খেলাফত মজলিসের সম্ভাব্য ২৫৬ প্রার্থীর নাম ঘোষণা
Published: 4th, October 2025 GMT
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে খেলাফত মজলিস। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে সারা দেশে ২৫৬ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে দলটি। এসব প্রার্থীকে নিয়ে নির্বাচনী প্রস্তুতি বিষয়ে মতবিনিময় করেছে তারা।
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন দলটির আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ।
সভা শেষে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মতবিনিময় সভার বিষয়ে জানাতে একটি প্রেস ব্রিফিং করা হয়। সেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য এখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) নিশ্চিত হয়নি বলে দাবি করেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব বলেন, প্রশাসনিক সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন রয়েছে, তার কোনো সমাধান এখনো হয়নি। দেশের স্থিতিশীলতা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে সংস্কারের যে দাবি ছিল, তার কিছুই হয়নি। জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন নিয়েও একধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। দেশ-জাতির স্বার্থে অবিলম্বে এ অনিশ্চয়তা দূর করা জরুরি।
আহমদ আবদুল কাদের বলেন, দ্রুত জুলাই সনদ ঘোষণা করে এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এই সনদের ভিত্তিতেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে জুলাই সনদ ঘোষণার আগেই নির্বাচনী রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণা করা হয়েছে। এতে জনগণের মধ্যে একদিকে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার নিয়ে যেমন সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে যথাসময়ে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
ব্রিফিংয়ের শুরুতে গাজাগামী ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র নৌবহরে ইসরায়েলি হামলা ও কয়েক শ মানবাধিকারকর্মীকে অপহরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান খেলাফত মজলিসের মহাসচিব। তিনি আটক মানবাধিকারকর্মীদের মুক্তির পাশাপাশি অবিলম্বে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বসম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।
এ সময় জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান এবং এর ভিত্তিতে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণাসহ ছয় দফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে খেলাফত মজলিস। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ৫ থেকে ৯ অক্টোবর গণসংযোগ, ১০ অক্টোবর ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে গণমিছিল এবং ১২ অক্টোবর সারা দেশে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান।
এ ছাড়া ১৫-৩০ অক্টোবর সারা দেশে সংসদীয় আসনভিত্তিক পক্ষকালব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করবে বলে জানিয়েছে দলটি।
প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, অধ্যাপক সিরাজুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ; যুগ্ম মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসাইন, মুহাম্মদ মুনতাসির আলী, এ বি এম সিরাজুল মামুন, মোস্তাফিজুর রহমান ফয়সল, অধ্যাপক আবদুল জলিল, এ এ তাওসিফ।
আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান, অধ্যাপক কাজী মিনহাজুল আলম, মাওলানা শামসুজ্জামান চৌধুরী, মাওলানা এ এস এম খুরশিদ আলম, মাওলানা শেখ মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন, অধ্যাপক এ কে এম মাহবুব আলম, অর্থ সম্পাদক আবু সালেহীন, শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক আমিনুর রহমান ফিরোজ প্রমুখ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আবদ ল
এছাড়াও পড়ুন:
আহমদ রফিক: বর্ণাঢ্য সৃষ্টিভুবনের অধিকারী
‘স্বদেশ এখন মানচিত্রে আঁকা/ সুশ্রী রঙিন পতাকায় লেখা,/ তবু খুঁজে ফিরি সবার স্বদেশ/ জানি না সে চাওয়া কবে হবে শেষ।’—বাঙাল স্বদেশ, আহমদ রফিক
ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ৯৬ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। আগস্টের ১৭ তারিখ থেকে প্রথমে ল্যাবএইডে প্রায় তিন সপ্তাহ, পরে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ১৬ দিন এবং শেষে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ২ অক্টোবর তিনি প্রয়াত হন। বাঙালির গড়পড়তা বয়সের হিসাবে তিনি পরিপূর্ণ বয়সে জগতের মায়া কাটালেন।
ভাষা আন্দোলন সংঘটনে তাঁর যে অবদান, তাতে ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক আহমদ রফিক কিন্তু কেবল একজন সংগঠক নন, স্রষ্টাও। বিপুল এবং বিচিত্র তাঁর সৃষ্টিজগৎ। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট যেকোনো পেশায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। বাল্যকাল থেকে বামপন্থী রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত আহমদ রফিক সে পথে যাননি। তিনি বেছে নিয়েছেন জটিল এক পথ—লেখালেখি।
এখানে বলে রাখা ভালো, আহমদ রফিক ভালো ফল নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক করলেও তিনি চিকিৎসক হতে পারেননি। ভাষা আন্দোলনে যুক্ততার ‘অপরাধে’ তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ইন্টার্নশিপের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। ফলে পেশাদার চিকিৎসক তিনি হতে পারেননি।
তাই তাঁর সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। এক. পূর্ণকালীন রাজনীতি করার মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা। দুই. পূর্ণকালীন লেখালেখি করার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে শাণিত করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে স্বাক্ষর রাখা। কঠিন হলেও তিনি দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছিলেন। সেই তাগিদ থেকেই পঞ্চাশের দশকে রচনা করেন শিল্প সংস্কৃতি জীবন–এর মতো সাহিত্য-সমালোচকমূলক গ্রন্থ। সমকালের আর কোনো লেখকের প্রবন্ধের বই পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে অ্যাকটিভিস্ট আহমদ রফিক ভাষা আন্দোলনের সংগঠক পরিচয়ে নিজেকে আর সীমাবদ্ধ রাখেননি, নিজেকে নিয়োজিত করেছেন আরও বিস্তৃত পথে।
বিপুল এবং বিচিত্র তাঁর সৃষ্টিজগৎ। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট যেকোনো পেশায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। বাল্যকাল থেকে বামপন্থী রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত আহমদ রফিক সে পথে যাননি। তিনি বেছে নিয়েছেন জটিল এক পথ—লেখালেখি।ভাষা আন্দোলনের অনালোকিত ইতিহাস রচনা, তাত্ত্বিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ, শহরকেন্দ্রিকতার বাইরে ভাষা আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততার কথা এবং ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার মতো গবেষণামূলক কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। এখানেও তিনি নিজের জ্ঞানচর্চা ও লেখালেখিকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। আমৃত্যু প্রগতিশীল চিন্তার এই মানুষের জ্ঞানপিপাসা ছিল বিপুল। তাই ভাষা আন্দোলনের একজন সৈনিক নয়, নিজেকে সংগ্রামী মনে করতেন তিনি।
সৈনিকের কাজ লড়াই শেষে ফলাফল যা–ই হোক, তা সমাপ্ত করা। একজন সংগ্রামীর কাজ জীবনভর চলতে থাকে। তাই ভাষাকে ঘিরে তাঁর যে সাহিত্যচর্চা, তাতে রয়ে গেছে সংগ্রামের তেজ, সমাজ বিনির্মাণের নিরন্তর সাধনা। সুতরাং ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর নিজস্ব গবেষণার বাইরে তিনি বিচিত্র এক সৃষ্টিভুবন নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন। এমন অনেক কাজ তিনি করে গেছেন, যে কাজগুলো মূলত বিদ্যায়তনিক অধ্যাপক-গবেষকদের কাজ। এর বাইরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য নিয়ে রচনা করে গেছেন বিশের অধিক গ্রন্থ, যা দুই বাংলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভুবন যেমন বিচিত্র, তেমনি রবীন্দ্র-সাহিত্য নিয়ে তাঁর গবেষণার জগৎও বিচিত্র। যেমন ১৯৭৭ সালে আহমদ রফিক রচিত প্রথম রবীন্দ্রসাহিত্য-বিষয়ক গ্রন্থ আরেক কালান্তরে দিয়েই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে তাদের রবীন্দ্র–সাহিত্যবিষয়ক বই। কুষ্টিয়া, শাহজাদপুরের পাশাপাশি নওগাঁর পতিসরেও ছিল রবীন্দ্র-কুঠিবাড়ি। তাঁর রবীন্দ্রভুবনে পতিসর গ্রন্থ প্রকাশের আগে বাংলাদেশের খুব কম মানুষের কাছেই তা পরিচিত ছিল। এভাবে পদ্মাপারের সেই গাল্পিক জাদুকর, ছোটগল্পের শিল্পরূপ: পদ্মাপর্বের রবীন্দ্রগল্প, রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ, রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম: কৃষি ও কৃষক, রবীন্দ্রসাহিত্যের নায়িকারা দ্রোহে ও সমর্পণে প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণয়ন।
তাই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে বলতে রবীন্দ্রনাথের শরণ নিয়ে বলাই যায়, ‘যে-পথ দেখায়/ সে যে তার অন্তরের পথ,/ সে যে চিরস্বচ্ছ,/ সহজ বিশ্বাসে সে যে/ করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।’রবীন্দ্র-সাহিত্যচর্চার একক নৈপুণ্যের পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবে রবীন্দ্রচর্চারও পথিকৃৎ তিনি। আশির দশকে একঝাঁক তরুণসহ বিভিন্ন বয়সী রবীন্দ্র–অনুরাগীকে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র। যার মধ্য দিয়ে দুই বাংলায় সেমিনার, গবেষণামূলক প্রবন্ধপাঠসহ নানা আয়োজন করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দের কবিতা নিয়ে যেমন তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন, তেমনি বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবিতা থেকে শুরু করে শূন্য দশকের কবিদের কবিতা নিয়েও তাঁর প্রবন্ধ-আলোচনা রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রচনা করেছেন বাংলাদেশের কবিতা: দশকভাঙা বিচার, কবিতার বিচিত্র ভাষ্য, কবিতা আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা প্রভৃতির মতো সমৃদ্ধ বই।
সমাজ-রাজনীতিবিষয়ক লেখালেখিতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সংগত কারণে আশি–উত্তীর্ণ বয়সে রচনা করতে পারেন দেশ বিভাগ: ফিরে দেখা, কিংবা বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশাল কলেবরের বই। তাই কেবল ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে নয়, ভাষামাধ্যমে সৃষ্টিশীল ও স্বকীয় ভুবন গড়ার কারণেও আহমদ রফিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক-পাঠকের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলে বিশ্বাস করি। তাই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে বলতে রবীন্দ্রনাথের শরণ নিয়ে বলাই যায়, ‘যে-পথ দেখায়/ সে যে তার অন্তরের পথ,/ সে যে চিরস্বচ্ছ,/ সহজ বিশ্বাসে সে যে/ করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।’