শিক্ষক-কর্মচারী ছাড়া কেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
Published: 30th, June 2025 GMT
ময়মনসিংহ শহরে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) বর্তমান পরিস্থিতি চরম হতাশাজনক। নবনির্মিত ভবন, তিনটি ব্যাচে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী—সবকিছুই আছে, কিন্তু নেই কোনো শিক্ষক ও জনবল। শিক্ষক ছাড়া একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে চলে?
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করলেও শুরু থেকেই কোনো স্থায়ী শিক্ষক বা প্রশাসনিক জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মাত্র দুজন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সপ্তাহে দুই দিন করে ক্লাস নিচ্ছেন, যা ১৫০ জন শিক্ষার্থীর পাঠদানের জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত। দীর্ঘ ছয় মাস ধরে প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ক্লাস প্রায় বন্ধ। ব্যবহারিক সুবিধার অভাবে ল্যাব থাকা সত্ত্বেও সেগুলো অব্যবহৃত পড়ে আছে। নেই পর্যাপ্ত চেয়ার, টেবিল, এমনকি হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিছানাও। এর ওপর ৯ লাখ ১১ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় সম্প্রতি বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় এই অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত চিত্রই প্রকাশ ঘটেছে। সংকট নিরসনে শিক্ষার্থীদেরই দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে, এটি আরও বেশি হতাশাজনক।
উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রতিষ্ঠানটিতে নারী শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাঝুঁকিতে রয়েছেন। একজন মাত্র নৈশপ্রহরী দিয়ে এত বড় একটি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। বাইরের উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের অবাধ প্রবেশ শিক্ষার্থীদের জন্য ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছে। যখন একটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ‘অনাথ বা এতিমের মতো’ অনুভব করেন এবং কোনো সমস্যা হলে কার কাছে যাবেন তা জানেন না, তখন বুঝতে হবে পরিস্থিতির গভীরতা কতটা ভয়াবহ।
সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ছাইফুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, ৪৩৫ জন জনবলের চাহিদা পাঠানো হলেও মাত্র ৩৫ জনের অনুমোদন চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফাইল আটকে আছে। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মিছবাহ উদ্দীন আহমেদ কেবল ‘প্রক্রিয়া চলমান’ বলেই দায় সারছেন। প্রশ্ন হলো, এই প্রক্রিয়া আর কত দিন চলবে?
বাংলাদেশে মোট ২৩টি সরকারি আইএইচটি রয়েছে। যদি ময়মনসিংহের আইএইচটির মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও এমন জনবলসংকট থাকে, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্য কীভাবে পূরণ হবে? এটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের সংকট নয়, এটি দেশের স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। সরকারকে অবিলম্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু ভবন নির্মাণ করলেই হবে না, শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত শিক্ষক, জনবল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। অর্থ মন্ত্রণালয়ে আটকে থাকা জনবলকাঠামোর অনুমোদন দ্রুত করা এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায় এই আইএইচটিগুলো কেবল কংক্রিটের কাঠামো হয়েই থাকবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
একদিকে ছাঁটাই, অন্যদিকে নিয়োগে তোড়জোড় ইসলামী ব্যাংকের
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ‘অবৈধ প্রক্রিয়া’য় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করা শুরু করেছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। এ জন্য নানা ধরনের কৌশল নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকটি ইতিমধ্যে দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে সরাসরি বরখাস্ত করেছে, যার মধ্যে ব্যাংকের আয়োজনে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারাও রয়েছেন। আবার অনেকে চাকরি ছেড়ে পালিয়েছেন। মূল্যায়ন পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ায় ৪ হাজার ৯৫৩ জনকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করা হয়েছে। এদিকে ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি ব্যাংকটি নতুন করে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এমন পদক্ষেপে ব্যাংকটি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখল করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপ। এরপর ব্যাংকটি থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের করে নিয়ে যাওয়া হয় গত বছরের ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত। এই সময়ে ব্যাংকটি থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বের করে নেন এস আলম গ্রুপ ও আওয়ামী লীগ–সমর্থিত ব্যবসায়ীরা। এসব টাকা ফেরত আসছে না। ফলে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪২ দশমিক ২২ শতাংশ। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পরীক্ষা ছাড়াই প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়, যা এখন গলার কাঁটা হয়ে পড়েছে ব্যাংকটির জন্য।
বক্স বসিয়ে নিয়োগবিভিন্ন সূত্র জানায়, সাইফুল আলম বা এস আলমের গ্রামের বাড়ি পটিয়া ও চট্টগ্রামের অফিসে চাকরি দেওয়ার জন্য বক্স বসানো হয়। পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী উপজেলাভিত্তিক আলাদা বক্সে জীবনবৃত্তান্ত জমা পড়লেই তখন ইসলামী ব্যাংকে চাকরি দেওয়া হতো। পাশাপাশি এস আলমের গৃহকর্মী ও তাঁর স্বামীকেও ব্যাংকে উচ্চ বেতনে চাকরি দেওয়া হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে কোনো জীবনবৃত্তান্ত পাঠালেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশেও বড় নিয়োগ হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা ছাড়াই এগুলো হচ্ছিল।
এস আলমের দখলের আগে ২০১৬ সাল শেষে ব্যাংকটির জনবল ছিল ১৩ হাজার ৫৬৯ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার ছিল ৭৭৬ জন। বর্তমানে ব্যাংকটিতে প্রায় ২২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর প্রায় ১১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী চট্টগ্রাম বিভাগের।
নীতিমালা না মেনে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছিলেন, সবার যোগ্যতা যাচাই হবে। ব্যাংকের সেবার মান ধরে রাখতে যোগ্য কর্মকর্তা থাকা জরুরি। এ জন্য আমরা নতুন জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। কামাল উদ্দীন জসীম, এএমডি, ইসলামী ব্যাংকইসলামী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ২২ হাজার। এর মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট সময়ের নিয়োগ প্রায় ১০ হাজার। এঁদের নিয়োগে বেশির ভাগের সময় কোনো ধরনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। এসব কর্মীর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম জেলার ৭ হাজার ২২৪ জন, যার মধ্যে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের নিজ উপজেলা পটিয়ার বাসিন্দা ৪ হাজার ৫২৪ জন।
ব্যাংকটির ঢাকার দুটি শাখার ব্যবস্থাপক প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে যোগ্য কর্মকর্তাও আছেন। তাঁরা ছয়-সাত বছর ধরে কাজ করছেন, অবদান রাখছেন।
হঠাৎ করে সবাইকে বাদ দিয়ে দিলে ভবিষ্যতে ব্যাংককে বড় ধরনের আর্থিক লোকসানের মধ্যে পড়তে হতে পারে। এ জন্য সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।
ছাঁটাইয়ের পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিঅন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন পরিচালনা পর্ষদ একাধিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যাংকটির ঋণ, বিনিয়োগ ও জনবল পরীক্ষা করে। তাতেই উঠে আসে এস আলমের দখলে থাকার সময় নিয়োগপ্রাপ্তদের অযোগ্যতা, সনদ জালিয়াতিসহ নানা বিষয়। এসব নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের বেশির ভাগের সনদ চট্টগ্রামের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। অনেকের সনদে জালিয়াতির তথ্য উঠে আসে। বিজিসি ট্রাস্ট ও পোর্ট সিটি বিশ্ববিদ্যালয় সনদ যাচাই করতে দেয়নি।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পরীক্ষা ছাড়া চাকরি পাওয়াদের মধ্য থেকে ৫ হাজার ৩৮৫ জনের যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় ব্যাংকটি। গত শনিবার অনুষ্ঠিত মূল্যায়ন পরীক্ষায় ৪ হাজার ৯৫৩ জন অংশ নেননি, যাঁদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করেছে ব্যাংক। এ ছাড়া চাকরিবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ২০০ জনকে ছাঁটাই করে। এরপর গত রবি ও সোমবার চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিক্ষোভ করেন একদল কর্মী। পরে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়।
এদিকে ব্যাংকটি গতকাল মঙ্গলবার নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার (ক্যাশ) পদের জন্য স্নাতক উত্তীর্ণ ও ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার পদের জন্য স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণরা আবেদন করতে পারবেন।
ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দীন জসীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নীতিমালা না মেনে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছিলেন, সবার যোগ্যতা যাচাই হবে। ব্যাংকের সেবার মান ধরে রাখতে যোগ্য কর্মকর্তা থাকা জরুরি। এ জন্য আমরা নতুন জনবল নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। যথাযথ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত সময়ে এসব নিয়োগ দেওয়া হবে।’