একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছি। হঠাৎ ছাত্রদের প্রশ্ন, একই রকম আলো-বাতাস আর পাশের চায়ের দোকানের কোলাহল—সবকিছু হুবহু পরিচিত মনে হলো। যেন ঠিক এই একই দৃশ্য আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু ভাবার পরেও মনে করতে পারলাম না—কোথায়? কখন?

এই অদ্ভুত অনুভূতিটা খুব ক্ষণস্থায়ী। তবু মনে গভীর রেখাপাত করে। এ অভিজ্ঞতার নাম দেজাভু—ফরাসি শব্দ; অর্থ আগে দেখা। দেজাভু হলো একটি স্বল্পস্থায়ী মানসিক অভিজ্ঞতা, যেখানে ব্যক্তি কোনো নতুন পরিস্থিতি বা দৃশ্যকে অজানা কারণবশত পরিচিত বলে মনে করেন, যদিও তার আগের অভিজ্ঞতার কোনো স্পষ্ট স্মৃতি উপস্থিত থাকে না। গবেষণা অনুসারে, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ জীবদ্দশায় অন্তত একবার এ অনুভূতি পেয়ে থাকেন।

স্মৃতি-প্রক্রিয়ায় পরিচিতি বনাম পুনরুদ্ধার

স্মৃতি উপলব্ধির দুটি মৌলিক ধাপ—পরিচিতি অনুভব (ফ্যামিলিয়ারিটি) ও বিশদ স্মৃতি পুনরুদ্ধার (রেকলেকশন)। দেজাভুর ক্ষেত্রে পরিচিতির সংকেত সক্রিয় হয়, তবে বিশদ স্মরণ অনুপস্থিত থাকে। এ অবস্থাকে বলা হয়—ভ্রান্ত পরিচিতি অনুভব। মূলত পরিচিতি ও পুনরুদ্ধার পথের কাজের অসামঞ্জস্য এ অনুভূতির জন্ম দেয়।

স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ভিত্তি

দেজাভুর অন্যতম স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব, বিশেষত হিপোক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে। টেম্পোরাল লোবে সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক বিশৃঙ্খল টেম্পোরাল লোবের হালকা বৈদ্যুতিক অস্বাভাবিকতা—বিশেষত টেম্পোরাল লোব এপিলেপসিতে—দেজাভু সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দেজাভু তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।

দ্বৈত-প্রক্রিয়া ধারণা: পরিচিতি শনাক্ত করে পেরিরাইনাল করটেক্স, আর বিশদ স্মৃতি ফিরিয়ে আনে হিপোক্যাম্পাস। দেজাভু ঘটে যখন পরিচিতি–সংকেত সক্রিয় হয়, কিন্তু স্মৃতি পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা (হিপোক্যাম্পাল পথ) তাকে সমর্থন করতে পারে না।

পরপর সংকেত বিলম্ব ধারণা: দৃশ্য গ্রহণের সময় ক্ষুদ্র খণ্ড–সেকেন্ড বিলম্বে একই তথ্য দুইবার প্রক্রিয়াজাত হতে পারে। দ্বিতীয় সংকেতটি প্রথমটির তুলনায় মস্তিষ্কের কাছে ‘আগে দেখা’ বলে মনে হয়।

গবেষণাভিত্তিক তত্ত্ব

স্মৃতি–বিভ্রান্তি তত্ত্ব: নতুন তথ্য ও পূর্ব স্মৃতির মাঝে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হলে পরিচিত বলে মনে হয়।

সহজ প্রক্রিয়াজাতকরণ তত্ত্ব: যে তথ্য সহজে মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াজাত হয়, তা পরিচিত মনে হয়।

অবচেতন স্মৃতি সক্রিয়তা: অবচেতন স্মৃতি সক্রিয় হলে বর্তমান ঘটনাকে পরিচিত মনে হয়।

স্বপ্ন–সূত্র তত্ত্ব: স্বপ্নে দেখা কোনো স্মৃতি বাস্তবের সঙ্গে মিলে গেলে দেজাভু হয়।

ডিজিটাল যুগ ও দেজাভু

ডিজিটাল সময়ে আমরা প্রতিদিন বহু ছবি, পরিবেশ ও কনটেন্টের মুখোমুখি হই। এর অনেক কিছুই আমাদের অজান্তে অবচেতন স্মৃতি হিসেবে জমা হয়। এগুলো পরে নতুন বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিললে পরিচিতির অনুভূতি তৈরি করতে পারে।

কখন গুরুত্ব দেবেন

সাধারণ দেজাভু ক্ষতিকর নয়। তবে চিকিৎসাগত দিক থেকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, যদি খুব ঘন ঘন ঘটে। স্মৃতিভ্রংশ, বিভ্রান্তি, অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দেয়। বিশেষ করে যদি খিঁচুনি–জাতীয় উপসর্গ থাকে। এ ক্ষেত্রে টেম্পোরাল লোব এপিলেপসি বা বিচ্ছিন্নতাজনিত সমস্যা (ডিসোসিয়েটিভ অবস্থা) থাকতে পারে।

একটি ব্যাখ্যা

দেজাভু মূলত পরিচিতি–নির্ধারণী ব্যবস্থার ‘স্ব-পর্যবেক্ষণ সংকেত–ত্রুটি’ অর্থাৎ স্মৃতির অখণ্ডতা পরীক্ষা করার একটি স্বাভাবিক ভেতরকার পদ্ধতি। এটি স্মৃতির ওপর মানসিক নজরদারি বজায় রাখে।

দেজাভু কোনো অতিপ্রাকৃত বা রহস্যময় শক্তির ফল নয়; এটি স্মৃতি–প্রক্রিয়ার স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ও জ্ঞানগত অসামঞ্জস্যের এক ক্ষণস্থায়ী প্রতিফলন। টেম্পোরাল–হিপোক্যাম্পাল স্নায়ুপথের সূক্ষ্ম ত্রুটিজনিত সংকেত পরিচিতির অনুভূতি জাগালেও স্মৃতি পুনরুদ্ধার পথ তা সমর্থন করতে পারে না।

মানবস্মৃতির প্রকৃতি—চলমান, পরিবর্তনশীল ও সূক্ষ্ম হয়ে থাকে। দেজাভু সে জটিলতারই জীবন্ত উদাহরণ, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মস্তিষ্ক এখনো আমাদের সবচেয়ে বিস্ময়কর ও অজানা জগৎ।

ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী: শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক র য় ত পর চ ত তত ত ব আম দ র অন ভ ত

এছাড়াও পড়ুন:

আমিনবাজারে পুলিশের চেকপোস্ট, যানচলাচল স্বাভাবিক

কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকার প্রবেশপথ আমিনবাজারে চেকপোস্ট বসিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি কার্যক্রম চালাচ্ছে পুলিশ। 

বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) সকালে ঢাকা জেলা পুলিশের এই তল্লাশি কার্যক্রম চলতে দেখা যায়। এর আগে, গতকাল বুধবারও দিনব্যাপী এ তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। এ কর্মসূচি ঘিরে নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে এই চেকপোস্ট বসানো হয়।

সকাল থেকে সাভারের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, অন্যান্য দিনের মতো সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। গণপরিবহনসহ ব্যক্তিগত পরিবহনও চলছে স্বাভাবিকভাবেই। যদিও দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস ও বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী গণপরিবহন কম দেখা যায়।

সরেজমিনে আমিনবাজারে পরিচালিত পুলিশের চেকপোস্টে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকাগামী বিভিন্ন গণপরিবহন, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ সড়কে চলাচলকারী পথচারীদের থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে থাকা ব্যাগসহ মালপত্র তল্লাশি করছে পুলিশ। এসময় যাত্রীদের গন্তব্য এবং কোথা থেকে এসেছেন সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হচ্ছে। 

গতকাল চেকপোস্টের প্রথম দিনের তল্লাশিতে যাত্রীদের মুঠোফোন ও মুঠোফোনের গ্যালারি চেক করতে দেখা গেলেও আজ এমন কিছু লক্ষ্য করা যায়নি। 

চেকপোস্ট পরিচালনায় থাকা সাভার মডেল থানার আমিনবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ফয়সাল আলম বলেন, “আমাদের চেকপোস্ট কার্যক্রম চলমান আছে। কেউ যেন কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি কিংবা কোনো নাশকতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে সেই লক্ষ্যে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।”

তবে এখন পর্যন্ত চেকপোস্ট থেকে সন্দেহভাজন কেউ আটক বা গ্রেপ্তার নেই বলেও জানান তিনি।

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের অংশ হিসেবে গত কয়েকদিন ধরে আমাদের পিকেট ডিউটিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চেকপোস্ট কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা কিংবা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।”

ঢাকা/সাব্বির/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ