দস্তয়েভস্কি: মানব-অস্তিত্বের নিখুঁত দ্রষ্টা
Published: 11th, November 2025 GMT
১৮৪৯-এর ২২ ডিসেম্বর। তীব্র শীতের মধ্যে সেন্ট পিটার্সবার্গের পিটার অ্যান্ড পল দুর্গের বন্দিশালা থেকে কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দীকে বের করে আনা হয়েছে। আট মাস ধরে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে এদের ওপর। তাদের নিয়ে যাওয়া হলো সেমেনোভস্কি কোয়্যারে, যেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনানো হলো তাদের। চাষিরা যেমন পরে, তেমন লম্বা আলখাল্লা পরানো হলো, মাথায় পরানো হলো টুপি। প্রথম তিন বন্দীকে তিনটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো। তাদের চোখ বাঁধতে গেলে তিনজনের একজন প্রত্যাখ্যান করল, উদ্যত বন্দুকের নলের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকল সে। গুলি ছোড়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে এক বার্তাবাহক এল জারের ফরমান নিয়ে। তিন বন্দীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ রহিত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন জার। আসলে মৃত্যুদণ্ড, ফায়ারিং স্কোয়াড, শেষ মুহূর্তের রায়—সবই ছিল সাজানো এবং বন্দীদের শাস্তিরই অংশ। যে তিন তরুণ কঠিন এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তাদের একজনের চুল রাতারাতি সাদা হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়জন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়জন কারাভোগ শেষে লিখেছিল এক উপন্যাস, যার নাম ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’। ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি তাঁর নাম।
দুনিয়ায় এমন লেখক হাতে গোনা, যাঁরা সাহিত্যে নতুন কোনো জনরার জন্ম দেন এবং তাঁদের প্রভাব অনুভূত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ভিক্তর হুগো, লিও তলস্তয়, চার্লস ডিকেন্স, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আছেন এই দলে। এর বাইরে কিছু লেখক আছেন, যাঁরা কেবল সাহিত্যের নতুন আঙ্গিকেরই কেবল জন্ম দেন না, বহু বিচিত্র বিষয়ে উন্মোচন করেন নতুন দিগন্তেরও। এঁদের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ দস্তয়েভস্কি, যাঁর লেখা কেবল সাহিত্যমহলেই নয়; দার্শনিক ও মনস্তত্ত্ববিদদেরও মধ্যেও দারুণ সমাদৃত। তাঁর সম্বন্ধে ফ্রেডরিখ নিৎশে বলেছিলেন, ‘একমাত্র এই মনস্তত্ত্ববিদের কাছ থেকেই কিছু শিখতে পেরেছি আমি।’ অনেকে বলেন, ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসটির মাধ্যমে অস্তিত্ববাদের জন্ম দিয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। কামু, কাফকা, সার্ত্রেকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁর লেখা।
মৃত্যুদণ্ড, ফায়ারিং স্কোয়াড, শেষ মুহূর্তের রায়—সবই ছিল সাজানো এবং বন্দীদের শাস্তিরই অংশ। যে তিন তরুণ কঠিন এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তাদের একজনের চুল রাতারাতি সাদা হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়জন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়জন কারাভোগ শেষে লিখেছিল এক উপন্যাস, যার নাম ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’।জীবনটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না তাঁর, নানাবিধ দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এসব যন্ত্রণা মানব মনস্তত্ত্ব বোঝার ব্যাপারে দস্তয়েভস্কির মধ্যে জন্ম দিয়েছিল সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গির, প্রশ্ন তুলেছিলেন মানব–অস্তিত্ব নিয়েই। জারের রাশিয়ার সমালোচনা করার অপরাধে ফায়ারিং স্কোয়াডে যখন বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়াতে হয়েছিল, দস্তয়েভস্কির মনে হয়েছিল, তাঁর অস্তিত্বের এখানেই সমাপ্তি। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার সেই দুঃসহ স্মৃতি বাকি জীবন ভুলতে পারেননি। সেদিন নতুন করে জন্ম হয়েছিল তাঁর। এরপর চার বছর সাইবেরিয়ার শ্রমশিবিরে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। এসব অভিজ্ঞতা মানবজীবনের সত্যিকারের মূল্য সম্বন্ধে নতুন ভাবনার উদ্রেক করেছিল তাঁর মনে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবন ও মৃত্যু নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে ঘোরতর এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা সবাই। কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে মহাকালের অংশ হওয়া থেকে আমাদের আটকে রাখছে অনিশ্চয়তার পলকা একটা সুতো। জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতা রোমান্টিক এক সাদামাটা তরুণকে পরিণত করল কঠোর বাস্তববাদী মানুষে। ধর্মীয় চেতনা গাঢ়তর হলো তাঁর মনে। কারারক্ষকদের নির্মমতা তাঁকে বোঝাল উপযোগবাদী, সমাজতন্ত্রী আর উদারপন্থীরা মানবপ্রকৃতি সম্বন্ধে যে আশাবাদী ধারণা পোষণ করেন, সেটি বাস্তবে সত্যি নয়। দার্শনিকদের ধারণার তুলনায় মানুষের বাস্তব জীবন মৌলিকভাবেই ভিন্ন। তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসের সমালোচনা লিখতে গিয়ে দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন, ‘আমাদের সামাজিক-চিকিৎসকেরা যেমন ধারণা করেন, অশুভ তার চেয়ে অনেক গভীরভাবে প্রোথিত মানব–অস্তিত্বে। কোনো সামাজিক কাঠামোই অশুভকে মুছে দিতে পারবে না। মানবাত্মা যেমন আছে, রয়ে যাবে তেমনই। চূড়ান্ত বিচারে মানবাত্মার বিধিবিধানগুলো আসলে আমাদের খুব কম জানা, বিজ্ঞানের কাছে তারা এতই অস্পষ্ট, অসংজ্ঞায়িত আর রহস্যময় যে (ঈশ্বর ছাড়া) কারও পক্ষে এর চূড়ান্ত চিকিৎসক বা বিচারক হওয়া সম্ভব নয়।’
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার সেই দুঃসহ স্মৃতি বাকি জীবন ভুলতে পারেননি। সেদিন নতুন করে জন্ম হয়েছিল তাঁর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবন ও মৃত্যু নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে ঘোরতর এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা সবাই। কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে মহাকালের অংশ হওয়া থেকে আমাদের আটকে রাখছে অনিশ্চয়তার পলকা একটা সুতো।দস্তয়েভস্কির চরিত্রেরা জটিল ও বহু বর্ণিল। তাদের অনিশ্চিত কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য আচরণ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আওতার বাইরেও যে সহজাত একটি মানবমন আছে, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে আমাদের। আমরা বুঝতে পারি, কেবল নিজের সুবিধা নিশ্চিত করাই নয়, মানুষের অনেক আচরণের অর্থই সাধারণভাবে দুর্জ্ঞেয়। কখনো কখনো মানুষ নিজেকে শিকারে পরিণত করে স্রেফ নৈতিকভাবে উচ্চ অবস্থানে থাকার জন্য। ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ উপন্যাসে ফাদার জোসিমা বলেন, ‘ক্ষুব্ধ বা রাগান্বিত হওয়াটা কখনো কখনো খুবই আনন্দদায়ক।’ এর উত্তরে ফিওদর পাভলোভিচ বলেন, ‘কখনো কখনো এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় আচরণও।’ চরিত্রগুলোর অনিশ্চিত আচরণ ও মেজাজ–মর্জি দস্তয়েভস্কির এ বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটায় যে সে যে ইট-কাঠ-পাথরের মতো সাধারণ কোনো বস্তু নয়, সেটি প্রমাণের জন্য মানুষ যেকোনো কাজ করতে পারে, এমনকি তা আত্মবিধ্বংসী হলেও।
দস্তয়েভস্কির লেখার খাতা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপন য স জন ম দ হয় ছ ল অন শ চ আম দ র বন দ ক তত ত ব ত য়জন
এছাড়াও পড়ুন:
সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে হবে: ভূমি উপদেষ্টা
ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আমাদের বেতন হয়। তাই সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে হবে। কেউ যদি সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দ্রুত সেবার ক্ষেত্রে সবার আগে জনগণ।”
সোমবার (১০ নভেম্বর) রাজধানীর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) অডিটরিয়ামে ‘উপজেলা ভূমি অফিসের সেবা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক কর্মশালায় তিনি এসব কথা বলেন।
আরো পড়ুন:
‘জ্ঞান জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করাই প্রকৃত সাফল্য’
ভূমিসেবা নিশ্চিতের মূল ভিত্তি সঠিক সার্ভে ও সেটেলমেন্ট: ভূমি উপদেষ্টা
তিনি বলেন, “ভূমি প্রশাসন বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত, যার কার্যক্রম মূলত উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা ভূমি অফিসের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সাধারণ মানুষের ভূমি-সংক্রান্ত প্রায় সব সেবা এখান থেকেই দেওয়া হয়। তাই উপজেলা ভূমি অফিস নাগরিক সেবার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।”
তিনি আরো বলেন, “ভূমি সেবার মান ও সুশাসন নিশ্চিত করতে এখনও নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সেবায় জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্টেকহোল্ডারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কিভাবে কাজ করলে জনগণের কল্যাণ হবে, তা নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্ধারণ করতে হবে।”
সুশাসন ছাড়া অগ্রগতি অসম্ভব
ভূমি উপদেষ্টা বলেন, “সুশাসন একটি রাষ্ট্রের অগ্রগতির পূর্বশর্ত। এটি এমন একটি কাঠামো, যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার ও নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়—ভূমি সেবার ক্ষেত্রেও তাই।”
তিনি বলেন, “ভূমি মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এটি খাদ্য, শিল্প, আবাসন ও অর্থনীতির মূল উৎস। ভূমি সেবার মানোন্নয়ন কেবল প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি মানবিকতা, সততা ও দায়িত্ববোধের সমন্বয়।”
জনবান্ধব ভূমি প্রশাসনের আহ্বান
ভূমি উপদেষ্টা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “স্বচ্ছতা, দেশপ্রেম, সততা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে ভূমি খাতকে জনবান্ধব করা সম্ভব। সহকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে, অসততার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।”
তিনি বলেন, “অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কাজের জন্য ওপর থেকে সুপারিশ এলে দ্রুত হয়ে যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই দ্রুত সেবা পায় না। এসব অসঙ্গতি পরিহার করতে হবে।”
ভূমি খাতে সুশাসন এখন সময়ের দাবি
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “ভূমি খাত বাংলাদেশের উন্নয়ন ও জনকল্যাণে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। এটি শুধু উৎপাদনের উপকরণ নয়; এটি নাগরিকের অধিকার, জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ভূমি প্রশাসনে সুশাসনের অভাব ও স্বচ্ছতার ঘাটতির কারণে জনগণ ভোগান্তিতে ছিল।”
নতুন বাংলাদেশের পথে
ভূমি উপদেষ্টা আরো বলেন, “সহকারী কমিশনার (ভূমি) শুধু প্রশাসনিক দায়িত্বই পালন করেন না, বরং নির্বাচন পরিচালনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁরা নির্বাচনের সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।”
তিনি বলেন, “৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশকে পুরোনো জীর্ণতা ভুলে সামনে এগোতে হবে। সামনে নির্বাচন—নতুন আশা ও নতুন প্রত্যয়ের প্রতীক। তাই এমন একটি নির্বাচন উপহার দিতে হবে, যেখানে জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।”
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ।স্বাগত বক্তব্য রাখেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেন টিআইবির পরিচালক (সিভিক এনগেজমেন্ট) ফারহানা ফেরদৌস, প্রফেসর ড. সুরাইয়া খায়ের, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা), টিআইবি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. এমদাদুল হক চৌধুরী প্রমুখ।
ঢাকা/আসাদ/সাইফ