবে। ঘর থেকেই সমান পুষ্টি দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য অভিভাবদের সচেতনতা জরুরি।
কৃষিক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য দরকার। একই ফসল বারবার ফলালে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়। তেমনি একই ধরনের খাবারে পুষ্টির ভারসাম্য থাকে না। এখন এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে মানুষ জানে না শাকসবজি খাওয়া দরকার। কিন্তু জানা আর মানার মধ্যে ফারাক আছে। আমাদের কাজ এখন এই জ্ঞানকে অভ্যাসে পরিণত করা।
স্বাস্থ্য মানে শুধু রোগমুক্ত থাকা নয়, শরীরের সঠিক ভারসাম্য ও মানসিক প্রশান্তি রক্ষা করা। এই ভারসাম্য তৈরি হবে যখন মিথ্যা প্রচারণা, ভুয়া বিজ্ঞাপন থেকে আমাদের দূরে রাখতে পারব।
নাজমা শাহীন
অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাস্থ্যকর খাবার বা হেলদি ডায়েট নিয়ে আমরা কথা বলছি। হেলদি ডায়েট নিশ্চিত করতে আমাদের ফুড সিস্টেমের তিনটি মূল উপাদান—খাদ্য সহজলভ্যতা, খাদ্য পরিবেশ ও ভোক্তার আচরণ বুঝতে হবে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নের জন্য হেলদি ডায়েট অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, স্বাস্থ্যকর খাবারের পরিবর্তে অস্বাস্থ্যকর বা প্রসেসড খাবারের প্রবণতা বেড়ে চলেছে।
জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা সাম্প্রতিক সময়ে সংশোধিত হয়েছে। বাস্তব জীবনে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার ক্রয় করা কঠিন। ওয়ার্কপ্লেস নিউট্রিশন প্রোগ্রামে পোশাককর্মীদের নিয়ে কাজ করার সময় দেখা গেছে, কর্মজীবী
অনেক মা তাঁর শিশুকে চিপসের প্যাকেট দেন। একটি চিপসের দামে একটি কলা কেনা সম্ভব। চিপস–জাতীয় খাবারে সোডিয়াম গ্লুটামেট থাকে, যা স্বাদ বাড়ায়। তাই শিশুরা এটি পছন্দ করে। কিন্তু এটি স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সঙ্গে আমরা আটটি জনগোষ্ঠীর ওপর কাজ করেছি, যেখানে নগরের বস্তি, হাওর, উপকূলীয় এলাকা, চর এলাকা অন্তর্ভুক্ত। প্রজননক্ষম নারীদের খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে সাশ্রয়ী ফুড বাস্কেট তৈরি করা হয়েছে। দেখা গেছে, নগরের বস্তিবাসী একজন নারী প্রতিদিন ১৯৬ টাকা খরচ করেন স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করতে। এতে ১৫ শতাংশ খরচ অ্যানিমেল সোর্স ফুড এবং ৩৯ শতাংশ খরচ দুধে যায়। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এটি বহন করা কঠিন। ফলে তাঁদের খাদ্যাভ্যাসে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
সমাধান দুই স্তরে হতে হবে—দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা। স্বল্পমেয়াদি সমাধান হলো পুষ্টি শিক্ষা। বাবা–মায়েদের সচেতন করা, চিপসের পরিবর্তে কলা বা ফল খাওয়ানোর মতো ছোট পদক্ষেপও গুরুত্বপূর্ণ। প্রসেসড ফুডের ওপর নির্ভরতা কমাতে এই পদক্ষেপ জরুরি।
খালেদা ইসলাম
অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অস্বাস্থ্যকর খাবারে সাধারণত প্রচুর ক্যালোরি থাকে, কিন্তু পুষ্টি উপাদান নেই। এ ছাড়া অতিরিক্ত চিনি, লবণ ও ক্ষতিকর ফ্যাট থাকে, যা শরীরে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত লবণ হাইপারটেনশন, হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। চিনি ও ফ্যাট অতিরিক্ত ওজন ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। পুষ্টিকর খাবারের অভাব দীর্ঘ মেয়াদে কিছু ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে।
আমাদের প্রচারণায় প্রায়ই বলি—‘এটা খাবেন না’, কিন্তু বিকল্প দেখাই না। ভোক্তা তখন বুঝতে পারে না কোন খাবার খেতে পারবে। আমাদের দায়িত্ব হলো স্বাস্থ্যকর বিকল্প উপস্থাপন করা। ভোক্তা যাতে সঠিকভাবে জানতে পারে, কোন খাবার থেকে ভিটামিন, মিনারেল ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।
পুষ্টি শুরু হয় জন্মের আগে থেকেই। গর্ভধারণকালীন সময়ে মায়ের পুষ্টি অনাগত সন্তানের স্বাস্থ্য নির্ধারণ করে। জন্মের পরে ব্রেস্টফিডিং শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করলে পরবর্তী সময়ে শিশুদের মধ্যে হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য নন–কমিউনিকেবল ডিজিজের ঝুঁকি কম থাকে।
বাংলাদেশে এখনো বেশির ভাগ জায়গায় ব্রেস্টফিডিং সুবিধা নেই। কবে শতভাগ অর্জন হবে কে জানে। গার্মেন্টস থেকে শুরু করে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি বলি, এখানেও আমাদের অনেক তরুণ সহকর্মী আছেন, তাঁদের শিশুদের বাসায় রেখে আসতে হয়। কারণ, ব্রেস্টফিডিং সুবিধা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এটা আসলে খুবই দুঃখজনক।
নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা সুগারি ড্রিংকস ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রচার করছে। কিন্তু তামাকের মতো কঠোর আইন নেই। প্রতিটি প্যাকেটজাত খাবারের পুষ্টিমান অনুমোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সরকারকে সেটা ঠিক করে দিতে হবে, সেই দায়িত্ব কে পালন করবে? নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নাকি বিএসটিআই? আমরা চাই কেবল স্বাস্থ্যসম্মত খাবার অনুমোদন নিশ্চিক করা হোক।
আনজুমান আরা সুলতানা
সাবেক লাইন ডিরেক্টর, জাতীয় পুষ্টিসেবা
জাতীয় পুষ্টিসেবায় দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, পুষ্টি স্বাস্থ্যের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস কেমন করে একটি সামাজিক বোঝা হয়ে ওঠে। তবে আমরা শুধু সমস্যা চিহ্নিত করিনি, সমাধানের পথও তৈরি করেছি। আমরা ন্যাশনাল ডায়েটারি গাইডলাইন তৈরি করেছি, যেখানে পুষ্টিকর খাবার কী, কোন খাবার কতটুকু খেতে হবে, আর অতিরিক্ত খেলে কী ক্ষতি হতে পারে—সবই উল্লেখ আছে।
আমাদের চারপাশে অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রাচুর্য স্পষ্ট। রাস্তার পাশের দোকান থেকে শুরু করে অফিসফেরত মা–বাবার হাতে চিপস বা বেভারেজের প্যাকেট—সবই এখন নিত্যচিত্র। সচেতনতার অভাবে অনেকেই মনে করেন, এগুলোই ভালো খাবার। আমাদের সচেতনতা তৈরি করতে, অভিভাবকদের বোঝাতে হবে, একটি ডিম, একবেলা খিচুড়ি বা ফলমূলের যে পুষ্টিগুণ, তা কোনো প্রক্রিয়াজাত খাবারে নেই।
আমরা এখন এমন এক অবস্থায় আছি, যেখানে শিশুদের মধ্যে কম পুষ্টি ও অতিপুষ্টি—দুটিই দেখা যায়। একটি শিশু কৃশকায়, আরেকটি স্থূলকায়। শিশুদের খেলার জায়গা নেই, হাঁটাচলার সুযোগ নেই। ফলাফল, শিশুরা দিন দিন স্থূল হয়ে পড়ছে, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে।
একটি হেলদি লাইফস্টাইল মানে কেবল ওজন কমানো নয়, বরং ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন। আমি যদি সঠিক ডায়েট মেনে চলি, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করি, তাহলে অনেক রোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারি। কিন্তু আমরা এখন এমন এক চক্রে আছি—অতিরিক্ত খাচ্ছি, তারপর ওজন কমাতে ব্যায়াম করছি। এটি টেকসই কোনো পদ্ধতি নয়।
আমাদের সমাজে এখন খাবারই বিনোদন। চারদিকে শুধু রেস্তোরাঁ আর জাঙ্ক ফুডের দোকান। অফিসে অতিথি এলেও একই আয়োজন। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। স্থানীয়, ঐতিহ্যবাহী, ঘরে তৈরি খাবারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
আসফিয়া আজিম
ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল
স্কুল ও এর চারপাশের পরিবেশ কিশোর-কিশোরীদের খাদ্য গ্রহণে বড় প্রভাব ফেলে। স্কুলের ক্যানটিনে যদি অস্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রাধান্য থাকে, তাহলে ছাত্রছাত্রীরা সেখান থেকেই তাদের খাবার বেছে নেবে। স্কুলের আশপাশের হকাররা যদি চিপস, চকলেট, জুস বিক্রি করার সুযোগ পায়, তাহলে শিশু-কিশোরেরা অতিরিক্ত চিনি ও লবণযুক্ত মুখরোচক খাবারই কিনে খাবে। ডব্লিউএইচও এবং ইউনেসকোর হেলথ প্রমোটিং স্কুল ইমপ্লিমেন্টেশন গাইডলাইনে স্পষ্ট বলা আছে, স্কুলের পরিবেশ, খাবার ও পানীয় এমন হওয়া উচিত যেন তা শিশু স্বাস্থ্যের জন্য সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে সম্প্রতি একটি নতুন ডায়েটারি গাইডলাইন তৈরি হয়েছে। এই গাইডলাইন থেকে স্কুলকে ফোকাস করে আরেকটি নির্দেশিকা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। এটি ছোট ও সহজ বাংলায় হওয়া উচিত, যাতে স্কুলগুলো তা অনুসরণ করতে পারে। স্কুলের নিজস্ব ক্যানটিন অথবা ভেন্ডারের মাধ্যমে পরিচালতি ক্যানটিনে সেই গাইডলাইন অবশ্যই মানতে হবে। ক্যানটিনের জন্য আলাদা রেসিপি বা নির্দেশিকা তৈরি করাও প্রয়োজন। পাশাপাশি ক্যানটিন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, স্বাস্থ্য ইউনিট ও ভোক্তা অধিকার সংস্থার জন্য প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। তাদের জন্য একটি চেকলিস্ট তৈরি করা উচিত, যাতে স্কুল পরিদর্শনকালে পরিবেশ কতটুকু স্বাস্থ্যকর, ক্যানটিনে পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যাচ্ছে কি না, এসব নিরীক্ষণ করা সম্ভব হয়। স্কুলে শিশুদের জন্য হেলদি ইটিং কারিকুলামেও জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের স্কুল নিউট্রিশন প্রোগ্রামে কিশোর-কিশোরীদের আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট দেওয়া হয় এবং সেই সময় স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস–সম্পর্কিত বার্তা দেওয়া হয়। এসব সেশনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের কাছে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসংক্রান্ত বার্তাগুলো খুব সহজে পৌঁছানো সম্ভব। পাশাপাশি গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কিশোরদের উপযোগী ম্যাগাজিনের মাধ্যমেও এ ধরনের বার্তা প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
ফারিয়া শবনম
ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (পুষ্টি), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
অস্বাস্থ্যকর খাবার বলতে বোঝায় সেই খাবার, যেখানে অতিরিক্ত চিনি, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্সফ্যাট ও অতিরিক্ত সোডিয়াম থাকে। এসব খাবার অপুষ্টি , রক্তচাপ ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যগুলোতে খাদ্য-আঁশ, ভিটামিন ও খনিজ লবণের ঘাটতি থাকে।
স্থূলতা একসময় শুধু উচ্চ আয়ের দেশের সমস্যা ছিল, এখন তা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশেও সমানভাবে দেখা যায়। একই সঙ্গে কম পুষ্টি ও অণুপুষ্টির ঘাটতিও রয়ে গেছে। বর্তমানে পাঁচ বছরের নিচে সাড়ে তিন কোটি শিশু স্থূলতায় ভুগছে, যার অর্ধেকই এশিয়ায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমরা ‘ডাবল বার্ডেন’—কম পুষ্টি ও অতিপুষ্টি—দুটির সঙ্গেই লড়ছি। বাংলাদেশেও ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে ৩২ শতাংশ কোমল পানীয় এবং ৪৯ শতাংশ উচ্চ চিনি, লবণ বা অস্বাস্থ্যকর উপাদানযুক্ত খাবার গ্রহণ করছে।
২৫ থেকে ৬৯ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত লবণ ও লবণযুক্ত সস গ্রহণ করেন, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দৈনিক সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম লবণ গ্রহণের পরামর্শ দেয়, কিন্তু আমরা গ্রহণ করি প্রায় ৯ গ্রাম। ২৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত।
আমাদের পরিবেশ এখন ‘ওবেসোজেনিক’, অর্থাৎ স্থূলতাকে উৎসাহিত করে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘরে রান্না করা খাবারের পরিবর্তে প্রক্রিয়াজাত ও ফাস্ট ফুডের দিকে ঝোঁক বাড়ছে। মা–বাবা নিজেরাই অজান্তে শিশুদের জাঙ্ক ফুডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, যা পরবর্তী প্রজন্মের ‘পুষ্টি ও স্বাস্থ্য’ ঝুঁকি বহন করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ, সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকার সঠিক বাস্তবায়ন, ভর্তুকির মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর খাবার সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করা, অস্বাস্থ্যকর খাবারের ওপর বাড়তি কর আরোপ, শিশুদের লক্ষ্য করে প্রচারিত অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ, প্যাকেটজাত খাবারে খাদ্য উপাদানের লেবেলিং চালু ও দৃশ্যমান করা, স্কুল ক্যানটিনে স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিও জরুরি।
খালিকুজ্জামান রোমেন রায়হান
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
স্কুলের শিশুদের টিফিন নিয়ে আমি একটি ছোট গবেষণা করেছি। ঢাকা শহরের একটি স্কুলে এক সপ্তাহ ধরে সকালের শিফটের মেয়েরা এবং বিকেলের শিফটের ছেলেরা কী ধরনের টিফিন নিয়ে আসে, তা পর্যবেক্ষণ করেছি। টিফিনের ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাত্র ৭ দশমিক ২ শতাংশ শিশু ঘরে তৈরি খাবার নিয়ে এসেছে। ৪০ দশমিক ২ শতাংশ বাইরে থেকে কিনে আনে এবং ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ মিশ্র ধরনের টিফিন নিয়ে আসে। স্বাস্থ্যকর খাবার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ, অস্বাস্থ্যকর খাবার ৮০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মিশ্র ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, শিশুরা প্রায়ই অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করছে। অভিভাবকদের অনেকেই সময়ের অভাবের কারণে ঘরে তৈরি খাবার দিতে পারছে না। সকালের সেশনের শিশুদের টিফিনের মান আরও খারাপ। কারণ, তারা দ্রুত কিছু কিনে নিয়ে আসে যা স্কুলের আশপাশে ফাস্ট ফুড দোকানগুলোতে সহজলভ্য।
এই পরিস্থিতিতে নীতিগত হস্তক্ষেপ জরুরি। শিশুদের খাদ্য গ্রহণে বিজ্ঞাপনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অস্বাস্থ্যকর খাবার যেমন চিপস, বার্গার, জুস ইত্যাদির বিজ্ঞাপন শিশুরা বিনা চিন্তায় গ্রহণ করে। স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যাপারে তারা মোটেও সচেতন নয়। তাই নীতিতে থাকা উচিত, কোন ধরনের বিজ্ঞাপন করা যাবে, কোনটার প্রচার সীমিত হবে। টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উভয় ক্ষেত্রেই তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
অন্য একটি দিক হলো স্কুল থেকে খাবারের সরবরাহ। জাপানের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, স্কুলে সব শিশুকে একই ধরনের খাবার দেওয়া হয়। এটি একটি ইউনিফর্ম পদ্ধতির মতো কাজ করে। বাংলাদেশেও স্কুল ক্যানটিনে বা ভেন্ডারের মাধ্যমে প্রদত্ত খাবারে একটি স্ট্যান্ডার্ড তালিকা তৈরি করা যেতে পারে।
বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ, স্কুলভিত্তিক নির্দেশিকা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করলেই আমরা শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারব।
মো. আজিজ খান
পুষ্টি কর্মকর্তা (ইসিসিডি), ইউনিসেফ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা অনুযায়ী, অস্বাস্থ্যকর খাবার দ্রুত ও আশঙ্কাজনক হারে স্বাস্থ্যকর খাবারের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। এটি শুধু বয়স্কদের নয়, শিশু, স্কুলগামী শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রেও ঘটছে।
বাজারের চিত্রও উদ্বেগজনক। গত বছর জাতীয় পুষ্টিসেবা, ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফ একটি ল্যান্ডস্কেপ অ্যানালাইসিস প্রকাশ করেছিল। এতে দেখা গেছে, কনফেকশনারি ও স্ন্যাকসের বাজার ২০১৮ সালের ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৫ বছরে ১৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বছরে এ বাজার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কোমল পানীয়ের বাজারও ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাজার সম্প্রসারণের জন্য কোম্পানিগুলো মিডিয়াকে অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে ব্যবহার করছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি বিলবোর্ড ও টিভি কমার্শিয়ালে কোমল পানীয় প্রচলিত। এ ধরনের বিপণন রোধ করতে হলে রাজস্ব নীতি ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথমত, অস্বাস্থ্যকর খাবারের ওপর কর বাড়িয়ে এর ভোগ কমানো সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি কোমল পানীয় ৫০ টাকায় বিক্রি হয়, কর বাড়িয়ে ১০০ টাকার বেশি করা যায়, এতে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণের হার কমবে।
দ্বিতীয়ত, এই কর থেকে প্রাপ্ত আয়কে স্বাস্থ্যকর খাদ্য প্রচার ও পুষ্টি কর্মসূচিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ কর প্রণোদনার মাধ্যমে আমরা স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সহজলভ্যতা বাড়াতে পারি। বিডিএইচএস ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ শিশু মাত্র পাঁচ বা তার কম খাদ্য গ্রুপ থেকে খাবার গ্রহণ করছে।
আমরা যদি কর প্রণোদনা ব্যবহার করি, তাহলে স্বাস্থ্যকর খাদ্য যেমন ডিম, শাকসবজি বা ফল সহজলভ্য হবে। দেশে মাত্র ২৮ শতাংশ শিশু দেশে ডিম গ্রহণ করছে। ডিম একটি সহজলভ্য ও পুষ্টিকর খাবার। সরকার
উৎপাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত ভর্তুকি দিলে এটি আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
জি এম রেজা সুমন
প্রজেক্ট ম্যানেজার, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভমড নিউট্রিশন (গেইন)
সম্প্রতি আমরা গেইন থেকে পোশাককর্মীদের জন্য সুলভ মূল্যে স্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রয়ের কেন্দ্র চালু করেছি। এই দোকানগুলো থেকে আমরা কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকস সরিয়ে দিয়েছি।
বাস্তবতা হলো, সাধারণ ভোক্তা সচেতন নয়। যেমন একটি এনার্জি ড্রিংকসের বোতলে ২৫ গ্রাম চিনি আছে, কিন্তু ভোক্তা জানে না এটি কতটা ক্ষতিকারক। তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও খাদ্যের বৈচিত্র্য সীমিত। নিম্ন আয়ের শ্রমিকগোষ্ঠী কম দামে ক্যালোরিসমৃদ্ধ খাবার বেছে নেয়, যা তাদের পুষ্টিঘাটতি তৈরি করে।
দেশে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুরা ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করছে। তাই খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণে স্বচ্ছতার প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলে আমরা সচেতনতা বৃদ্ধি ও সুলভ মূল্যের দোকান পরিচালনা করছি।
এখানে ফুড ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ—তাদের প্রণোদনা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। লেবেলিং ও মার্কেটিংয়ের স্বচ্ছতা অপরিহার্য। স্পষ্ট লেবেল থাকলে ভোক্তা বুঝবে—কোন খাদ্য স্বাস্থ্যকর, কোনটি নয়।
স্বাস্থ্যকর বিকল্প প্রদানের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। কম দামে স্বাস্থ্যকর বিকল্প পৌঁছে দিতে হবে, যেন কর্মী ও শিশু উভয়ই পুষ্টিকর খাবার বেছে নিতে পারে।
শিক্ষা, সচেতনতা, আইন ও বিধি অনুসরণ করেই পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই পোশাককর্মীদের জন্য বেভারেজ ও সুগারি আইটেম নিষিদ্ধ করেছি। এর পরিবর্তে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ ও মাংস সাশ্রয়ী মূল্যে প্রদানের ব্যবস্থা করেছি।
এই উদ্যোগ শুধু খাদ্য সরবরাহ নয়, একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের সূচনা। শ্রমিক ও শিশু উভয়কেই স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রতি সচেতন ও অভ্যস্ত করা লক্ষ্য। আমরা চাই, প্রত্যেক কর্মী ও পরিবার স্বাস্থ্যকর বিকল্প গ্রহণে সক্ষম হোক এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হোক।
সুপারিশঅস্বাস্থ্যকর খাবারের পরিবর্তে পুষ্টিকর ও ঘরে তৈরি খাবার গ্রহণে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
শিশুদের জন্য স্কুল পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর খাবারের নীতিমালা ও গাইডলাইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
অস্বাস্থ্যকর খাবার, কোমল পানীয় ও ফাস্ট ফুডের বিজ্ঞাপন প্রচার সীমিত বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।।
পপ্যাকেটজাত খাবারে উপাদানের লেবেলিং বাধ্যতামূলক ও সহজবোধ্য করতে হবে।
অস্বাস্থ্যকর খাবারের ওপর কর বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকর খাবারে ভর্তুকি প্রদান করতে হবে।
স্কুল ক্যানটিন ও এর আশপাশে অস্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে।
নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য সুলভ মূল্যে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
ফুড ইন্ডাস্ট্রির জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কার্যকর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
গণমাধ্যম, শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
পরিবার ও সমাজ পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও হেলদি লাইফস্টাইল চর্চা উৎসাহিত করতে হবে।