ভূমিকম্পর সতর্কতা হিসেবে নেওয়া যেতে পারে বিমা, কমবে ক্ষতি
Published: 25th, November 2025 GMT
ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল বাংলাদেশ। গত শুক্রবার সকালের ভূমিকম্পে যে পরিমাণ ঝাঁকুনি হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো ভূমিকম্পে এতটা হয়নি। এই ভূমিকম্পে ১০ জনের প্রাণহানির সঙ্গে সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভূমিকম্পবিমার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের মানুষ সঞ্চয় দিয়ে বাড়ি বানান বা ফ্ল্যাট কেনেন। বাণিজ্যিক স্থাপনা করতে ব্যাংকের ঋণ নেন। সেই ঋণ বছরের পর বছর ধরে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু মানুষ বেশির ভাগ সময়ই মাথায় রাখে না, যেকোনো দুর্ঘটনায় এই সাধের সম্পদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বেশির ভাগ বাড়ি/ফ্ল্যাট বা বাণিজ্যিক ও শিল্প স্থাপনার মালিকেরা সম্পত্তি বিমার গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় থেকে অমূল্য সম্পদ সুরক্ষিত রাখার বিষয়েও সচেতনতার অভাব আছে। ফলে যখন দুর্ঘটনা হয়ে যায়, তখন আর কিছু করার থাকে না।
ভূমিকম্পবিমা আছেবাংলাদেশের বাড়ি বা ভবনমালিকেরা অগ্নিবিমার সঙ্গে সহযোগী বিমা হিসেবে ভূমিকম্পবিমা নিতে পারেন। এই বিমার প্রিমিয়ামও তেমন একটা বেশি নয়। যদিও বাংলাদেশের বেশির ভাগ সম্পত্তির মালিক জানেন না এ ধরনের বিমা দেশে আছে। এই অজ্ঞতা ও নানা কারণে সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে ভূমিকম্পবিমা নেওয়ার প্রবণতা একেবারেই কম বলে জানান খাত–সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকেরা বলেন, একধরনের নিয়তিবাদী অবস্থান আছে মানুষের মধ্যে। তাঁরা মনে করেন, এ ধরনের বিপর্যয় তো হতেই পারে। ফলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে এর সমাধান হবে না। কিন্তু বিমা যেটা করতে পারে সেটা হলো, ঝুঁকি হ্রাস করা।
এই বাস্তবতায় প্রগতি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাপিয়া রহমান বলেন, দেশে অগ্নিবিমার সঙ্গে ভূমিকম্প ও অন্যান্য সহযোগী বিমা বাধ্যতামূলক করা উচিত। একসময় তা বাধ্যতামূলক ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে গ্রাহকদের ধরে রাখতে তা আর বাধ্যতামূলক রাখা হয়নি। এতে বিমা কোম্পানিগুলোরও দায় আছে। সেই সঙ্গে তিনি মনে করেন, দেশের বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে (আইডিআরএ) আরও তৎপর হতে হবে। বিশেষ করে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগা এবং এত বড় ভূমিকম্প হওয়ার পরও অগ্নি ও ভূমিকম্পবিমা নিয়ে প্রচার-প্রচারণা নেই। এই পরিস্থিতি চলতে পারে না বলে তাঁর মত।ন
পাপিয়ার রহমান আরও বলেন, মূলত গ্রাহকেরা প্রিমিয়ামের খরচ কমানোর জন্য ভূমিকম্পবিমা নিতে চান না। যদিও এই বিমার প্রিমিয়াম তেমন একটা বেশি নয়। সেই সঙ্গে সরকারি পর্যায় থেকে এই বিমা শুরু করা উচিত।
কীভাবে নেওয়া যায়মানুষ যখন ভবন বা স্থাপনার জন্য অগ্নিবিমা করে থাকেন, তখনই এর সঙ্গে ভূমিকম্পবিমা নেওয়া যায়। দেশের কোন অঞ্চল কতটা ভূমিকম্পপ্রবণ, তার ওপর ভিত্তি করে প্রিমিয়ারম নির্ধারণ করে দিয়েছে আইডিআরএর রেটিং কমিটি। ভবন নির্মাণের মান ও ভূমিকম্পের প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে এই হার নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের প্রগতি ইনস্যুরেন্স, পাওনিয়ার ইনস্যুরেন্সসহ অনেক সাধারণ বিমা কোম্পানি এই বিমা দিয়ে থাকে।
বিদ্যমান প্রিমিয়াম হার অনুযায়ী, প্রতি হাজার টাকা বিমা অঙ্কের জন্য ভূমিকম্পবিমার প্রিমিয়াম হার ৪০ পয়সা থেকে ৩ টাকা ১০ পয়সা। অগ্নিবিমার ক্ষেত্রে ৪০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫০ পয়সা। এই প্রিমিয়াম দিয়ে কেবল এক বছরের জন্য সুরক্ষা পাওয়া যায়। সে কারণে প্রিমিয়ামের হার কম। এরপর গ্রাহক চাইলে তা নবায়ন করতে পারেন, নাও করতে পারেন।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পবিমার জন্য সাধারণভাবে যা কাগজপত্র লাগে তা হলো: বিমা করতে চাওয়া সম্পত্তির দলিলসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র, ভবনের আয়তন ও নির্মাণের তথ্য, আর্থিক মূল্যায়ন, বিমাকারীর নাম, ঠিকানা ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তথ্য, সাম্প্রতিক ছবি ও পূর্বের ক্ষতির রেকর্ড (যদি থাকে)। এর বাইরেও প্রয়োজনবোধে বিমা কোম্পানিগুলো অন্যান্য কাগজপত্র চাইতে পারে।
বিমা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তা না হলে দাবি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিকে দোষারোপ করা উচিত নয় বলেই তাঁরা মনে করেন।
বড় ধরনের ভূমিকম্প বা বিপর্যয় ঠেকানোর ক্ষমতা হয়তো মানুষের নেই। কিন্তু মানুষ যেটা করতে পারে সেটা হলো, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া। ভবন, স্থাপনা নির্মাণে সতর্কতার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার আগাম ব্যবস্থা, এ ছাড়া বড় ধরনের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কথা কল্পনা করাও কঠিন। প্রিয়জনের না থাকার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই। কিন্তু আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হতে পারে বিমা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ ম কম প র জন য এই ব ম ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
কাপড় খোলা বাজারে বিক্রি: অ্যাডভান্স এ্যাটায়ারকে নোটিশ
তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাডভান্স এ্যাটায়ার’ বন্ড সুবিধা নিয়ে ৩৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৩ কেজি বা প্রায় ৩ হাজার ৪৭২ মেট্রিক টন কাপড় আমদানি করেছে। এর প্রায় অর্ধেক কাপড়ই খোলা বাজারে বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই অনৈতিক কাজের মাধ্যমে পোশাক কোম্পানিটি সরকারের কোটি কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বন্ড সুবিধা ব্যবহার করে খোলাবাজারে কাপড় বিক্রি করার অভিযোগের প্রমান পাওয়া তৈরি পোশাক কোম্পানি অ্যাডভান্স এ্যাটায়ার কে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই সঙ্গে সরকারের রাজস্ব ফাঁকির ৬৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা পরিশোধ করতে প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিশ দিয়েছে এনবিআর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, অ্যাডভান্স এ্যাটায়ার ২০১০ সালে বন্ড লাইসেন্স পেয়েছে। এরপর থেকেই কোম্পানিটি বন্ড সুবিধায় কাপড় আমদানি করে আসছে। এসব আমদানি করা কাপড়ের অধিকাংশই খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয় অ্যাডভান্স এ্যাটায়ার-এমনই অভিযোগ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি খোজ নেয় ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট।
এদিকে, চলতি গত ২৩ সেপ্টেম্বর বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা অ্যাডভান্স এ্যাটায়ারের ওয়্যারহাউস পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে কোম্পানির আমদানি করা কাগজপত্র যাচাই ও ইনভেন্ট্ররি করা হয়। এ সময় আমদানি রপ্তানির কাগজপত্র যাচাই ও মজুত পণ্যে বেশ গরমিল পায় বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি করা বিপুল পরিমাণ কাপড় খোলাবাজারে বিক্রির প্রমাণ পায় বন্ড কর্মকর্তারা। কোম্পানির আমদানি করা কাপড় খোলা বাজারে বিক্রির বিষয়টি নিয়ে এক পর্যায়ে বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মশিউর রহমান স্বীকার করেছেন। গত ৬ অক্টোবর কোম্পানিটি পরিদর্শনের প্রতিবেদন জমা দেয় কর্মকর্তারা।
অ্যাডভান্স এ্যাটায়ারের চেয়ারম্যান সালাম হোসেন চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করেনি। বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা ওয়্যারহাউস পরিদর্শন করে কি পেয়েছে সেটি আমাদেরকে জানায়নি। বুঝেন তো .......তারা কিছু ...চায়।”
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যাডভান্স এ্যাটায়ার লিমিটেড ২০২৪ সালের ৪ মার্চ থেকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৩ কেজি কাপড় আমদানি করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে আগের কাপড় মজুত রয়েছে ৯৩ হাজার ৪৫৪ কেজি। আগের মজুতসহ প্রতিষ্ঠানটিতে কাপড় থাকার কথা ৩৫ লাখ ৬৬ হাজার ২০৭ কেজি। প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কাগজপত্র অনুযায়ী, ১৭ লাখ ১৪ হাজার ৩২৮ কেজি বা ১ হাজার ৭১৪ মেট্রিক টন কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করে তা রপ্তানি করা হয়েছে। তবে এসব পণ্য সত্যিই রপ্তানি করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।রপ্তানির তৈরি পোশাক বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যারহাউসে আমদানি করা বাকি ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৪৬৭ কেজি বা ১ হাজার ৪৪৩ দশমিক ৪৬৭ মেট্রিক টন কাপড় থাকার কথা। কিন্তু ওয়্যারহাউসে এসব বিপুল পরিমাণ কাপড় নেই। এই কাপড় ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করেনি, বন্দর থেকে সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে অ্যাডভান্স এ্যাটায়ারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অবৈধভাবে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে বিক্রি করা এই কাপড়ের মূল্য প্রায় ৮০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৬৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা।পরিদর্শন প্রতিবেদনে কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ঝুঁকি থাকায় ফাঁকি দেওয়া শুল্ককর আদায়ে দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানো নোটিশ ও অনিয়ম, জালিয়াতির ঝুঁকি থাকায় প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত করার সুপারিশ করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১২ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে বিক্রি করে ১ হাজার ৪৪৩ মেট্রিক টন কাপড়ের ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর ৬৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা পরিশোধে দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের একজন কর্মকর্তা জানান, পোশাক কারখানা অ্যাডভান্স এ্যাটায়ারের বন্ড লাইসেন্সের বিপরীতে কাপড় আমদানি করত। একই সঙ্গে তারা অবৈধভাবে খোলা বাজারে আমদানি করা কাপড় বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিত। বিষয়টি যাচাই করে প্রমান পাওয়া গেছে। আগেও এমন ঘটনার প্রমান পেয়েছিল বন্ড কমিশনারেট, প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করা হলেও অদৃশ্য কারণে প্রতিষ্ঠানটি ছাড় পেয়ে যায়। লাইসেন্স বাতিল করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও একটি প্রভাবশালী মহলের কারণে সেটি হয়নি। এবারও ম্যানেজের চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তাই অ্যাডভান্স এ্যাটায়ারকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশের জবাবের পর আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
জানা গেছে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক মানিকগঞ্জের ঘিওর পুখরিয়া এলাকায় অ্যাডভান্স এ্যাটায়ারের কারাখানা। এই পোশাক কোম্পানিটি ২০১০ সালে বন্ড লাইসেন্স পেয়েছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠান অ্যাডভান্স এ্যাটায়ার। কোম্পানিটি শার্ট, বোতাম, প্যান্ট, জ্যাকেট উৎপাদন ও রপ্তানি করে।
ঢাকা/নাজমুল/এসবি