খসড়া ই-মানি প্রবিধান: চাই প্রতিযোগিতাবান্ধব বন্দোবস্ত
Published: 23rd, September 2025 GMT
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে ই-মানি প্রবিধান খসড়া করেছে, সেটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী। ভোক্তা সুরক্ষা, ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ আর সুশাসনের বিষয়গুলো সেখানে জায়গা পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর যেসব সংস্কারমুখী ভূমিকা নিচ্ছেন, এর প্রতিফলন দেখা যায় এ খসড়ায়। দীর্ঘদিনের জট পাকানো সমস্যাগুলো সমাধানে লাইসেন্স একীভূত করা, তদারকি সহজ করা কিংবা আধুনিক মূল্য পরিশোধ অবকাঠামো (পেমেন্ট সিস্টেম) গড়ার মতো পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেনের যাত্রা এক যুগের বেশি পেরিয়েছে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) আর পেমেন্ট সিস্টেম প্রোভাইডার (পিএসপি) এখন লাখো কোটি টাকার লেনদেন সামলায় প্রতিদিন। কোটি মানুষের হাতে পৌঁছেছে ডিজিটাল লেনদেনের সক্ষমতা। তবে এখনো সিংহভাগ লেনদেন ‘ক্যাশ-ইন-ক্যাশ-আউট’ নামে পরিচিত নগদ অর্থ জমা আর উত্তোলনেই সীমাবদ্ধ থাকায় প্রকৃত অর্থে ডিজিটাল লেনদেনে এখনো সম্পৃক্ত হতে পারিনি আমরা।
এ লক্ষ্যে ২০–এর অধিক লাইসেন্স দেওয়া হলেও অধিকাংশ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চোখে পড়ে না বললেই চলে। যেকোনো সেবার ক্ষেত্রে একাধিক লাইসেন্স দেওয়ার প্রধানতম কারণ থাকে বাজার প্রতিযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে সেবার মানকে ঊর্ধ্বমুখী ও মূল্যকে নিম্নমুখী রাখা। আশা করা যায়, আসন্ন প্রবিধানমালা প্রয়োজনীয় ডিজিটাল আর্থিক খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। তবে তার জন্য কিছু ধারার সংশোধন ও সংযোজন বিবেচনা করা প্রয়োজন।
প্রাথমিক পর্যালোচনায় প্রবিধানের খসড়ায় কিছু অসামঞ্জস্য চোখে পড়ছে। ধারা ৩-এ বিদ্যমান এমএফএস ও পিএসপি প্রতিষ্ঠানকে বৈধ বলা হলেও ধারা ৭-এ তাদের আবার নতুন করে লাইসেন্স নিতে বলা হয়েছে। আবার ধারা ২-এ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা থাকলেও ধারা ৯-এ এত বেশি মূলধনের শর্ত দেওয়া হয়েছে যে ছোট উদ্ভাবক বা নতুন উদ্যোক্তাদের বাজারে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
আপাতদৃষ্টে খসড়াটির সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো আন্তসংযোগযোগ্যতা বা ইন্টারঅপারেবিলিটি নিয়ে বিধান না রাখা। এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক আরেক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের সঙ্গে সহজে লেনদেন করতে না পারলে বাজার গুটিয়ে যায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। ফলে প্রতিযোগিতা থমকে থাকে, বঞ্চিত হয় গ্রাহক। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এটাকে বাংলাদেশের জন্য এক ‘হারানো সুযোগ’ বলে উল্লেখ করেছে।
এই সেপ্টেম্বরেই পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একীভূত তাৎক্ষণিক মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা বা ইউনিফায়েড ইনস্ট্যান্ট পেমেন্ট সিস্টেমের (ইউআইপিএস) পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।
আর্থিক খাতে অভিজ্ঞজন থেকে শুরু করে তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরাও এটিকে একটি বড় পদক্ষেপ বলে সম্মত হন এবং সতর্ক করেন যে ইন্টারঅপারেবিলিটিকে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক না করা হলে ইউআইপিএসের প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশনা, গ্লোবাল ফিনডেক্স ২০২৫, অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মূল চালিকা শক্তি ছিল প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত কাঠামো। আফ্রিকার দেশগুলোয় ইন্টারঅপারেবল মোবাইল মানি ব্যবস্থার কারণে জিডিপিতে সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তাহলে করণীয় কীপ্রথমত, বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে জটিল প্রক্রিয়ায় না ফেলে সরাসরি স্বীকৃতি দেওয়া। তবে সেবার মান নিয়ন্ত্রণ ও বাংলাদেশ ব্যাংককে লেনদেন ও আমানতের তথ্য প্রদানে অপারগ হলে অবিলম্বে লাইসেন্স বাতিল করে গ্রাহকের আমানত ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মূলধনের শর্ত ধাপে ধাপে নির্ধারণ করা, যেন বড় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তুলনামূলক ছোট উদ্যোগগুলোও টিকে থাকতে পারে।
তৃতীয়ত, ইন্টারঅপারেবিলিটি বাধ্যতামূলক করা। ইউআইপিএস ও জাতীয় পেমেন্ট নেটওয়ার্কে যুক্ত না হলে বা এর কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করলে তার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে, তারা গঠনমূলক পরিবর্তন চাইছে। আশা করা যায়, এর ফলে একটি প্রতিযোগিতামূলক, সাশ্রয়ী আর অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ফাইন্যান্স ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
আবু নাজম ম তানভীর হোসেন প্রিন্সিপাল, স্ট্রাটাজেম
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রব ধ ন ব যবস থ গ র হক ল নদ ন ত ম লক আর থ ক
এছাড়াও পড়ুন:
খসড়া ই-মানি প্রবিধান: চাই প্রতিযোগিতাবান্ধব বন্দোবস্ত
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে ই-মানি প্রবিধান খসড়া করেছে, সেটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী। ভোক্তা সুরক্ষা, ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ আর সুশাসনের বিষয়গুলো সেখানে জায়গা পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর যেসব সংস্কারমুখী ভূমিকা নিচ্ছেন, এর প্রতিফলন দেখা যায় এ খসড়ায়। দীর্ঘদিনের জট পাকানো সমস্যাগুলো সমাধানে লাইসেন্স একীভূত করা, তদারকি সহজ করা কিংবা আধুনিক মূল্য পরিশোধ অবকাঠামো (পেমেন্ট সিস্টেম) গড়ার মতো পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেনের যাত্রা এক যুগের বেশি পেরিয়েছে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) আর পেমেন্ট সিস্টেম প্রোভাইডার (পিএসপি) এখন লাখো কোটি টাকার লেনদেন সামলায় প্রতিদিন। কোটি মানুষের হাতে পৌঁছেছে ডিজিটাল লেনদেনের সক্ষমতা। তবে এখনো সিংহভাগ লেনদেন ‘ক্যাশ-ইন-ক্যাশ-আউট’ নামে পরিচিত নগদ অর্থ জমা আর উত্তোলনেই সীমাবদ্ধ থাকায় প্রকৃত অর্থে ডিজিটাল লেনদেনে এখনো সম্পৃক্ত হতে পারিনি আমরা।
এ লক্ষ্যে ২০–এর অধিক লাইসেন্স দেওয়া হলেও অধিকাংশ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চোখে পড়ে না বললেই চলে। যেকোনো সেবার ক্ষেত্রে একাধিক লাইসেন্স দেওয়ার প্রধানতম কারণ থাকে বাজার প্রতিযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে সেবার মানকে ঊর্ধ্বমুখী ও মূল্যকে নিম্নমুখী রাখা। আশা করা যায়, আসন্ন প্রবিধানমালা প্রয়োজনীয় ডিজিটাল আর্থিক খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। তবে তার জন্য কিছু ধারার সংশোধন ও সংযোজন বিবেচনা করা প্রয়োজন।
প্রাথমিক পর্যালোচনায় প্রবিধানের খসড়ায় কিছু অসামঞ্জস্য চোখে পড়ছে। ধারা ৩-এ বিদ্যমান এমএফএস ও পিএসপি প্রতিষ্ঠানকে বৈধ বলা হলেও ধারা ৭-এ তাদের আবার নতুন করে লাইসেন্স নিতে বলা হয়েছে। আবার ধারা ২-এ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা থাকলেও ধারা ৯-এ এত বেশি মূলধনের শর্ত দেওয়া হয়েছে যে ছোট উদ্ভাবক বা নতুন উদ্যোক্তাদের বাজারে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
আপাতদৃষ্টে খসড়াটির সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো আন্তসংযোগযোগ্যতা বা ইন্টারঅপারেবিলিটি নিয়ে বিধান না রাখা। এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক আরেক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের সঙ্গে সহজে লেনদেন করতে না পারলে বাজার গুটিয়ে যায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। ফলে প্রতিযোগিতা থমকে থাকে, বঞ্চিত হয় গ্রাহক। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এটাকে বাংলাদেশের জন্য এক ‘হারানো সুযোগ’ বলে উল্লেখ করেছে।
এই সেপ্টেম্বরেই পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একীভূত তাৎক্ষণিক মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা বা ইউনিফায়েড ইনস্ট্যান্ট পেমেন্ট সিস্টেমের (ইউআইপিএস) পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।
আর্থিক খাতে অভিজ্ঞজন থেকে শুরু করে তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরাও এটিকে একটি বড় পদক্ষেপ বলে সম্মত হন এবং সতর্ক করেন যে ইন্টারঅপারেবিলিটিকে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক না করা হলে ইউআইপিএসের প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশনা, গ্লোবাল ফিনডেক্স ২০২৫, অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মূল চালিকা শক্তি ছিল প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত কাঠামো। আফ্রিকার দেশগুলোয় ইন্টারঅপারেবল মোবাইল মানি ব্যবস্থার কারণে জিডিপিতে সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তাহলে করণীয় কীপ্রথমত, বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে জটিল প্রক্রিয়ায় না ফেলে সরাসরি স্বীকৃতি দেওয়া। তবে সেবার মান নিয়ন্ত্রণ ও বাংলাদেশ ব্যাংককে লেনদেন ও আমানতের তথ্য প্রদানে অপারগ হলে অবিলম্বে লাইসেন্স বাতিল করে গ্রাহকের আমানত ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মূলধনের শর্ত ধাপে ধাপে নির্ধারণ করা, যেন বড় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তুলনামূলক ছোট উদ্যোগগুলোও টিকে থাকতে পারে।
তৃতীয়ত, ইন্টারঅপারেবিলিটি বাধ্যতামূলক করা। ইউআইপিএস ও জাতীয় পেমেন্ট নেটওয়ার্কে যুক্ত না হলে বা এর কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করলে তার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে, তারা গঠনমূলক পরিবর্তন চাইছে। আশা করা যায়, এর ফলে একটি প্রতিযোগিতামূলক, সাশ্রয়ী আর অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ফাইন্যান্স ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
আবু নাজম ম তানভীর হোসেন প্রিন্সিপাল, স্ট্রাটাজেম
*মতামত লেখকের নিজস্ব