সমুদ্রের ঢেউ পাড়ে আছড়ে পড়ার মধ্যে অল্প হলেও একটি বিরতি থাকে। একটি ঢেউয়ের পর আরেকটি ঢেউয়ের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। চাইলে কেউ ঢেউগুলো গুনতেও পারেন। কিন্তু আমরা এখন এমন এক যুগে ঢুকে পড়েছি, যেখানে খবরের সমুদ্রে ঢেউগুলোর মধ্যে সময়ের কোনো বিরতি নেই। এই ঢেউয়ের ঝাপটায় আমরা যেন বিপর্যস্ত, আমাদের এখন অনেকটাই খেই হারানোর দশা। অথচ আমাদের খবর বা সংবাদ জানা এবং সংবাদপত্র পড়ার অভিজ্ঞতা শুরু হয়েছিল কত ভিন্নভাবে!
সত্তরের দশকের শেষের দিকে যখন পত্রিকা হাতে নিতে শুরু করি, তখন সংবাদপত্রই ছিল আমার কাছে খবরের একমাত্র সূত্র। আমার বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে। বাসায় তখন একটি পত্রিকাই রাখা হতো। একাধিক পত্রিকা রাখার আর্থিক সংগতি তখন ছিল না। বাবা তত দিনে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি দিনের প্রথম ভাগের সময় কাটাতেন মূলত পত্রিকা পড়ে। সকালে পত্রিকাটি আসামাত্রই তিনি তার দখল নিয়ে নিতেন। স্কুলে যাওয়ার আগে আমাকে পত্রিকাটি ‘পড়তে’ বা ‘দেখতে’ হতো উঁকিঝুঁকি মেরে। দেশ-বিদেশে আগের দিন বা তারও আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর খবর নিয়ে সকালবেলার পত্রিকা আমার কাছে হাজির হতো বিস্ময় নিয়ে। আরেকটি নতুন পত্রিকার জন্য, নতুন নতুন খবরের জন্য আবার ২৪ ঘণ্টার অপেক্ষা।
সবাই যখন সব জেনে যায়, তখন পাঠক, শ্রোতা বা দর্শককে আর কী বাড়তি দিতে পারে এ যুগের সংবাদমাধ্যম?তথ্যপ্রযুক্তি আর ইন্টারনেটের বর্তমান দুনিয়ায় পাঁচ দশকের কম আগের ওই সময়কে ‘প্রাগৈতিহাসিক’ যুগ বলে মনে হয়। খবর পাওয়ার জন্য এখন আর ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করতে হয় না। খবর নিজেই এখন তার মধ্যে আমাদের ডুবিয়ে রাখে। নানা মাধ্যমে খবর আসে এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায়, মিনিটে মিনিটে, সেকেন্ডে সেকেন্ডে বা আরও কম সময়ে। আর অনলাইনে খবর ‘ব্রেক’ করা নিয়ে সংবাদমাধ্যম-গুলোর প্রতিযোগিতা হয় এখন মিনিট আর সেকেন্ডের হিসাবে। ঘটনা ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা জেনে যাই কোথায় কী ঘটেছে। শুধু লেখার অক্ষরে নয়, ভিডিও বা অডিও সব মাধ্যমেই। সবাই যখন সব জেনে যায়, তখন পাঠক, শ্রোতা বা দর্শককে আর কী বাড়তি দিতে পারে এ যুগের সংবাদমাধ্যম?
বহুমতের পরিসর
‘কী ঘটেছে’ তা জানার পর পাঠকের কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে, কেন ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে বা যা ঘটেছে, তার সম্ভাব্য ফলাফল বা প্রতিক্রিয়া কী? সংবাদমাধ্যমে তাই বিশ্লেষণ বা মতামতের গুরুত্ব বেড়েছে। তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক যেকোনো ইস্যুতেই হোক না কেন। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতির একমুখী কোনো ব্যাখ্যা নেই। তাই এসব ইস্যুতে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোনের মতামত ও বিশ্লেষণ একজন পাঠককে এর নানা দিক বুঝতে সহায়তা করে। আমরা দেখছি যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে এখন মতামত ও বিশ্লেষণ বিশেষ মনোযোগ পাচ্ছে। এর পরিসর ও কলেবর বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে তথ্য দেওয়াই শুধু এই যুগের সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়, নানামুখী চিন্তাভাবনা তুলে ধরার মাধ্যমে জনচিন্তাকে প্রভাবিত করার কাজটিও তারা করে থাকে।
আপনারা, প্রথম আলোর পাঠকেরাও নিশ্চয়ই খেয়াল করছেন যে ‘কী ঘটেছে’ তা জানানোর পাশাপাশি ‘কেন ঘটেছে’ বা ঘটনার নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রকাশের দিকে আমরা নতুন করে বাড়তি মনোযোগ দিতে শুরু করেছি। শুধু সংখ্যা বাড়ানো নয়, বিষয় ও লেখক—এই দুই ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য ধরে রাখার অব্যাহত চেষ্টাও আমরা করে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রাধান্য দিই সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ ও মতামত তুলে ধরতে। একসময় পত্রিকার প্রথম পাতায় শুধু খবরই জায়গা পেত। প্রথম আলো সেই ধারা ভেঙেছে, এখন প্রায় নিয়মিতই প্রথম পাতায় কোনো না কোনো বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, পেশাজীবী বা প্রথম আলোর সাংবাদিকদের বিশ্লেষণ বা ভাষ্য থাকছে।
আমরা আমাদের দলনিরপেক্ষ সম্পাদকীয় নীতি বা অবস্থানের বাইরে সব ধরনের মত ও পথের চিন্তাও তুলে ধরার নীতিতে বিশ্বাস করি। তবে সংবাদমাধ্যম জনমত গঠন, জনরুচি তৈরি ও জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যেহেতু প্রভাব ফেলে, তাই মতামত, বিশ্লেষণ, অভিমত বা যেকোনো বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা বিভিন্ন লেখকের যেসব মতামত, পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ ছাপি, তা লেখকের নিজস্ব মত ঠিকই, কিন্তু এসব নানামুখী লেখা প্রকাশের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাঠকের চিন্তা উসকে দেওয়া, সমাজ ও রাজনীতির জটিল ও পেছনের ঘটনাগুলোকে তুলে ধরা; যাতে একজন পাঠক একটি ঘটনার নানা দিক সম্পর্কে জেনে নিজের মতো করে একটি ধারণায় আসতে পারেন। মতামত বা বিশ্লেষণধর্মী লেখা চিন্তাপ্রবাহকে গতিশীল করার মাধ্যমে পাঠককে কোনো না কোনোভাবে আলোকিত করে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন চিন্তাচর্চা
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে নতুন চিন্তাচর্চার পথ খুলে দিয়েছে। রাজনীতি, ইতিহাস বা সমাজচর্চা নিয়ে তথাকথিত মূলধারার আলোচনা ও তর্কবিতর্কের বাইরে ভিন্ন কোনো চিন্তার সুযোগ বা তা নিয়ে মতপ্রকাশ ও লেখালেখির পথ ছিল অনেকটাই রুদ্ধ। গণ-অভ্যুত্থান সেই বন্ধ পথের কপাট খুলে দিয়েছে, আলোচনা ও তর্কবিতর্কের পরিসর বেড়েছে। প্রথম আলো এসব নতুন চিন্তা ও নতুন লেখকদের তুলে আনছে পাঠকদের সামনে। সব মত ও নতুন নতুন চিন্তাকে তুলে ধরা ও নতুন লেখক যুক্ত করা—প্রথম আলোর মতামত বিভাগ এই নীতি মেনে চলছে এবং সামনেও চলতে চায়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নত ন চ ন ত প রথম আল র জন য র জন ত প রক শ আম দ র মত মত
এছাড়াও পড়ুন:
‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমেছে পাওয়ার গ্রিড
পুঁজিবাজারে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের ক্যাটাগরি পরিবর্তন করা হয়েছে। কোম্পানিটিকে ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আরো পড়ুন:
পুঁজিবাজারে দরপতন অব্যাহত
পুঁজিবাজারে সূচকের পতনে সপ্তাহ শুরু
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শর্ত অনুযায়ী, পরপর দুই বছর লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হওয়ায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়। মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) থেকে কোম্পানিটি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করছে।
এদিকে, ক্যাটাগরি পরিবর্তনের কারণে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডকে ঋণ সুবিধা দিতে ব্রোকার হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংককে নিষেধ করেছে ডিএসই, যা মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হয়েছে।
ঢাকা/এনটি/রফিক