এই সময় হঠাৎ মুখ বেঁকে যায় কেন? কিছু পরামর্শ
Published: 14th, June 2025 GMT
ঋতু পরিবর্তনের সময় নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। এ সময় মুখ বেঁকে যাওয়া রোগে (বেলস পলসি) আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি হয়। ভাইরাসের আক্রমণজনিত এ রোগে যে কোনো বয়সী লোক আক্রান্ত হতে পারেন। তবে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের এ রোগ বেশি হয়। বিশেষ করে ভ্রমণের সময় ঠান্ডা বাতাস লাগলে, বেশি রাত জাগলে হঠাৎ এ রোগ দেখা দিতে পারে।
উপসর্গ: এ রোগটি সহজেই নির্ণয় করা যায়। বেশির ভাগ রোগীই কানের গোড়ায় বা ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করেন। কুলি করতে গেলে আক্রান্ত অংশের পাশ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতে পারেন না। কথা বলতে বা হাসতে গেলে মুখ একদিকে বেঁকে যায়। খাবার মুখের ভেতরের আক্রান্ত অংশে জমা হয়ে থাকে। হঠাৎ এসব উপসর্গ দেখা দিলে উল্লিখিত রোগটি হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।
ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা: আক্রান্ত স্থানের প্রদাহ কমানোর জন্য চিকিৎসকরা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দিয়ে থাকেন। ইদানীং অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধও স্বল্প মেয়াদে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ফিজিওথেরাপি: কানের গোড়ার যে ছিদ্র দিয়ে সপ্তম স্নায়ু প্রবেশ করে, ঠিক সেই অংশে স্নায়ুটি ফুলে ওঠে। ফলে স্নায়ুটি চাপে পড়ে যায় এবং উদ্দীপনা চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। ঠিক এ অংশে ইলেকট্রো-ফিজিওথেরাপি প্রয়োগ করে স্নায়ু ও আশপাশের মাংসপেশি এবং তন্তুগুলোর প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ ছাড়া মুখমণ্ডলের মাংসপেশিগুলোকে ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে সংকুচিত ও প্রসারিত করে স্থায়ীভাবে মুখ বেঁকে যাওয়াজনিত জটিলতা দূর করা যায়। এ ছাড়া ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞরা বিশেষ ধরনের ব্যায়াম দেখিয়ে দেন, যা রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে তোলে।
দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে: এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ৫০ শতাংশ রোগীই সাত থেকে ২১ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। বাকি রোগীরা তিন মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন। খুব অল্পসংখ্যক রোগীর মুখ স্থায়ীভাবে বেঁকে যায়। তবে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে প্রায় সব রোগীই সুস্থ হয়ে ওঠেন।
পরামর্শ: ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার খাবেন না। আরামদায়ক ও খোলামেলা পরিবেশে অবস্থান করুন। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ যেসব ব্যায়াম দেখিয়ে দেন, তা আয়নার সামনে বসে অনুশীলন করুন। চুইংগাম চিবোতে পারেন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। আক্রান্ত চোখকে বাতাস ও তীব্র আলো থেকে বাঁচাতে বড় ও কালো কাচের চশমা ব্যবহার করুন।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ফিজিওথেরাপি ও রিহ্যাব বিভাগ, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
কিডনি যেভাবে ভালো রাখবেন
কিডনি নিয়ে লিখতে বসে সজীবের কথা মনে পড়ে গেল। ২৬ বছরের টগবগে তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসিতে মাস্টার্স করে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে কাজ করত। একদিন মাথা নিচু করে সামনে বসে বলল, ‘স্যার, খুব দ্রুত হাঁপিয়ে যাই। মাত্র বিয়ে করেছি, শ্বশুরবাড়ির এত দাওয়াত, কিন্তু খেতে পারি না, বমি বমি লাগে।’
পরীক্ষা করে দেখি রক্তচাপ অনেক বেশি, ফ্যাকাসে চেহারা, রক্তশূন্যতা। পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে দেখা গেল, ৯৫ ভাগ কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। সে টেরই পায়নি। ঘাতক ব্যাধি নীরবে তার কিডনি শেষ করে দিয়েছে।
তেমন কোনো উপসর্গ ছাড়াই নীরবে বিকল হয়ে যেতে পারে কিডনি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কিডনি রোগ ক্রমাগত বেড়ে চলছে। কিডনি রোগের কারণে শুধু ব্যক্তিগত জীবনই বিপর্যস্ত হয় না, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপরও বিশাল অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়।
কিডনি রোগের কারণকিডনি রোগের সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো হলো—অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, নেফ্রাইটিস, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, ব্যথানাশক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার, জন্মগত ও বংশগত কিডনি রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ও কিডনির পাথর। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়, প্রায় সব কটি কারণই আমাদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত। একটু সচেতন হলেই এগুলো প্রতিরোধ করা যায়। তবে সজীবের ঘটনা একটু ভিন্ন। সজীবের মূত্রতন্ত্রে জন্মগত একটি ত্রুটি ছিল। যদি তার মা–বাবা একটু সচেতন থাকতেন, তাহলে ছোট্ট একটা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুকালেই তা ঠিক করা যেত। আজ তার এই পরিণতি হতো না।
উপসর্গ ও লক্ষণবেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সজীবের মতো ৭০ থেকে ৯০ ভাগ নষ্ট হওয়ার আগপর্যন্ত কিডনি বিকল হওয়ার কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না। তারপরও যেসব লক্ষণ বা উপসর্গ থাকলে কিডনি আক্রান্ত মনে করতে হবে—
প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা প্রস্রাবের রং পরিবর্তন।
পা, পায়ের গোড়ালি ও চোখের নিচে ফোলা ভাব।
অবসাদ ও দুর্বলতা।
শ্বাসকষ্ট।
বমি বমি ভাব বা বমি, অরুচি।
বিনা কারণে গা চুলকানো।
রাতে বারবার প্রস্রাব, প্রস্রাবে ফেনা বা প্রস্রাবে রক্ত, প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া ও ঘন ঘন প্রস্রাব।
মেরুদণ্ডের কোনো এক পাশে অথবা তলপেটে ব্যথা।
এ ছাড়া শিশুদের জন্মগত কোনো ত্রুটি আছে কি না, তা পরীক্ষা করা ও প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা জরুরি।
আরও পড়ুনএই রোগ হলে কিডনি বিকলসহ যেসব প্রাণঘাতী সমস্যা দেখা দিতে পারে ১০ মে ২০২৫কিডনি বিকল হওয়া প্রতিরোধেকিডনি একবার সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলে বেঁচে থাকার উপায় ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এই চিকিৎসার ব্যয় এত বেশি যে এ দেশের শতকরা ১০ ভাগ রোগীও তা বহন করতে পারেন না। অন্য দিকে, একটু সচেতন হলেই প্রাথমিক অবস্থায় রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা ও সুস্থ জীবনচর্চার মাধ্যমে প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত এই বৈকল্য ঠেকানো যায়।
প্রাথমিক অবস্থায় রোগ শনাক্ত করতে হলে কারা কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছেন, আগে তা জানতে হবে। যাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বংশগত কিডনি রোগ আছে; যাঁরা ধূমপায়ী, মাদকসেবী; যাঁদের ওজন বেশি, বেশি দিন যাঁরা ব্যথার ওষুধ নিয়েছে, বারবার কিডনিতে পাথর বা মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ হয় যাঁদের, শিশুকালে যাঁদের কোনো কিডনি রোগ ছিল, এমন কি ৪০ বছরের ওপর যাঁদের বয়স, তাঁরা সবাই কিডনি বৈকল্যের ঝুঁকিতে আছেন। বছরে দুইবার মাত্র দুটি পরীক্ষা করলেই প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। প্রথমটি হলো প্রস্রাবে আমিষ যায় কি না, তা পরীক্ষা করা এবং দ্বিতীয়টি হলো রক্তের ক্রিয়েটিনিন। ক্রিয়েটিনিন রিপোর্ট থেকে হিসাব করে বের করা যায়, ১০০ ভাগে কত ভাগ কিডনি কাজ করছে বা ইজিএফআর (কিডনি রোগ কোন স্তরে আছে, তার পরীক্ষা) স্কোর।
সচেতন হন, সুস্থ থাকুনকিডনি রোগের হার ব্যাপক এবং কিডনি বিকল হওয়ার পরিণতি ভয়াবহ। চিকিৎসা না করলে মৃত্যু অবধারিত, আবার চিকিৎসা করতে গেলে আর্থিকভাবে নিঃস্ব বা দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা। পক্ষান্তরে আমরা যদি সচেতন হই, সুস্থ জীবনধারার চর্চা করি, তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই মরণব্যাধি ঠেকাতে পারি। তাই কিডনি রোগ সম্পর্কে জানতে হবে, সবাইকে জানাতে হবে, বিনিময়ে নিজে পাবেন সুস্থ দীর্ঘ জীবন, দেশ পাবে কর্মঠ ও শক্তিশালী সুস্থ–সবল জাতি।
আরও পড়ুন‘নিরাপদ’ পানীয়টি হতে পারে তরুণদের কিডনি রোগ ও অ্যাংজাইটির কারণ১৯ মে ২০২৫কিডনি ভালো রাখার ৮টি উপায়রুটিন করে নিয়মিত ব্যায়াম করা বা সচল থাকা। দিনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট সপ্তাহে ৫ দিন জোরে হাঁটা।
পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। নিয়মিত শাকসবজি ও ফল খাওয়া, চর্বিজাতীয় খাবার ও লবণ কম খাওয়া।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত রক্তের শর্করা ও প্রস্রাবের অ্যালবুমিন পরীক্ষা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন এ-ওয়ান সি (HbA1c) সাতের মধ্যে রাখা।
চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক ও তীব্র ব্যথার ওষুধ সেবন না করা।
ধূমপান ও মাদক বর্জন।
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রেগীদের কিডনির কার্যকারিতা প্রতি ছয় মাস অন্তর পরীক্ষা করা।
উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে (১৩০/৮০–এর নিচে আর যাঁদের প্রস্রাবে অ্যালবুমিন থাকে, তাঁদের ১২০/৭০–এর নিচে) রাখা। সুপ্ত উচ্চ রক্তচাপ আছে কি না, নিয়মিত তা পরীক্ষা করতে হবে।
পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি খাওয়া, পানিশূন্যতা পরিহার।
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ, সভাপতি, কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) এবং অধ্যাপক, কিডনি রোগ বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
আরও পড়ুনএই ৭ বদভ্যাসে আপনার কিডনি হতে পারে বিকল১৪ এপ্রিল ২০২৫