সরকারের প্রতিশ্রুতি ও কাজে মিল দেখতে চাই
Published: 25th, November 2025 GMT
মানিকগঞ্জে বাউলশিল্পী ও ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর হামলা ও হুমকি ধারাবাহিক মব সহিংসতা এবং তা ঠেকাতে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। গত সাড়ে ১৪ মাসে রাজনীতির নামে হোক আর ধর্মের নামে হোক বা যেকোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে দেশে মব সহিংসতার যে বিস্তার ঘটেছে, তা জননিরাপত্তা নিয়ে নাগরিক উদ্বেগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাজার, খানকা, দরগায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু করে বাউল–বয়াতিদের ওপর আক্রমণ—কোনো ঘটনাকেই বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। আইনের দৃষ্টিতে এসব ফৌজদারি অপরাধ। আর এসব কর্মকাণ্ড নিশ্চিতভাবেই যে সহনশীলতা ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে ভেতর থেকে সম্প্রীতির সুতায় বেঁধে রেখেছে, তার মূলে আঘাত। নাজুক সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীগুলোর সুরক্ষায় সরকারের প্রতিশ্রুতির বিপরীতে নেওয়া পদক্ষেপে বিস্তর ফারাক থাকায় বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে আমরা মনে করি।
৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের একটি পালাগানের আসরে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের একটি মন্তব্য ঘিরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মামলা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। আবুল সরকারের ভক্ত-অনুরাগীরা তাঁর মুক্তির দাবিতে গত রোববার মানববন্ধন কর্মসূচির ডাক দেন। একই দিন ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে একদল লোক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। একপর্যায়ে তাদের একটি অংশ আবুল সরকারের অনুসারী ও ভক্তদের ওপর হামলা করে। লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটিয়ে ও ইট দিয়ে মেরে কয়েকজনকে আহত করে। তাদেরও একজন আহত হয়।
কারও বক্তব্যে কেউ বিক্ষুব্ধ হলে সে ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে। বাউলশিল্পী আবুল সরকারের মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া যখন চলমান, তখন কর্মসূচি দিয়ে হুমকি ও হামলা করা কেন হবে? পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকার পরও মানিকগঞ্জ প্রশাসন ও পুলিশ কেন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারল না? এর আগে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে একটি মাজারে হামলা ও কবর থেকে লাশ তুলে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় দেখা গিয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কার পরও আগাম কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছিল সেখানকার প্রশাসন ও পুলিশ।
চব্বিশের ৫ আগস্টের পর পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সুযোগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মব সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যায়। পুলিশ পুনর্গঠন করে তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার যথেষ্ট সময় পেয়েছে বলে মনে করি। মানিকগঞ্জে বাউলদের ওপর যে সহিংসতা ঘটেছে, সেটা ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
নাজুক সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর ওপর একের পর এক হামলা হলেও সরকার হামলাকারীদের এই বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যে দল-মত-পথের অনুসারী হোক না কেন, একজন নাগরিকের জানমালের ওপর হামলা ও ধর্ম চর্চার স্বাধীনতার ওপর আক্রমণের অধিকার কারও নেই এবং এ রকম কোনো হামলা হলে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ব্যর্থতা থেকেই একদল লোক মনে করছে, তারা চাইলেই যেকোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা করার অধিকার রাখে।
নাগরিক সমাজের নানা পক্ষ শুরু থেকেই মব সহিংসতা ঠেকাতে সরকারকে জোরালো ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। পরিতাপের বিষয় হলো, সরকারের কোনো কোনো অবস্থানের কারণে মব সহিংসতা প্রশ্রয় পাচ্ছে। আমরা দল-মত-পথনির্বিশেষ নাগরিকের জানমাল ও অধিকার রক্ষায় সরকারের প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপে মিল দেখতে চাই।
বাউল, সুফি দর্শন ও মানবতাবাদী চর্চা এ অঞ্চলের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বাউল, বয়াতি, গায়েনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মানিকগঞ্জে হামলার ঘটনায় যুক্তদের চিহ্নিত করে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ন কগঞ জ পদক ষ প দ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে ডিবি হেফাজতে দুজনের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি
ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে ডিবি পুলিশের হেফাজতে দুই নাগরিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। ঘটনাগুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে দুই ঘটনার নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন দুটি। আজ রোববার গণমাধ্যমে এ–সংক্রান্ত বিবৃতি পাঠিয়েছেন সংগঠন দুটির নেতারা।
বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি আসকেরআইন ও সালিশ কেন্দ্র তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, গণমাধ্যমের সূত্রে ঢাকা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ডিবি পুলিশের হেফাজতে মুক্তার হোসেন ও শাহাদত হোসেন নামের দুই নাগরিকের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। এ ঘটনায় আসক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
আসক মনে করে, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব ও সাংবিধানিক কর্তব্য। এ ধরনের মৃত্যু আমাদের জাতীয় মানবাধিকার অঙ্গীকার, সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার প্রয়াসে নতুন করে আলোচনা ও মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
বিবৃতিতে আসক বলেছে, রাষ্ট্রের হেফাজতে থাকা কোনো ব্যক্তির মৃত্যু অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। এটি সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারকে লঙ্ঘন করে। একই সঙ্গে এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের মৌলিক নীতির পরিপন্থী। যেখানে হেফাজতে থাকা ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের আইনগত ও নৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
আসকের হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানা হেফাজতসহ, র্যাব, পিবিআই ও ডিবির হেফাজতে রাখা অবস্থায় দেশে কমপক্ষে ১৫ নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে। এটা কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি দায়িত্বহীনতা, জবাবদিহির অভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সংকটকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার দাবি জানিয়ে আসক বলেছে, সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোতে দায়ী ব্যক্তিদের দায় নিরূপণ করে আইনগত জবাবদিহি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পাশাপাশি ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচারের অধিকার এবং আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করাও অত্যাবশ্যক।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভএকইভাবে ডিবি হেফাজতে দুই ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। নিহত ওই দুই ব্যক্তি অভিযুক্ত আসামি ছিলেন উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, স্বজনদের অভিযোগ, ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।
বিবৃতিতে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন মনে করে, গোয়েন্দা পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগের বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দুটি মৃত্যুর বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি রাখে। কারণ, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা যেকোনো ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইনি দায়িত্ব। এমএসএফ মোক্তার ও শাহাদতের মৃত্যুর প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিবারের অভিযোগের বিষয়টি অনতিবিলম্বে গুরুত্ব দিয়ে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে।