নকল খবরের বিস্তার : সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন
Published: 25th, November 2025 GMT
আজকের পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির কারণে এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। ডিজিটাল যুগে তথ্য এখন হাতের মুঠোয়। একটি স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট থাকলেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের খবর মুহূর্তেই জানা সম্ভব। তথ্য প্রাপ্তির এই সহজলভ্যতা মানুষের জ্ঞান-বিস্তারে যেমন ভূমিকা রাখছে, তেমনি এর আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ সংকট নকল খবর বা ভুয়া তথ্যের বিস্তার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সীমাহীন স্বাধীনতা, অ্যালগরিদমের মনস্তাত্ত্বিক খেলা এবং মানুষের আবেগপ্রবণ আচরণ মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এমন এক পরিবেশ, যেখানে সত্যের চেয়ে মিথ্যা তথ্য দ্রুত বেশি ছড়ায়।
আমরা এখন একধরনের তথ্য-জঞ্জালের মধ্যে বাস করছি। ফলে প্রশ্ন ওঠে এই বিপুল তথ্যস্রোতে ভাসতে ভাসতে সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন? সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করার সক্ষমতা কতটা তাদের রয়েছে? বর্তমান সময়ে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ফেক নিউজ নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে এর গতি ও ব্যাপ্তি এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। আগে ভুল তথ্য ছড়াতে সময় লাগত, প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন মাধ্যমের। এখন তা কয়েক মিনিটেই লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এত সক্রিয় যে একটি ভুয়া পোস্ট, নকল ছবি বা এডিট করা ভিডিও মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়।
দুঃখজনক হলো, আমাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এসব তথ্যের উৎস যাচাই না করেই শেয়ার করে। অ্যালগরিদম জনপ্রিয় পোস্টকে আরও ওপরে তুলে ধরে এবং মানুষ সত্য যাচাইয়ের আগেই মন্তব্য ও শেয়ার করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়। এতে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের বড় অংশ এখনো এই ডিজিটাল সাইবার যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ; তাদের অজান্তেই তারা নকল তথ্য ছড়ানোর বাহক হয়ে ওঠে।
নকল খবর ছড়ায় ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত দুভাবেই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো তৈরি হয় পরিকল্পিতভাবে কাউকে বিভ্রান্ত করা, ভাবমূর্তি নষ্ট করা, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা বা দর্শক-টানার লোভ থেকে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক খবর, ধর্মীয় অনুভূতি, সেলিব্রেটি গুজব, স্বাস্থ্য-চিকিৎসাবিষয়ক ভ্রান্ত তথ্য সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। বিভিন্ন ভুয়া পেজ, অবিশ্বস্ত ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেল এসব গুজব ছড়ায় এবং উৎস যাচাই না করে সাধারণ মানুষ তা শেয়ার করে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।
সাম্প্রতিক জাতীয় ঘটনাবলি থেকে বৈশ্বিক রাজনীতির চিত্র পর্যন্ত সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় নকল তথ্য এখন সমাজের স্থিতিশীলতা ও জননিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। এই অদৃশ্য ডিজিটাল মহামারি তৈরি করছে আতঙ্ক, সহিংসতা, বিভাজন ও গণবিশ্বাসের সংকট।
নকল তথ্য তৈরির শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। এটি যেমন মানুষের কাজ সহজ করছে, তেমনি ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ক্ষমতাও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এআইয়ের মাধ্যমে মানুষের মুখ, কণ্ঠস্বর ও অভিব্যক্তি এমন নিখুঁতভাবে নকল করা যায় যে সত্য-মিথ্যার সীমারেখা প্রায় মুছে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব। উত্তেজনাপূর্ণ তথ্যের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ, আবেগের বশবর্তী হওয়া, উৎস যাচাই করতে অনীহা—সব মিলিয়ে নকল খবর আরও দ্রুত ছড়ায়।
বিশেষ করে গ্রামের মানুষ, প্রবীণ ও কম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এসব প্রতারণার শিকার বেশি হলেও শহুরে তরুণেরাও নিরাপদ নয়। গবেষণা বলছে, বেশির ভাগ মানুষ খবর পড়ার আগে উৎস দেখে না, লিংক খোলে না, শুধু হেডলাইন দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। সচেতনতার এই ঘাটতিই পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
একটি ভুল তথ্যের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। অনেকে এটি তুচ্ছ ভাবলেও এর অভিঘাত ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী। মানহানি, সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেল এসব ঘটনার পেছনে নকল তথ্য বড় ভূমিকা রাখে। অনেক সময় একটি ভুয়া তথ্য মানুষকে বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকেও ঠেলে দেয়।
তবে আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক বছরে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের প্রবণতা বেড়েছে। স্কুল-কলেজে ডিজিটাল সাক্ষরতায় জোর দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রমে ইনফরমেশন লিটারেসি, মিডিয়া লিটারেসি ও ফ্যাক্ট-চেকিং দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মিডিয়াও সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছে। তবু বাস্তবতা হলো—এই সচেতনতা এখনো সীমিত পরিসরে; পুরো সমাজে তা ছড়িয়ে পড়েনি।
সুতরাং নকল খবর প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি হলো মানুষের সচেতন হওয়া। ভুয়া তথ্য শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, এটি মানুষের মনস্তত্ত্ব, বিচারক্ষমতা ও সামাজিক আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, মানুষের বিবেক, যুক্তি ও সত্য যাচাইয়ের প্রবণতা না বাড়লে সমস্যার সমাধান হবে না। ডিজিটাল যুগে ‘তথ্যই শক্তি’, তবে ভুল তথ্য হতে পারে মারাত্মক হুমকি। তাই সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
সুমাইয়া ইসরাত
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।[email protected]
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
খই খই এখন দ্যুতি ছড়াচ্ছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে
টেবিল টেনিসে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে পদক জিতে দেশের সুনাম উজ্জ্বল করেছেন রাঙামাটির দুর্গম এলাকার বাসিন্দা খই খই সাই মারমা। মাত্র ১৮ বছর বয়সে সৌদি আরবের রিয়াদে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে মিশ্র দ্বৈতে রূপা জিতে সাড়া ফেলেছেন তিনি। তার এই কৃতিত্বকে বাংলাদেশের টেবিল টেনিসের ইতিহাসে বড় অর্জন বলে মনে করছেন পরিবারের সদস্যরা। গত ৭ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়।
রাঙামাটি সদর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে রাজস্থলী সদর উপজেলা। সেখান থেকে সীমান্ত সড়কে দিয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর পাহাড়ি এবড়ো-তেবড়ো রাস্তা দিয়ে যেতে হয় খই খই সাই মারমার গ্রাম চুশাক পাড়ায়। তার পরিবারের সদস্যরা কৃষি কাজ করে সংসার চালান। ছবির মতো সুন্দর এই পাড়ার সব ঘর মাচাং পদ্ধতিতে তৈরি।
আরো পড়ুন:
অসময়ের ব্ল্যাক বেবি তরমুজ চাষে চমক দেখালেন দুলাল
পঙ্গুত্ব তাকে ভিক্ষুক নয়, বানিয়েছে ব্যবসায়ী
মাচার ঘরে বসে কথা বলেন খই খই সাই মারমা
দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বান্দরবানের লামায় কোয়ান্টামে ভর্তি হন খই খই সাই মারমা। সেখান থেকে তার টেবিল টেনিসের পথচলা শুরু। এরপর ভর্তি হন বিকেএসপিতে। যা আজকে তাকে সাফল্য এনে দিয়েছে।
গ্রামের বাড়ির মাচাং ঘরে বসে খই খই সাই মারমা বলেছেন কীভাবে দুর্গম এই পাহাড়ি গ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দ্যুতি ছড়িয়েছেন তিনি। তার ভাষ্য, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় অর্থ সংকট দেখা দেয় পরিবারে। এলাকাবাসীর পরামর্শে মা মোহ্লাচিং মারমা তাকে কোয়ান্টামে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার পাশাপাশি টেবিল টেনিসও ছিল। টেবিল টেনিসে আকৃষ্ট হন তিনি। সেই থেকে পথচলা শুরু। এরপর ইন্টার স্কুলসহ ঢাকায় কয়েকটি গেমসে অংশগ্রহণ করে প্রতিভার ঝলক দেখাতে থাকেন।
খই খই সাই মারমা গত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অনূর্ধ্ব-১৯ বিভাগে টেবিল টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। সিনিয়রে খেলেছেন কোয়ার্টার পর্যন্ত। কিছুদিন আগে উডেন ফ্লোর জিমনেশিয়ামে ফেডারেশন কাপে জিতেছেন শিরোপা। মেয়েদের র্যাংকিংয়ে বর্তমানে খই খই সাই মারমা আছেন দ্বিতীয় স্থানে। গত বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ টেবিল টেনিশ ফেডারেশন (বিটিটিএফ) আয়োজিত প্রাইজমানি র্যাংকিং প্রতিযোগিতায় বালিকা অনূর্ধ্ব-১৯ একক ও মেয়েদের সিনিয়র এককে জেতেন শিরোপা। একই বছর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবার জুনিয়রে সেরা হন।
খই খই সাই মারমা বলেন, “কোয়ান্টামে অনেকটাই মজার ছলে খেলতে গিয়ে টেবিল টেনিসের মায়ায় পড়ি। সেখান থেকে শুরু। ২০২০ সালে অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন কোয়ান্টাম থেকে হাসান মুনীম সুমন স্যার আমাকেসহ আরো তিনজনকে নিয়ে গিয়ে ফেডারেশনে ক্যাম্প করান। সেখান
থেকে আমার উন্নতি শুরু। পাশাপাশি খেলাধুলা ও পড়ালেখার জন্য বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দেন।”
“২০২১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ শুরু। সেই বছর কোনো ফল আসেনি। পরের বছর ভারতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ইয়ুথে সিঙ্গেলসে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করি। একই বছর শ্রীলঙ্কায় দক্ষিণ এশিয়ানে মিশ্র দ্বৈতে ব্রোঞ্জ পদক পাই। ২৩ সালে কোরিয়াতে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ খেলি। একই বছর নেপালে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে দুইটি বিভাগে ব্রোঞ্জ পাই”, যোগ করেন তিনি।
খই খই সাই মারমা বলেন, “সৌদি আরবে যাওয়ার আগে দেশে একটি টুর্নামেন্ট হয়। সেখানে টিমস’সে রানার আপ এবং সিঙ্গেলসে চ্যাম্পিয়ন হই।”
সৌদি আরবে ইসলামিক সলিডারিটি টুর্নামেন্ট সম্পর্কে এই উদীয়মান খেলোয়াড় বলেন, “আশা করিনি এতো ভালো ফল হবে। সিঙ্গেলস ও ডাবলসে আমরা হেরে যাই। মিক্স ডাবলসে একটা সুযোগ ছিল। প্রথমে আফ্রিকার গায়েনার সঙ্গে খেলা হয়, তাদের সঙ্গে ৩-২ এ জিতি। তারপর মালদ্বীপের সঙ্গে জিতে ব্রোঞ্জ পদক নিশ্চিত করি। বাহরাইনের সঙ্গে জিতে আমরা ফাইনালে উঠি। ফাইনালে তুরস্কের কাছে হেরে রূপা পদক লাভ করি।”
বিকেএসপির উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খই খই সাই মারমা বলেন, “যদি ফেডারেশন আন্তর্জাতিক আরো টুর্নামেন্ট খেলতে পাঠায় এবং জাতীয় দলের জন্য একজন স্থায়ী বিদেশি কোচ রাখে, তাহলে বিদেশি দলগুলোর সঙ্গে লড়াই করা সহজ হবে।”
খই খই সাই মারমার অর্জিত বিভিন্ন পদক
নিজের এই সফলতার জন্য পরিবার, কোয়ান্টাম, কোচ, বিকেএসপি, টিটি ফেডারেশন ও সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন খই খই সাই মারমা। এই খেলোয়াড়ের স্বপ্ন অলিম্পিকে অংশ নেওয়া।
খই খই সাই মারমার মা মোহ্লাচিং মারমা বলেন, “আমার মেয়ের এতদূর পৌঁছাতে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদেরকে সবাইকে ধন্যবাদ ও আশীর্বাদ করছি।”
তার বড় বোন হ্লাহ্লাউ মারমা বলেন, “আমার বোন দেশকে রিপ্রেজেন্ট করছে, আদিবাসীকে রিপ্রেজেন্ট করছে, এতে আমরা অনেক খুশি।”
গ্রামের কার্বারি উনুমং মারমা বলেন, “আর্থিক কষ্টে বড় হওয়া খই খাই সাই মারমার সাফল্যে আমরা গ্রামবাসী তাঁকে সংবর্ধনা দেব। আগামীতে তার আরো সাফল্য কামনা করছি।”
ঢাকা/মাসুদ