সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে ই-মানি প্রবিধান খসড়া করেছে, সেটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী। ভোক্তা সুরক্ষা, ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ আর সুশাসনের বিষয়গুলো সেখানে জায়গা পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর যেসব সংস্কারমুখী ভূমিকা নিচ্ছেন, এর প্রতিফলন দেখা যায় এ খসড়ায়। দীর্ঘদিনের জট পাকানো সমস্যাগুলো সমাধানে লাইসেন্স একীভূত করা, তদারকি সহজ করা কিংবা আধুনিক মূল‍্য পরিশোধ অবকাঠামো (পেমেন্ট সিস্টেম) গড়ার মতো পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেনের যাত্রা এক যুগের বেশি পেরিয়েছে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) আর পেমেন্ট সিস্টেম প্রোভাইডার (পিএসপি) এখন লাখো কোটি টাকার লেনদেন সামলায় প্রতিদিন। কোটি মানুষের হাতে পৌঁছেছে ডিজিটাল লেনদেনের সক্ষমতা। তবে এখনো সিংহভাগ লেনদেন ‘ক্যাশ-ইন-ক্যাশ-আউট’ নামে পরিচিত নগদ অর্থ জমা আর উত্তোলনেই সীমাবদ্ধ থাকায় প্রকৃত অর্থে ডিজিটাল লেনদেনে এখনো সম্পৃক্ত হতে পারিনি আমরা।

এ লক্ষ‍্যে ২০–এর অধিক লাইসেন্স দেওয়া হলেও অধিকাংশ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চোখে পড়ে না বললেই চলে। যেকোনো সেবার ক্ষেত্রে একাধিক লাইসেন্স দেওয়ার প্রধানতম কারণ থাকে বাজার প্রতিযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে সেবার মানকে ঊর্ধ্বমুখী ও মূল্যকে নিম্নমুখী রাখা। আশা করা যায়, আসন্ন প্রবিধানমালা প্রয়োজনীয় ডিজিটাল আর্থিক খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। তবে তার জন‍্য কিছু ধারার সংশোধন ও সংযোজন বিবেচনা করা প্রয়োজন।

প্রাথমিক পর্যালোচনায় প্রবিধানের খসড়ায় কিছু অসামঞ্জস্য চোখে পড়ছে। ধারা ৩-এ বিদ্যমান এমএফএস ও পিএসপি প্রতিষ্ঠানকে বৈধ বলা হলেও ধারা ৭-এ তাদের আবার নতুন করে লাইসেন্স নিতে বলা হয়েছে। আবার ধারা ২-এ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা থাকলেও ধারা ৯-এ এত বেশি মূলধনের শর্ত দেওয়া হয়েছে যে ছোট উদ্ভাবক বা নতুন উদ্যোক্তাদের বাজারে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।

আপাতদৃষ্টে খসড়াটির সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো আন্তসংযোগযোগ‍্যতা বা ইন্টারঅপারেবিলিটি নিয়ে বিধান না রাখা। এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক আরেক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের সঙ্গে সহজে লেনদেন করতে না পারলে বাজার গুটিয়ে যায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। ফলে প্রতিযোগিতা থমকে থাকে, বঞ্চিত হয় গ্রাহক। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এটাকে বাংলাদেশের জন্য এক ‘হারানো সুযোগ’ বলে উল্লেখ করেছে।

এই সেপ্টেম্বরেই পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একীভূত তাৎক্ষণিক মূল‍্য পরিশোধের ব্যবস্থা বা ইউনিফায়েড ইনস্ট্যান্ট পেমেন্ট সিস্টেমের (ইউআইপিএস) পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।

আর্থিক খাতে অভিজ্ঞজন থেকে শুরু করে তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরাও এটিকে একটি বড় পদক্ষেপ বলে সম্মত হন এবং সতর্ক করেন যে ইন্টারঅপারেবিলিটিকে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক না করা হলে ইউআইপিএসের প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশনা, গ্লোবাল ফিনডেক্স ২০২৫, অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মূল চালিকা শক্তি ছিল প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত কাঠামো। আফ্রিকার দেশগুলোয় ইন্টারঅপারেবল মোবাইল মানি ব্যবস্থার কারণে জিডিপিতে সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

তাহলে করণীয় কী

প্রথমত, বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে জটিল প্রক্রিয়ায় না ফেলে সরাসরি স্বীকৃতি দেওয়া। তবে সেবার মান নিয়ন্ত্রণ ও বাংলাদেশ ব‍্যাংককে লেনদেন ও আমানতের তথ‍্য প্রদানে অপারগ হলে অবিলম্বে লাইসেন্স বাতিল করে গ্রাহকের আমানত ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মূলধনের শর্ত ধাপে ধাপে নির্ধারণ করা, যেন বড় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তুলনামূলক ছোট উদ্যোগগুলোও টিকে থাকতে পারে।

তৃতীয়ত, ইন্টারঅপারেবিলিটি বাধ্যতামূলক করা। ইউআইপিএস ও জাতীয় পেমেন্ট নেটওয়ার্কে যুক্ত না হলে বা এর কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করলে তার জন‍্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে, তারা গঠনমূলক পরিবর্তন চাইছে। আশা করা যায়, এর ফলে একটি প্রতিযোগিতামূলক, সাশ্রয়ী আর অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ফাইন্যান্স ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

আবু নাজম ম তানভীর হোসেন প্রিন্সিপাল, স্ট্রাটাজেম

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রব ধ ন ব যবস থ গ র হক ল নদ ন ত ম লক আর থ ক

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঢাবি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে

বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল তাঁবেদার ও অনুগত নাগরিক তৈরি করা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথাগত জ্ঞান আহরণের কেন্দ্র না থেকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে সে গৌরব এখন ম্লান হয়ে গেছে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর শাহবাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে, স্মৃতিতে শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন বক্তারা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম ভূমিকা পালনের দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যে পতাকা ওড়ানো হয়েছে, সেটা আর কখনো নামেনি।

বইটির মুখবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক বলেন, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ জ্ঞান আহরণ, সৃষ্টি ও বিতরণ। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান আহরণের প্রথাগত কেন্দ্র হিসেবে না থেকে ইতিহাসের ভাঙা–গড়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে তার রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করেছে। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সেটার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিং নিয়ে ভিন্নমত জানিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা সেটা ভিন্নভাবে করতে হবে। এখন র‍্যাঙ্কিং নিয়ে আওয়াজ ওঠে। গণপরিসরে যখন আলাপ ওঠে তখন বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে গবেষণা ও প্রকাশনা না হওয়াকে দায়ী করা হয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন, পৃথিবীর কটা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে, স্মৃতিতে বইটির প্রথম প্রবন্ধ ‘অন্ধকারে আলো, আলোতে অন্ধকার’ শিরোনামের একটা পুরো জীবনদর্শনের সন্ধান মেলে জানিয়ে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার সবকিছু ব্যক্ত করেন সাংঘাতিক যুক্তির মধ্য দিয়ে। ওনার লেখা যখন শেষ করি, তখন মনে হয়, আমি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রমণ শেষ করেছি।’

উপাচার্যদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে ব্যক্তিগতভাবে দোষারোপ করছি না। কিন্তু উপাচার্যদের বিশ্ববিদ্যালয়কে সৃজনশীলতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে মূল দায়িত্ব, সেটা পালনে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।’

লেখক ও অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘প্রথম প্রবন্ধটা বইটার সুর তৈরি করে দিয়েছে। স্যার সবকিছুকে ক্রিটিক্যালি দেখেন। যেমন সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে স্যারের পর্যবেক্ষণ। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দু–তিন মাস পরে সিপাহি বিদ্রোহ হয়। স্যার তাঁর বইয়ে বলছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চমার্গীয় ব্যাপার। সিপাহিরা হচ্ছেন কৃষকের সন্তান।’

খ্যাতিমান নাট্যকার খায়রুল আলম সবুজ বলেন, ‘স্যারের লেখা যখন পড়ি, সেটা অন্তর ছুঁয়ে যায়।’

বিভিন্ন সময়ের লেখাগুলোকে একত্র করে বইটা লেখা জানিয়ে শিক্ষক ও লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের যে চেহারা ছিল, আগের যে গৌরব ছিল, সেগুলো ম্লান হয়ে গেছে, এটা খুবই সত্য কথা এবং সে জন্য যে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় দায়ী, সেটা নয়। মূল পরিবেশ, গোটা সমাজের যে পরিবেশ, তাকে বিবেচনা করতে হবে। গোটা ব্যবস্থাটাই এমন পুঁজিবাদী একটা ব্যবস্থা, যেখানে মানুষ আত্মস্বার্থ ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।

বেঙ্গলবুকসের জ্যেষ্ঠ কনটেন্ট ডেভেলপার তৌহিদ ইমামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও হিউম্যানিটিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ফেরদৌস আজিম। আরও বক্তব্য দেন লেখক ও গবেষক কাজী সামিও শীশ।

বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গলবুকসের প্রকল্প প্রধান আজহার ফরহাদ। এরপর মঞ্চে অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। বেঙ্গলবুকসের প্রকাশক মাহমুদুল হাসানের বক্তব্যের পর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ