ইসলাম এমন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যে জীবন যাপন করতে শেখায়। এটি কেবল একটি ধর্ম নয়; বরং নৈতিকতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও আত্মার পূর্ণ সমন্বিত এক দিকনির্দেশনা।
মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্মরূপে পছন্দ করলাম।” (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৩)
ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
(১) বিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তি (আকিদা)
(২) আমল বা কর্মভিত্তিক বিষয়সমূহ (ইবাদত, আচরণ ও নৈতিকতা)
এক.ইমান বা বিশ্বাস
ইমান ইসলামি জীবনের ভিত্তি। এটি ছয়টি মূল বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যাকে বলা হয় ইমানের ছয়টি স্তম্ভ:
১. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস
২. ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস
৩. কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস
৪. রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস
৫. পরকাল বা আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস
৬. তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস। অর্থাৎ, ভালো-মন্দ উভয়টাই আল্লাহর নির্ধারণ করা।
রাসুল (স.) বলেছেন, “ইমান হল তুমি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসুল, পরকাল এবং তাকদিরে বিশ্বাস রাখো।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮)
এই ছয়টি বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস ব্যতীত একজন ব্যক্তি মুসলমান হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
আরও পড়ুনফিলিস্তিন ও ইসলাম: অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ৫ দিক২০ আগস্ট ২০২৫দুই. ইসলামের পাঁচ স্তম্ভইসলামের দৃশ্যমান কাঠামো পাঁচটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মহানবী (স.) বলেছেন, “ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত:
(১) সাক্ষ্য দাও যে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর রাসুল;
(২) নামাজ কায়েম করা;
(৩) জাকাত প্রদান করা;
(৪) রমজানের রোজা রাখা;
(৫) এবং সামর্থ্য থাকলে হজ করা।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬)
এই পাঁচটি স্তম্ভ মুসলিম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোর মাধ্যমে একজন মুমিন আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়।
তিন. নামাজনামাজ ইসলামের মূল ইবাদত। এটি বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। কোরআনে বলা হয়েছে, “নামাজ কায়েম কর; নিশ্চয় নামাজ অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৪৫)
নামাজের মাধ্যমে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়, মন প্রশান্ত হয় এবং সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
চার. জাকাতজাকাত ইসলামি অর্থনীতির নৈতিক ভিত্তি। এটি সমাজে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করে। কোরআনে আল্লাহ বলেন, “তাদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ কর, এর দ্বারা তুমি তাদের পরিশুদ্ধ করবে ও পবিত্র করবে।” (সুরা তাওবা, আয়াত: ১০৩)
জাকাত সমাজে দরিদ্র-অসহায়দের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং লোভ, অহংকার ও বৈষম্য দূর করে।
পাঁচ. রোজারমজান মাসের রোজা আত্মসংযম ও তাকওয়া অর্জনের অন্যতম উপায়। আল্লাহ বলেছেন, “হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা পরহেজগার হতে পারো।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
রোজা শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণা থেকে বিরত থাকা নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহানুভূতি ও নৈতিক শুদ্ধতার অনুশীলন।
আরও পড়ুনউপহার দেওয়া সম্পর্কে ইসলাম১৩ আগস্ট ২০২৫ছয়. হজহজ জীবনের একবারের ফরজ ইবাদত, যদি আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য থাকে। এটি মুসলমানদের ঐক্য, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক।
আল্লাহ বলেছেন, “এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘরে হজ করা মানুষের ওপর কর্তব্য, যারা সেখানে পৌঁছাতে সক্ষম।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)
সাত. নৈতিকতা ও আচরণইসলাম কেবল উপাসনার ধর্ম নয়; এটি নৈতিক আচরণেরও শিক্ষা দেয়। নবীজি (স.) বলেছেন, “আমি সুন্দর চরিত্র পূর্ণ করতে প্রেরিত হয়েছি।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৮৯৫২)
সত্যবাদিতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, দয়া, ধৈর্য, বিনয় ও ন্যায়পরায়ণতা একজন মুসলমানের মৌলিক গুণ।
আট. সমাজ ও মানবসম্পর্কইসলাম সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করে। এখানে জাতি, বর্ণ, শ্রেণি বা ভাষার কোনো বৈষম্য নেই। আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সে-ই, যে সর্বাধিক পরহেজগার।” (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়ের মর্যাদা নিশ্চিত করেছে, শ্রমিকের প্রাপ্যতা নির্ধারণ করেছে, প্রতিবেশীর অধিকার সংরক্ষণ করেছে।
নয়. জ্ঞানের প্রতি উৎসাহইসলাম জ্ঞানকে ইমানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। প্রথম অবতীর্ণ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আলাক, আয়াত: ১)
নবীজি (স.) বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ।” (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)
ইসলাম জ্ঞানচর্চাকে আল্লাহর কিতাব, প্রকৃতি ও সমাজ—এই তিন দিক থেকে জানার মাধ্যম হিসেবে দেখে।
ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহ শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি নয়, বরং আত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক সব বিবেচনায় মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনে। একজন প্রকৃত মুসলিম সেই, যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে, নবীজির (স.) নির্দেশনা মেনে
আরও পড়ুনকিশোরদের ইসলাম অনুশীলনে আগ্রহী করার উপায়২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসল ম র ম ল ম সলম ন জ বন র স তম ভ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে হবে: ভূমি উপদেষ্টা
ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আমাদের বেতন হয়। তাই সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে হবে। কেউ যদি সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দ্রুত সেবার ক্ষেত্রে সবার আগে জনগণ।”
সোমবার (১০ নভেম্বর) রাজধানীর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) অডিটরিয়ামে ‘উপজেলা ভূমি অফিসের সেবা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক কর্মশালায় তিনি এসব কথা বলেন।
আরো পড়ুন:
‘জ্ঞান জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করাই প্রকৃত সাফল্য’
ভূমিসেবা নিশ্চিতের মূল ভিত্তি সঠিক সার্ভে ও সেটেলমেন্ট: ভূমি উপদেষ্টা
তিনি বলেন, “ভূমি প্রশাসন বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত, যার কার্যক্রম মূলত উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা ভূমি অফিসের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সাধারণ মানুষের ভূমি-সংক্রান্ত প্রায় সব সেবা এখান থেকেই দেওয়া হয়। তাই উপজেলা ভূমি অফিস নাগরিক সেবার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।”
তিনি আরো বলেন, “ভূমি সেবার মান ও সুশাসন নিশ্চিত করতে এখনও নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সেবায় জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্টেকহোল্ডারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কিভাবে কাজ করলে জনগণের কল্যাণ হবে, তা নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্ধারণ করতে হবে।”
সুশাসন ছাড়া অগ্রগতি অসম্ভব
ভূমি উপদেষ্টা বলেন, “সুশাসন একটি রাষ্ট্রের অগ্রগতির পূর্বশর্ত। এটি এমন একটি কাঠামো, যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার ও নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়—ভূমি সেবার ক্ষেত্রেও তাই।”
তিনি বলেন, “ভূমি মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এটি খাদ্য, শিল্প, আবাসন ও অর্থনীতির মূল উৎস। ভূমি সেবার মানোন্নয়ন কেবল প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি মানবিকতা, সততা ও দায়িত্ববোধের সমন্বয়।”
জনবান্ধব ভূমি প্রশাসনের আহ্বান
ভূমি উপদেষ্টা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “স্বচ্ছতা, দেশপ্রেম, সততা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে ভূমি খাতকে জনবান্ধব করা সম্ভব। সহকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে, অসততার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।”
তিনি বলেন, “অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কাজের জন্য ওপর থেকে সুপারিশ এলে দ্রুত হয়ে যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই দ্রুত সেবা পায় না। এসব অসঙ্গতি পরিহার করতে হবে।”
ভূমি খাতে সুশাসন এখন সময়ের দাবি
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “ভূমি খাত বাংলাদেশের উন্নয়ন ও জনকল্যাণে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। এটি শুধু উৎপাদনের উপকরণ নয়; এটি নাগরিকের অধিকার, জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ভূমি প্রশাসনে সুশাসনের অভাব ও স্বচ্ছতার ঘাটতির কারণে জনগণ ভোগান্তিতে ছিল।”
নতুন বাংলাদেশের পথে
ভূমি উপদেষ্টা আরো বলেন, “সহকারী কমিশনার (ভূমি) শুধু প্রশাসনিক দায়িত্বই পালন করেন না, বরং নির্বাচন পরিচালনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁরা নির্বাচনের সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।”
তিনি বলেন, “৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশকে পুরোনো জীর্ণতা ভুলে সামনে এগোতে হবে। সামনে নির্বাচন—নতুন আশা ও নতুন প্রত্যয়ের প্রতীক। তাই এমন একটি নির্বাচন উপহার দিতে হবে, যেখানে জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।”
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ।স্বাগত বক্তব্য রাখেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেন টিআইবির পরিচালক (সিভিক এনগেজমেন্ট) ফারহানা ফেরদৌস, প্রফেসর ড. সুরাইয়া খায়ের, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা), টিআইবি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. এমদাদুল হক চৌধুরী প্রমুখ।
ঢাকা/আসাদ/সাইফ