ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্রোহী হলের প্রভোস্টকে বহালের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মিছিল করে নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।

পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী আমার কাছে সমান। গতকাল বুধবার রাতে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা অযৌক্তিক এবং জিম্মি করে করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এটি কখনো কাম্য নয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও জিম্মি করে ভিসির কাছ থেকে পদত্যাগপত্র নিয়েছিল, কিন্তু তা টেকেনি।’

উপচার্য আরও বলেন, ‘সব স্টেকহোল্ডার যে দাবিদাওয়া আছে, সে অনুযায়ী কাজ করব। যদি তা করতে পারি, তাহলে থাকব, তা না হলে থাকব না। অনেক খারাপ ল্যাঙ্গুয়েজে সম্মানিত শিক্ষকদের অসম্মানিত করেছে, জুতা নিক্ষেপ করেছে, এর বিচার হবেই।’ লিখিত দাবিগুলো বিবেচনায় এনে তদন্ত কমিটির সুপারিশ সাপেক্ষে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন উপাচার্য।

এর আগে বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। পরে নতুন প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, মব সন্ত্রাসের চাপে পড়ে অনৈতিক দাবি মেনে নেওয়ার জন্য প্রশাসনের দুর্বলতার নিন্দা জানাচ্ছি। প্রশাসন কীভাবে কোনো প্রকার যাচাই–বাছাই, তদন্ত ছাড়াই প্রভোস্ট সাইফুল স্যারকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে যেতে পারে? প্রশাসন কি চাইলে পারত না সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার প্রকৃত সত্য বের করতে? গুটিকয় মানুষের অনৈতিক দাবি মেনে নেওয়ার আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করা উচিত ছিল না? তাঁদের মনে হয়েছে প্রশাসন এখানে ব্যর্থ।

এ সময় শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি জানান। এগুলো হলো বিদ্রোহী হল প্রভোস্টের সম্মানহানির সঙ্গে জড়িত সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তদন্ত ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক বিদ্রোহী হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে নেওয়া সব ধরনের অন্যায় ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাতিল বলে ঘোষণা করতে হবে। যেসব অনলাইন পেজ ও গ্রুপ মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থীকে উসকে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গতকাল ইফতারের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিদ্রোহী হলের প্রভোস্ট সাইফুল ইসলামের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ করেন। হল প্রশাসনের আয়োজনে ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও ছাত্রাবাসের সিট বাতিলসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে শিক্ষার্থীদের এসব দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন উপাচার্য।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

নুয়ে পড়া লিচুগাছে শতবছরের স্মৃতি

টিলাভূমির দুটি বাড়ি। বাড়ি পেরিয়ে দক্ষিণ পাশে আরও তিনটি বাড়ি। পাশাপাশি পাঁচটি বাড়ির ছায়া হয়ে আছে নয়টি লিচুগাছ। গাছগুলো দেখেই বোঝা যায় অনেক পুরোনো। শাখা-প্রশাখাবেষ্টিত। নুয়ে পড়া গাছের ডালগুলো বাঁশ দিয়ে ঠেস দিয়ে রাখা। মাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে শিকড়।

বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নয়টি গাছের মধ্যে একটি গাছ দেড় শতাধিক বছরের পুরোনো। বাকি আটটি গাছও কাছাকাছি বয়সের। এই গাছগুলো থেকে চারা হয়েছে। সংখ্যা লক্ষাধিক। লিচুগুলো দেড় শতাধিক বছর থেকে ‘ঘিলাছড়ার লিচু’ নামে সিলেটে সুনাম কুড়িয়েছে।

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নের মধ্য যুধিষ্ঠিপুর গ্রামে চৌধুরী বাড়িতে আছে প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো এসব লিচুগাছ। এলাকায় অবশ্য বাড়িটিকে দক্ষিণ বাড়ি ও উত্তর বাড়ি হিসেবেই সবাই চেনেন।

উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ঘিলাছড়া ও মাইজগাঁও ইউনিয়নে লক্ষাধিক লিচুগাছ আছে। এর মধ্যে ঘিলাছড়ায় যে লিচু পাওয়া যায়, সে জাতের লিচুর সংখ্যাই বেশি। দেড় শ বছর ধরে ঘিলাছড়ার লিচুর সুনাম সিলেটজুড়ে। লিচুর মৌসুমে বিশেষ চাহিদা আছে এই লিচুর। ঘিলাছড়া ইউনিয়নে আছে ২০টি গ্রাম। গ্রামের এমন কোনো বাড়ি নেই, যেখানে লিচুগাছ নেই। প্রতিটি বাড়িতে এক-দুটি লিচুগাছ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া কোনো বাড়িতে অর্ধশত গাছও আছে। সড়কের পাশে কিংবা টিলা এলাকায় আছে লিচুগাছ। ইউনিয়নের টিলাবেষ্টিত এলাকায় ঢুকলেই স্বাগত জানাবে নুয়ে পড়া লিচুগাছ।

ঘিলাছড়ার লিচুর উৎপত্তি মূলত মধ্য যুধিষ্ঠিপুর গ্রাম থেকে। গ্রামের মধ্যবর্তী জায়গায় চৌধুরী বাড়ি। দক্ষিণ পাশের বাড়ির বাসিন্দা নূর মাহমুদ চৌধুরী। গ্রামে গিয়ে বড় লিচুগাছ সম্পর্কে যে কারও কাছে জানতে চাইলে সবাই মধ্য যুধিষ্ঠিপুরের নূর মাহমুদদের বাড়ি দেখিয়ে দেন।

নূর মাহমুদ চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, তাঁদের চার পুরুষ ধরে আছে দুটি লিচুগাছ। পাশাপাশি পাশের চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে আরও সাতটি গাছ। মূলত তাঁর বাবা সৈয়ফুদ্দিন চৌধুরীর (আতা মিয়া চৌধুরী) দাদা নজির আলীকে গাছগুলো দিয়েছিলেন ভারত থেকে আসা এক দরবেশ। যিনি এলাকায় একসময় আয়ুর্বেদিক ওষুধ দিতেন। ওই দরবেশ ভারতে ফিরে যাওয়ার আগে দাদা নজির আলীকে ডেকে লিচুর একটি গাছ দিয়েছিলেন। ওই দরবেশ তাঁদের বাড়ির পূর্ব পাশে জাহাজের টিলায় থাকতেন। তিনি ফিরে যাওয়ার আগে গাছটি তাঁদের বাড়িতে নিয়ে রোপণ করতে বলেন।

পরে লিচুগাছটি উপড়ে নিয়ে ১২-১৫ জন মিলে বাঁশ ও রশি দিয়ে বেঁধে নিজের বাড়ির পূর্ব পাশে লাগিয়েছিলেন নজির আলী। গাছটি থেকে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও গ্রামের মানুষজনের মাধ্যমে গুটি কলম ছড়ায়। এভাবে পুরো ইউনিয়নসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এবং উপজেলার বাইরেও সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় চারা নিয়ে ছড়িয়েছে ঘিলাছড়ার লিচু। তাঁদের বাড়ির লিচুগুলো বিক্রি করা হয় না। নিজেরা খাওয়ার জন্য রেখে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন।

নূর মাহমুদ চৌধুরী জানান, তাঁর বয়স বর্তমানে ৬০ বছর। বাবা সৈয়ফুদ্দিন চৌধুরী মারা গেছেন প্রায় ৯০ বছর বয়সে। বাবার দাদা যেহেতু গাছটি লাগিয়ে গিয়েছিলেন, সে হিসাবে গাছের বয়স এখন দেড় শ বছরের বেশি। 

নূর মাহমুদের উত্তরের পাশের ঘরে থাকেন তাঁর চাচাতো ভাই শাহনেওয়াজ চৌধুরী। কথা হয় শাহনেওয়াজ চৌধুরী (৬৬) ও তাঁর স্ত্রী দেওয়ান আশরাফির (৫৫) সঙ্গে। শাহনেওয়াজ চৌধুরী ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিজেরা লিচুগাছে গুটি কলম করতেন। পরে সেগুলো ২ টাকা, ৫ টাকায় বিক্রি করতেন। লিচু বিক্রির টাকা দিয়ে বাজারে গিয়ে বিভিন্ন খাবার খেতেন। এ ছাড়া লিচুর বীজ থেকেও চারা হয়। গাছ থেকে পড়া লিচু থেকেও অনেক চারা হয়ে যায়, সেগুলোও অনেকে সংগ্রহ করে নিজেদের মতো লাগিয়েছেন। তবে এখন আর কলম করা হয় না।

লিচুর মৌসুমে শাহনেওয়াজদের বাড়িতে স্বজনদের আনাগোনা বেড়ে যেত। তাঁরাও স্বজনদের লিচুর মৌসুমে দাওয়াত দিতেন। ঝড়বৃষ্টি হলে উঠানজুড়ে পড়ে থাকে টকটকে লাল লিচু। এ সময় গ্রামের বাসিন্দারা লিচু কুড়াতে হাজির হন। বাড়ির লোকজন এতে বাধা দিতেন না। আগে একেকটি গাছে ৩০ হাজারের মতো লিচুর ফলন হতো। এখন ফলন কমেছে। 

এর বাইরে কোনো কোনো বছর গাছে লিচু আসে না। গত বছরও গাছে লিচু হয়নি। তবে শাহনেওয়াজ চৌধুরী গাছগুলোতে নিজের মতো সার, পানি দিয়ে পরিচর্যা করেন। কিন্তু কোনো কীটনাশক দেন না। বাদুড় ও কাঠবিড়ালি তাড়ানোর জন্য টিনের বক্স ঝুলিয়ে রাখেন। বাড়িতে বর্তমানে লোকজন কম, এ জন্য দুটি গাছের লিচু রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দেন।

স্বামীর কথার সঙ্গে দেওয়ান আশরাফি যোগ করেন, তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। সে সময় লিচুর মৌসুম ছিল। স্বামীর বাড়িতে লিচুগাছগুলো দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাড়িতে আসার পর গাছে লাল লাল লিচু দেখতে পেরেছিলেন। লিচুর স্বাদও ছিল অন্য লিচুর তুলনায় ভিন্ন, অনেকটা টক-মিষ্টি।

বাড়িতে পাঁচটি লিচুগাছ আছে জানিয়ে নিজ ঘিলাছড়ার বাসিন্দা নাহিদুর রহমান বলেন, সেগুলো মধ্য যুধিষ্ঠিপুর থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর নিজের হাতে সংগ্রহ করা না হলেও বড় গাছ থেকে চারা নিয়েছিলেন বলে সেটি জানেন তিনি। নাহিদুর বলেন, ‘শুধু আমরা না, এলাকার প্রায় সব বাড়িতেই ঘিলাছড়ার লিচুগাছ মধ্য যুধিষ্ঠিপুর থেকে ছড়াইছে।’

ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুব্রত দেবনাথ বলেন, উপজেলায় প্রায় ৭০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়। ঘিলাছড়ার লিচুর স্বাদ টক-মিষ্টি ও কিছুটা সুগন্ধ আছে। এলাকায় এ জাতের লিচুই বেশি। ঘিলাছড়ার লিচু শতবছরের অধিক পুরোনো একটি গাছ থেকে ছড়িয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। এ লিচু ঐতিহ্যবাহী। এ জাতের লিচু দিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি এর সঙ্গে সংমিশ্রণ করে উন্নত নতুন জাত উদ্ভাবন করা প্রয়োজন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ