সংসারের সম্বল বলতে ছিল একটি ভ্যান ও একটি বিদেশি জাতের গরু। আবদুর রাজ্জাক ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। গরুটির দেখভাল করতেন তাঁর স্ত্রী ফেনসী আক্তার। অভাবের সংসারে এভাবে খেয়ে-পরে চলছিল এই দম্পতি। হঠাৎ নেমে এল বিপদ। অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয় রাজ্জাকের। তার চার দিন পর গরুটিও মারা যায়। স্বামীহারা ফেনসী পড়েন অকূলপাথারে।

ফেনসীদের বাড়ি রংপুরের পীরগাছা সদর ইউনিয়নের তালুক ইসাত গ্রামে। সম্প্রতি গ্রামে গিয়ে কথা হয় ফেনসীর শ্বশুর নূরুল হকের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, ২০ জুলাই তাঁর চাচাতো ভাই মুকুল মিয়ার একটি গরু অসুস্থ হয়েছিল। ওই দিন সকালে তাঁর ছেলে রাজ্জাককে ডেকে নিয়ে যান মুকুল। রাজ্জাক গিয়ে দেখেন, গরুটি জবাই করা হয়েছে। সেই গরু কাটাকাটির সময় রাজ্জাকের একটি আঙুল সামান্য কেটে যায়। এরপর ওই দিন রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজ্জাক।

চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত জুলাইয়ে রাজ্জাকের অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের বিষয়টি প্রথম জানাজানি হয়। একই সময়ে উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে অর্ধশত ব্যক্তির শরীরে ঘা, পেটের পীড়াসহ অ্যানথ্রাক্সের বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু তখন তেমন গুরুত্ব দেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। ৬ সেপ্টেম্বর পীরগাছার পারুল ইউনিয়নে কমলা বেগম (৬৫) নামের এক নারী অ্যানথ্রাক্স উপসর্গে মারা যান। পরে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করলে পীরগাছায় আটজনসহ জেলায় মোট ১১ জনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফেনসী আক্তার বলেন, ‘চাচি (মুকুলের স্ত্রী) স্যাভলন দিয়ে দিছে। রক্ত থামে নাই। উনি মাংস কোটাবাছা করে বাড়িতে ফিরে গোসল করে রোদে গিয়ে শুয়ে ছিল। রাতে বলতেছিল, শরীর চামাইতেছে। উনি ডাক্তারের (পল্লিচিকিৎসক) কাছে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসল। কিন্তু ওষুধ খেয়ে কিছু হলো না। পরদিন সকালবেলা আবার ওই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে অন্য ওষুধ নিয়ে আসল। কিন্তুক ওই ওষুধ খায়াও কাজ হলো না।’

আরও পড়ুনপীরগাছায় ৮ জনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত, রংপুরের আরও দুই উপজেলায় উপসর্গের রোগী৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ফেনসী আক্তারের ভাষ্য, ঘটনার এক দিন পর রাজ্জাকের বুকের এক পাশে ফুলে যায়। পরদিন স্বামীকে নিয়ে পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। সেখান থেকে রাজ্জাককে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু হাতে টাকা না থাকায় সেদিন বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। এক দিন পর তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে রংপুরের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। ফেনসীর দাবি, তখন চিকিৎসকেরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁর স্বামী কসাই ছিলেন কি না?

অবশ্য টাকার অভাবে ওই হাসপাতালেও রাজ্জাকের আর চিকিৎসা করাতে পারেননি বলে দাবি করেন ফেনসী আক্তার। তিনি বলেন, ওই হাসপাতালের একজন নার্স তাঁকে বলেন, তাঁর (রাজ্জাক) বাঁচার সম্ভাবনা কম। হাসপাতালে এক দিন রাখলে এক লাখ টাকা দিতে হবে। এ কারণে তাঁকে পাশের ক্লিনিকে নেওয়ার কথা বলেন ওই নার্স। সেখানে নিলে রাতে রাজ্জাকের মৃত্যু হয়।

অ্যানথ্রাক্স একজন ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হতে পারে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রগ ছ

এছাড়াও পড়ুন:

রংপুরে আরও তিনজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত, জনসচেতনতায় জোর নেই

রংপুরের কাউনিয়া ও মিঠাপুকুর উপজেলায় আরও তিনজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। কাউনিয়া ও মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে দুজন কাউনিয়ার এবং একজন মিঠাপুকুরের বাসিন্দা। এ নিয়ে জেলায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ জনে। তবু আক্রান্ত এলাকাগুলোতে অ্যানথ্রাক্স নিয়ে তেমন সচেতনতামূলক কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র বলছে, চলতি বছরের জুলাই ও সেপ্টেম্বরে রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজন মারা যান। একই সময়ে উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে অর্ধশত ব্যক্তির শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা যায়। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে অসুস্থ গরুর মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করেছিল প্রাণিসম্পদ বিভাগ। পরে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একটি প্রতিনিধিদল ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর পীরগাছা সদর এবং পারুল ইউনিয়নের অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ থাকা ১২ জন নারী-পুরুষের নমুনা সংগ্রহ করেছিল। এর মধ্যে আটজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়।

আরও পড়ুনপীরগাছায় ৮ জনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত, রংপুরের আরও দুই উপজেলায় উপসর্গের রোগী৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫আরও পড়ুনরংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজনের মৃত্যু, আক্রান্ত অর্ধশত১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কাউনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুজন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ২৩ সেপ্টেম্বর কাউনিয়ায় অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ আছে এমন ছয়জনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে দুজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। সুজন সাহা বলেন, আক্রান্ত রোগীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। হাসপাতালের কর্মী রোগীর বাসায় গিয়ে চিকিৎসা দেবেন।

মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ১৫–২০ দিন আগে ইমাদপুর ইউনিয়নের আমাইপুর গ্রামে একটি গরু অসুস্থ হলে জবাই করা হয়। পরে ওই মাংস কাটাকাটি করার পর গ্রামের পাঁচ–ছয়জনের শরীরে ঘা হয় ও অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেয়। এরপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাঁরা চিকিৎসা নিতে আসলে সেখানে থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন পুরুষের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে।

মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা (রোগনিয়ন্ত্রণ) এম এ হালিম লাবলু প্রথম আলোকে বলেন, ইমাদপুরে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরা অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবু রোগী যাতে সামাজিকভাবে কোনো হেয় পরিস্থিতির মধ্যে না পড়েন, সে জন্য তাঁদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তিনি জানান, এ রোগ গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে। অসুস্থ গরু জবাই করা বা মাংস খাওয়া যাবে না।

বুধবার দুপুরে আমাইপুর গ্রামে গেলে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ও সোহরাব আলীর সঙ্গে। তাঁদের দাবি, গরুর মালিক গরু অসুস্থের কথা বলেননি। বলেছিল, দড়ি দিয়ে গরুর ফাঁস লেগেছিল। এ কারণে প্রতিবেশীরা মাংস কাটাকাটিতে যুক্ত হন। এই দুই স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রহমতপুর বাজারে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানান, অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো সচেতনতামূলক কার্যক্রম তাঁরা দেখেননি।

মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরেকটি সূত্র বলছে, উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের জীবনপুর গ্রামের একজন নারীর অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ পাওয়া গেছে। তিনি অসুস্থ গরুর সংস্পর্শে আসেননি। তবে তাঁর বাড়িতে গরু-ছাগল আছে। ওই নারী নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, মাটি বা ঘাসের সঙ্গে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু বছরের পর বছর ধরে থেকে যায়। বেশির ভাগ সময় পানি জমা ঘাস গবাদিপশু খাচ্ছে। সেখান থেকে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এ জন্য অ্যানথ্রাক্স প্রতিষেধক টিকা কার্যক্রমে জোর দিতে হবে।

অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত ইমাদপুর এলাকার বাসিন্দারা প্রথম আলোকে জানান, ১০ থেকে ১২ দিন আগে তাঁদের এলাকায় গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। তবে পার্শ্ববর্তী পচার হাটের মমিনুল ইসলাম ও মহেন্দ্র দাস বলেন, তাঁদের এলাকায় টিকা দেওয়া হয়নি। তাঁরা গরু-ছাগল নিয়ে আতঙ্কে আছেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদ প্রথম আলোকে বলেন, গবাদিপশুর অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করার পরেই গত আগস্ট থেকে তাঁরা টিকা কার্যক্রম শুরু করেছেন। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ মানুষের নমুনা পরীক্ষা করতে দেরি করেছে। এ কারণে এখন আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দাবি, পীরগাছা ছাড়াও কাউনিয়া, মিঠাপুকুর, রংপুর সদর, পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী, উলিপুর ও রাজাটহাটেও অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী টিকা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিরাপদ মাংসের জন্য বিভিন্ন জবাইখানায় গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।

অ্যানথ্রাক্স বিষয়ে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ দেরি করেনি দাবি করে ডেপুটি সিভিল সার্জন রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন জানতে পারছি, সঙ্গে সঙ্গে আইইডিসিআরকে জানানো হয়েছিল। প্রতিটি উপজেলাকে সতর্ক করা আছে এবং অ্যানথ্রাক্স চিকিৎসার গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। এটার জন্য যে অ্যান্টিবায়োটিক বা চিকিৎসাব্যবস্থা, সেটাও পর্যাপ্ত আছে। এ মুহূর্তে যেটা বিষয়, জনগণকে সচেতন করা। অসুস্থ প্রাণী জবাই না করা, নিজেরা না খাওয়া, লুকিয়ে বিক্রি না করা। অসুস্থ প্রাণী মারা গেলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গরুর মাংস কাটার সঙ্গে যুক্ত আরও ৭ জনের উপসর্গ শনাক্ত
  • প্রোস্টেট ক্যানসারের যেসব সাধারণ উপসর্গকে অনেকেই অবহেলা করেন
  • রংপুরে আরও তিনজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত, জনসচেতনতায় জোর নেই