ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়ন দাবিতে গণসমাবেশ
Published: 5th, October 2025 GMT
যশোরে ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নসহ ছয় দফা দাবিতে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার (৫ অক্টোবর) ভবদহ দিবসে ‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির’ আয়োজনে যশোরের মশিয়াহাটি উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গণসমাবেশ করা হয়।
সংগঠনের আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালীর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী আব্দুল হামিদ, সদস্য সচিব চৈতন্য কুমার পাল, ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি বাংলাদেশের আহ্বায়ক ডা.
আরো পড়ুন:
টানা বৃষ্টিতে সেন্টমার্টিনে জলাবদ্ধতা, ঘরবন্দি কয়েকশ পরিবার
টানা বৃষ্টিতে সড়কজুড়ে জলাবদ্ধতা, ভোগান্তিতে রাজধানীবাসী
এ সময় বক্তারা বলেন, যশোর জেলার মণিরামপুর, অভয়নগর, কেশবপুর, সদর (আংশিক) এবং খুলনা জেলার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা (আংশিক) উপজেলার ভবদহ অঞ্চলে প্রতিবছর জলাবদ্ধতার কারণে বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, শ্মশান, মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ, রাস্তাঘাট, ফসলী জমি ডুবে যায়। মানুষ সৃষ্ট এই জলবদ্ধতা থেকে বাঁচার তাগিদে এলাকার মানুষ লাগাতার সংগ্রাম করে আসছে।
তারা বলেন, সরকার ভবদহ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
গণসমাবেশে ‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির’ পক্ষ থেকে ছয়টি দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো, দ্রুত আমডাঙ্গা খালের জমি অধিগ্রহণ ও সংস্কার কাজ শুরু করা; ৮১ কিলোমিটার নদী খননের কাজ শুরু করা; বিলে বিলে টিআরএম চালু; ২১ ভেন্টের সকল গেট খুলে দেওয়া; ঘের নীতিমালা—২০১৯ বাস্তবায়ন এবং ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর নওয়াপাড়ায় পুলিশের হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিচার করা।
গণসমাবেশে আরো বলা হয়, গৃহীত প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য জনপদের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। তবে অতীতের মতো একটি বিশেষ চক্র টিআরএম বাস্তবায়নে সরকারি সিদ্ধান্ত বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পর্যায়ক্রমে বিলে বিলে টিআরএম এবং উজানে নদী সংযোগ না হলে এ অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে স্থায়ীভাবে পানির তলে চলে যাবে। নিজেদের এবং জনপদের স্থায়ী জলবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য জমির মালিকদের বিলে বিলে টিআরএম কার্যকর করতে সহযোগিতার আহ্বান জানান হয়।
এতে আরো বলা হয়, বিলে টিআরএম হলে বিল ভরাট ও উঁচু হবে। জমি চাষাবাদের উপযোগী হয়ে উঠবে। বিলের জমির মালিক, ঘের মালিক, বর্গাচাষি, শ্রমজীবী, মৎস্যজীবী এবং বিলের উপর নির্ভরশীল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবাই ক্ষতিপূরণের আওতাভুক্ত হবে।
গণসমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলনের নেতা জিল্লুর রহমান ভিটু, কপোতক্ষ নদ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট আমিনুর রহমান হিরু, মুক্তেশ্বরী সংস্কার আন্দোলনের নেতা আলাউদ্দিন, জুলাই অভ্যুত্থানে যশোরের সমন্বয়ক রাশেদ খান, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মনোজিত বালা, মাসুদ শেখ, আব্দুল মান্নান মোল্লা, বাপার আবু সাঈদ প্রমুখ।
ঢাকা/প্রিয়ব্রত/বকুল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণসম ব শ স গঠন র ট আরএম
এছাড়াও পড়ুন:
কাঠের চামচ-খুন্তি-ডালঘুঁটনি বদলে দিল এক জনপদ
যশোর সদরের তেঘরিয়া গ্রামের একরামুল হোসেন। ৩৪ বছর ধরে তাঁতের গামছা বুননের কাজ করছেন। এই কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা তাঁর। তাই ৫২ বছর বয়সে এসে পেশা বদল করেন। এখন তিনি কাঠের খুন্তি, চামচ, লেবু চাপা, ডালঘুঁটনি তৈরি করে নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন। নিজেই গড়ে তুলেছেন কারখানা। এখন সেই কারখানায় নারী-পুরুষ মিলে ১৫ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।
একরামুলের মতো তেঘরিয়া গ্রামের অন্তত ২৬ জন উদ্যোক্তা কাঠের খুন্তি, চামচ, লেবু চাপা, ডালঘুঁটনি, কাঠের চিরুনিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরির ২৬টি কারখানা গড়ে তুলেছেন। এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এসব কুটিরশিল্পে গ্রামের ৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তেঘরিয়া থেকে বছরে অন্তত ৫ কোটি টাকার পণ্য যাচ্ছে সারা দেশে। এভাবে গ্রামের ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প একটি জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে।
আমার কারখানায় নারী-পুরুষ মিলিয়ে ২৬ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করি। যার বড় অংশ যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে। তবে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারি না। সুবোধ রায়, উদ্যোক্তাসম্প্রতি একরামুল হোসেনের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, একরামুলসহ চারজন চারটি যন্ত্রে কাঠের চামচ ও খুন্তি তৈরির কাজ করছেন। কাজ করতে করতেই একরামুল হোসেন বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৫৯ বছর। এর মধ্যে ১৯৮৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছর তাঁতের গামছা ও লুঙ্গি বুননের কাজ করেছি। শেষ দিকে যে টাকা আয় হতো, তাতে সংসার চলত না। বাধ্য হয়ে তাই গ্রামের সুবোধ রায়ের কারখানায় কাজ শিখে নিজেই কাঠের খুন্তি–চামচ তৈরির কারখানা দিলাম। প্রথমে আমার তৈরি খুন্তি–চামচের ছবি তুলে ইন্টারনেটে দেয় আমার এক ভাতিজা। এর পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রয়াদেশ আসতে থাকে। এভাবেই ব্যবসার শুরু।’
একরামুল হোসেন আরও বলেন, ‘শুরুতে সুবোধ রায়ের কারখানায় কাজ শিখে সেখানে উৎপাদনের কমিশনে কাজ করতাম। এরপর এক লাখ টাকা বিনিয়োগে একটি মেশিন কিনি। এখন আমার কারখানায় আটটি যন্ত্র। এসব যন্ত্রে আটজন কাজ করেন। পাশাপাশি গ্রামের নারীরা উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য পলিশের কাজ করেন।’
তেঘরিয়া গ্রামের ২৬টি কারখানার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো কারখানা সুবোধ রায়ের। ২০১২ সালে সুবোধ রায় কারখানাটি গড়ে তোলেন। এর আগে তিনি কাঠের আসবাব তৈরির কাজ করতেন। তাঁর কারখানা থেকে এর মধ্যে ৫০ জন কাজ শিখে হয় নিজেরা কারখানা করেছেন, নয়তো অন্যের কারখানায় কমিশনে কাজ করছেন।
সরেজমিনে সুবোধ রায়ের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানার দুটি অংশ। এক অংশ থেকে কাঠ কেটে সাইজ করে অন্য অংশে পাঠানো হচ্ছে। সেখানেই কাঠের গায়ে নানা ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। খুন্তি, চামচ তৈরির পর সেগুলো বান্ডিল করে গ্রামের নারীরা বাড়িতে নিয়ে পলিশের কাজ করেন।
সুবোধ রায়ের কারখানায় কাজ করেন প্রদীপ ভাস্কর। তিনি বলেন, ‘আমি কাটিং কারখানায় উৎপাদনের ওপর কমিশনে কাজ করি। তাতে মাসে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। নিজের গ্রামে বসে মাসে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করা সত্যিই খুব সৌভাগ্যের বিষয়। এ গ্রামের মানুষ এখন কাঠের কাজের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।’
কারখানার মালিক সুবোধ রায় বলেন, ‘আগে থেকেই আমি কাঠের আসবাব তৈরির কাজ করতাম। পরে চিন্তা করলাম বয়স বাড়ছে, নিজে কোনো কারখানা করলে শেষ বয়সে বাড়িতে বসেই দেখভাল করা যাবে। সেই সঙ্গে গ্রামের নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই চিন্তা থেকে ১৪ বছর আগে এই কারখানা গড়ে তুলেছি। এখন আমার কারখানায় নারী-পুরুষ মিলিয়ে ২৬ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করি। যার বড় অংশ যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে। তবে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারি না। কারণ, সব সময় বিদ্যুৎ থাকে না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া গেলে বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি পণ্য বিক্রি করতে পারতাম।’
তেঘরিয়া গ্রামের সবচেয়ে বড় কারখানা এখন দিলীপ কুমার দাশের। তাঁর কারখানায় কাজ করেন ৩৫ থেকে ৪০ জন। তিনি বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন। একরামুল হোসেন, সুবোধ রায়, দিলীপ দাশের পাশাপাশি রমেশ রায়, অমল রায়, মণি গোপাল, সুজন রায়ের মতো উদ্যোক্তারা এই গ্রামে গড়ে তুলেছেন কুটিরশিল্প। তাতেই বদলে গেছে এই গ্রামের মানুষের ভাগ্য।
ক্রেতারা বলছেন, তেঘরিয়া গ্রামে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান ভালো, দামও তুলনামূলক কম। তাই পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই গ্রামে উৎপাদিত পণ্য কিনতে বেশি আগ্রহী।
এ বিষয়ে রাজধানী ঢাকার বাড্ডা এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ী তুহিন পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যশোরের মতো কাঠের খুন্তি, চামচ তৈরি কারখানার সন্ধান অন্য কোথাও পাইনি। যশোরের সুবোধ রায়ের কারখানা থেকে প্রতি মাসে অন্তত দুই লাখ টাকার পণ্য পাইকারি কিনে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করি। ওই কারখানার পণ্যের গুণগত মান ভালো, দামও তুলনামূলক কম।’
ঢাকার আরেক পাইকারি ক্রেতা মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘যশোর থেকে পণ্য কিনে আমি নরসিংদী, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাই।’
উদ্যোক্তা ও শ্রমিকেরা জানান, ‘মূলত মেহগনি কাঠ দিয়ে এসব পণ্য তৈরি হয়। মান বাড়াতে অনেক সময় নিম ও শিশু কাঠ ব্যবহার করা হয়। তেঘরিয়া গ্রামের এই কুটিরশিল্পের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্যোক্তাদের মূলধন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে এই শিল্প দেশের অর্থনীতিতে আরও অবদান রাখতে পারবে।
একাধিক উদ্যোক্তা জানান, এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রধান সমস্যা মূলধনের অভাব। গ্রামে অনেক এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি নিয়ে কাজ করে। এসব এনজিও থেকে চড়া সুদে উদ্যোক্তাদের ঋণ নিতে হয়। সহজ শর্তে কম সুদে ঋণ পাওয়া গেলে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ সহজ হতো। এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উপমহাব্যবস্থাপক এনাম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একই গ্রামে ২৬টি কুটিরশিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, এটি আমার জানা ছিল না। শিগগিরই আমি ওই গ্রামের কারখানাগুলো পরিদর্শন করে কুটিরশিল্পের সুবিধার আওতায় আনব। এসব উদ্যোক্তাকে সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করব। বিসিকের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত।’