Prothomalo:
2025-11-19@12:04:48 GMT

দুর্নীতি দমনে রাসুল (সা.)

Published: 19th, November 2025 GMT

দুর্নীতি মানবসমাজের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। রাসুল (সা.)-এর জীবনবিধান, শিক্ষা ও নৈতিক আদর্শ মানবতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। এ জীবনবিধান দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলতে সক্ষম।

রাসুল (সা.) ‘মদিনা সনদ’ নামে একটি আদর্শ সনদ প্রণয়ন করেন। ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে এবং দুর্নীতি দমনে তাঁর নীতি ও আদর্শের যে পরিচয় দিয়েছেন, তার বিবরণ নিচে দেওয়া হলো।

দুর্নীতি

দুর্নীতি হলো নৈতিক, সামাজিক ব্যাধি, বিরুদ্ধাচরণ, অসদাচরণ ও নীতিহীন কাজ। নীতিসিদ্ধ নয়, তাই দুর্নীতি। দুর্নীতি প্রতিরোধে উপায়গুলো নিম্নরূপ:

১.

আমানত: আমানতদারিকে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা হকদারকে আমানত ফিরিয়ে দাও এবং ন্যায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে বিচারকার্য পরিচালনা করবে। আল্লাহর উপদেশ কতই না উৎকৃষ্ট! নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সুরা নিসা, আয়াত-৫৮)।

রাসুল (সা.) বলেন, আমানতের খেয়াতন কেয়ামতের আলামত। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ইয়া নবী (সা.), আমানত কীভাবে নষ্ট হবে? তিনি বললেন, ‘অযোগ্যরা যোগ্যদের মসনদ থাকবে, এটাও কেয়ামতের আলামত।’

নবীজির (সা.) প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ‘আমিন’ জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার ওপর নজর রাখতেন। অন্যায়ভাবে কিছু গ্রহণ করলে তা চুরি হিসেবে গণ্য হতো।

২. সততা: সততা ও নিষ্ঠার উজ্জ্বল উদাহরণ নবীজি (সা.)। নবুওয়াতের পূর্বেই তিনি ‘আল-আমিন’ উপাধি লাভ করেন এবং সততা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যম।

৩. আল্লাহভীতি: দুর্নীতি প্রতিরোধের চাবিকাঠি আল্লাহভীতি। ‘আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ উত্তরণের পথ দেখাবেন।’ (সুরা তালাক: ২)

আরও পড়ুনযার কবরে নেমে রাসুল (সা.) লাশ দাফন করেন২৯ মার্চ ২০২৫

৪. ন্যায়বিচার: মাখযূম গোত্রের ফাতেমা বিনত আবুল আসাদ অভিজাত বংশীয় নারী মক্কা বিজয়ের দিন চুরি করে ধরা পড়ে। তার চুরির বিষয়টি প্রমাণিত হয়। রাসুল (সা.) বিলাল (রা.)-কে তার হাত কাটার আদেশ দেন। কুরাইশ নেতারা ভালো করেই জানেন, রাসুল (সা.) বিচারকার্যে কোনোরূপ ছাড় দেন না। তাঁরা উসামা ইবনে যায়দ (রা.)-কে সুপারিশের জন্য মনোনীত করেন।

তিনি সুপারিশ করলেন, রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত হদ্দ (শরয়ি শাস্তি)-এর বিরুদ্ধে সুপারিশ করছ? সবার উদ্দেশে বললেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তীরা এ জন্যই ধ্বংস হয়েছে, অভিজাত ব্যক্তিদের চুরি বা অপরাধ ছিল বৈধ; কিন্তু দুর্বল ব্যক্তি করলে তার জন্য হদ্দ কার্যকর হতো।’

এটা ছিল এক নগ্ন বৈষম্য। মানুষ হিসেবে সবাই সমান।

অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের ওপর আঘাত করাই হলো দুর্নীতি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিকারী নারী কিংবা পুরুষ, মুসলিম কিংবা অমুসলিম, অভিজাত কিংবা সাধারণ, কোনো ভেদাভেদ নেই। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি সাব্যস্ত হলে বৈষম্যের বিপরীতে ন্যায়বিচার হবেই। বৈষম্য একটি জাতি ধ্বংসের মূল কারণ। রাসুল (সা.) বলেন, বিচারকার্যে বৈষম্যের কারণে অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে। এখানে বৈষম্যের ঠাঁই নেই। ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফের ধর্ম।

রাসুল (সা.) বিচারকার্যে ইনসাফ রক্ষায় কঠোর গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা ফাতিমা মাখযূমির শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করছ! মনে রেখো! ফাতিমা মাখযূমি কেন, আমার মেয়ে ফাতিমার ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধান। কোনোরূপ আপনপ্রীতির সুযোগ নেই।’

রায় কার্যকরের পর ফাতিমা মাখযূমি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া নবী (সা.), আমার তাওবা কবুল হয়েছে? তিনি বললেন, অবশ্যই। মাঝেমধ্যে তিনি ‘আয়েশা (রা)-এর নিকট গমনাগমন করতেন এবং রাসুল (সা.)ও তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।

আরও পড়ুনএক অবিশ্বাসীর মৃত্যুতে রাসুল (সা.)-এর সহৃদয়তা২৯ জানুয়ারি ২০২৫দুর্নীতি অপসারণ

মক্কা বিজয়ের পর রাসুল (সা.) মক্কার বাজারে তদারকির জন্য সাঈদ ইবনে আস (রা.)-কে নিযুক্ত করেছেন। রাসুল (সা.) স্বয়ং বাজারে গমন করে খাদ্যের ধোঁকাবাজি ও ভেজাল নির্ণয়ে খবরদারি করতেন।

রাসুল (সা.) খাদ্যশস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন এবং স্তূপের মালিককে ডেকে বললেন, শস্য ভেজা কেন? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল, বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। তিনি বলেন, ‘ভেজাগুলো ওপরে রাখলে না কেন? ক্রেতারা দেখতে পারত। মনে রেখো, যে ধোঁকা দেবে সে আমার উম্মত নয় (আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই)।’

শাসকের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো অধীনস্থের নিরপেক্ষভাবে অধিকার আদায় করা এবং জনগণের জানমালের হেফাজত করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।

একজন শাসকও দায়িত্বশীল, পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, স্ত্রী তার স্বামীর ঘরসংসার ও সন্তানের দায়িত্বশীল, গোলাম তার মনিবের মালসম্পদের ওপর একজন দায়িত্বশীল। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই (কেয়ামত দিবসে) তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’

দুর্নীতিবাজ শাসক

রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ শাসক জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ দুর্নীতি দমন ও আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাসুল (সা.)-এর প্রয়াস বিশ্বমানবতার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।

সন্ত্রাস ও দুর্নীতি প্রতিরোধে নবীজির শিক্ষা পুনর্জাগরণ অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতা, সহনশীলতা ও মানবিকতার চর্চা বাড়াতে হবে। প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক নৈতিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে সন্ত্রাসবিরোধী ও দুর্নীতিবিরোধী গড়ে তুলবে।

সারকথা

ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র শাশ্বত চিরন্তন ও পরিপূর্ণ জীবনবিধান। যা সত্য, সুন্দর ও মার্জিত, তা–ই ইসলামে অনুমোদিত। অন্যায়, অসত্য, অসুন্দর বা কদর্যতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা ইসলামে অননুমোদিত।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে অস্ত্র বা কঠোর আইনের পরিবর্তে আদর্শ ও নৈতিকতার পুনর্জাগরণ প্রয়োজন। রাসুল (সা.)-এর জীবনধারা দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে সক্ষম। তাঁর আদর্শ গ্রহণে দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়, শান্তি ও মানবতার দীপ্ত ভবিষ্যৎ।

আরও পড়ুনউত্তম ব্যবসায়ী হওয়ার নববি কৌশল০৯ জুন ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব চ রক র য র জন য আল ল হ বলল ন আদর শ ইসল ম করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

‘এই টয়লেটে আমিই যাইতে পারি না, বাচ্চা কীভাবে যাবে!’

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভিড় তখন বাড়তে শুরু করেছে। হাতে ফাইল, বগলে বাচ্চা, মাথায় দুশ্চিন্তা—বিচারপ্রার্থীদের অপেক্ষার যেন শেষ নেই। দুই বছর ধরে বিচারের আশায় এ পথেই ঘুরছেন ৩০ বছর বয়সী ফাতেমা বেগম। যেদিন মামলার শুনানি থাকে, সেদিন সকাল নয়টার আগেই তাঁকে আদালতে পৌঁছাতে হয়। সারা দিন অপেক্ষা আর ভিড় ছাড়াও টয়লেট নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাঁকে।

গতকাল মঙ্গলবার আদালত প্রাঙ্গণে ফাতেমার সঙ্গে কথা হয়। এর আগের শুনানির দিনের অভিজ্ঞতা কথা জানিয়েছেন তিনি। ফাতেমা বলেন, ‘এখানকার টয়লেটের অবস্থা একেবারে নাজেহাল। অপরিষ্কার, দুর্গন্ধ, সিগারেটের টুকরা—যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমার চার বছর বয়সী মেয়ের সেদিন খুব টয়লেটের প্রয়োজন হয়। যেখানে আমিই যাইতে পারি না, বাচ্চা মেয়ে কীভাবে যাবে!’

পরে আইনজীবী সমিতির টয়লেট ব্যবহার করার অনুমতি নিয়ে তবেই মেয়েকে নিয়ে যেতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন ফাতেমা।

ফাতেমার মতো অভিজ্ঞতা আদালত প্রাঙ্গণে আসা প্রায় সব নারী বিচারপ্রার্থীরই আছে। বাসার বাইরে অন্য কোনো স্থানে দীর্ঘ সময় কাটাতে হলে বা দূর যাত্রায় টয়লেট নিয়ে এমন ভোগান্তির গল্প কম-বেশি সব নারীর আছে। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে শিশুদেরও ভুগতে হয়।

এখানকার টয়লেটের অবস্থা একেবারে নাজেহাল। অপরিষ্কার, দুর্গন্ধ, সিগারেটের টুকরা—যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমার চার বছর বয়সী মেয়ের সেদিন খুব টয়লেটের প্রয়োজন হয়। যেখানে আমিই যাইতে পারি না, বাচ্চা মেয়ে কীভাবে যাবে!—ফাতেমা বেগম

এমন প্রেক্ষাপটে আজ ১৯ নভেম্বর দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শৌচাগার দিবস। বিশ্বব্যাপী স্যানিটেশন সংকট এবং মানসম্পন্ন টয়লেটের ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা; পয়োনিষ্কাশনের সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর দিবসটি পালন করা হয়। এই দিনে নিরাপদ স্যানিটেশনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়, যা জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

নারী ও শিশুর জন্য টয়লেট ২৪ শতাংশ আদালতে

বাংলাদেশে নারী ও শিশুর ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে আদালত প্রাঙ্গণের পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অধিকাংশ আদালতে এখনো নারীবান্ধব মৌলিক সুবিধা—যেমন আলাদা টয়লেট, ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার (সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পানের স্থান) বা অপেক্ষার স্থান অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর।

আদালত প্রাঙ্গণে বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘ সময় থাকতে হয়। সেখানে টয়লেট নিয়ে মানুষের যে বিড়ম্বনা, বিশেষ করে নারীদের যে কষ্ট, তা অবর্ণনীয়। আমার পরিচিত পরিসরে অনেককে (নারী) দেখেছি, যাঁরা আদালতে ভালো টয়লেট নেই বলে তাঁদের পেশা থেকে সরে এসেছেন। —হাসিন জাহান, ওয়াটারএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর

‘নারী ও শিশুবান্ধব আদালত পরিবেশ: মৌলিক অবকাঠামোর অভাব এখন ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকারের অন্তরায়’ শিরোনামে ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলার মাত্র ২৪ শতাংশ আদালতে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যেও অনেক টয়লেট তালাবদ্ধ, অচল বা ব্যবহারের অনুপযোগী।

২০২৩ সালের অক্টোবরে ৬৪ জেলার ১৯২টি আদালত পর্যবেক্ষণ করে সংস্থাটি। এর মধ্যে আছে জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।

সুপ্রিম কোর্টে টয়লেটের অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেকটাই উন্নত। আমরা বর্তমানে টয়লেটের পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। চার-পাঁচ মাস আগে সুপ্রিম কোর্টে দুটি স্বাস্থ্যকর ওয়াশরুম এলাকা (জোন) করা হয়েছে। মূল ভবনে আরও তিনটি টয়লেট জোনের কাজ চলছে। আগামী এক মাসের মধ্যেই এই টয়লেটগুলো চালু হবে। যেখানে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেট থাকছে।—মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার

ব্র্যাকের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ১৪০ জন নারী ও শিশু এসব আদালতে আসেন। কিন্তু বেশির ভাগ আদালতে তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক অবকাঠামো অনুপস্থিত। আবার কিছু কিছু আদালতে টয়লেট থাকলেও তা ব্যবহার উপযোগী নয়।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাব

ছেলের মামলার কাজে ফরিদপুর থেকে প্রায়ই সুপ্রিম কোর্টে আসতে হয় ৫০ বছর বয়সী বিলকিস বেগমকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের টয়লেটগুলো নোংরা। কাছাকাছি কোথায় ভালো টয়লেট আছে, তা জানি না। তাই বাধ্য হইয়া এখানেই যাইতে হয়।’

আজ ১৯ নভেম্বর দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শৌচাগার দিবস। বিশ্বব্যাপী স্যানিটেশন সংকট এবং মানসম্পন্ন টয়লেটের ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা; পয়োনিষ্কাশনের সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর এই দিবস পালন করা হয়। এই দিনে নিরাপদ স্যানিটেশনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়, যা জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাসুমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি তলায় নারী-পুরুষের আলাদা ওয়াশরুম আছে, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ নেই। বেশির ভাগ সময় নারীদের ওয়াশরুম পুরুষেরাও ব্যবহার করেন। টয়লেটের সামনে নারী-পুরুষের নির্দেশিকা তুলে ফেলা হয়েছে। ওয়াশরুমগুলো অপরিচ্ছন্ন থাকে। এ কারণে অনেক নারীর প্রস্রাবে সংক্রমণের মতো রোগ হয়।

এসব ওয়াশরুম পরিষ্কার করার জন্য বরাদ্দ সরঞ্জামের অর্ধেকই চুরি হয়ে যায় বলেও মন্তব্য করেছেন এই আইনজীবী।

ঢাকার আদালতে অনেক টয়লেট আদালতকর্মীদের জন্য সংরক্ষিত এবং তালাবদ্ধ। বাকিগুলোর বেশির ভাগই অস্বাস্থ্যকর। কোথাও কোথাও টয়লেট ব্যবহার করতে হলে টাকা দিতে হয়। এ কারণে নারী বিচারপ্রার্থীরা আদালতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার সময় মৌলিক এই প্রয়োজন মেটাতে না পেরে অস্বস্তিতে পড়েন।

মামলার কাজে গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এসেছিলেন কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী কোহিনূর বেগম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এইখানে টয়লেট মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু টাকা দিতে হয়। এইখানে আরও টয়লেট আছে, যাইতে টাকা লাগে না, ওগুলা আবার নোংরা।’

ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব এবং প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী থাকছে।

‘নারী ও শিশুবান্ধব আদালত পরিবেশ: মৌলিক অবকাঠামোর অভাব এখন ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকারের অন্তরায়’ শিরোনামে ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলার মাত্র ২৪ শতাংশ আদালতে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যেও অনেক টয়লেট তালাবদ্ধ, অচল বা ব্যবহারের অনুপযোগী।

ওয়াটারএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, ‘আদালতে প্রাঙ্গণে বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘ সময় থাকতে হয়। সেখানে টয়লেট নিয়ে মানুষের যে বিড়ম্বনা, বিশেষ করে নারীদের যে কষ্ট, তা অবর্ণনীয়। আমার পরিচিত পরিসরে অনেককে (নারী) দেখেছি, যাঁরা আদালতে ভালো টয়লেট নেই বলে তাঁদের পেশা থেকে সরে এসেছেন।’

হাসিন জাহান বলেন, পাবলিক টয়লেটগুলোর প্রধান সমস্যা রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। এটার জন্য মডেল আছে। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত টয়লেটের পুরো ব্যবস্থাপনা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়া এবং তাদের কাজের মূল্যায়নের (পাবলিক ফিডব্যাক) ভিত্তিতে চুক্তি নবায়ন করা।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহারে মানুষের মূত্রনালির সংক্রমণ হয়। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় একই ঘটনা ঘটতে থাকলে সেটা থেকে কিডনির সমস্যা হতে পারে বলে জানিয়েছেন হাসিন জাহান।

তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে

সুপ্রিম কোর্টের মেইন বিল্ডিংয়ে চলতি বছর পুরুষ এবং অ্যানেক্স ভবনে একটি পুরুষ, একটি নারী ও একটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ওয়াশ ব্লক পুনর্নির্মাণ করেছে ব্র্যাক।

ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব এবং প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী থাকছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের চিত্রও অনেকটা একই। এখানে ৮০ ভাগ জায়গায় নারীদের জন্য পৃথক টয়লেট বা মাতৃদুগ্ধ পান করানোর স্থান নেই। ৬৭ শতাংশ আদালতে সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর স্থান আছে। তবে এর মধ্যে কার্যকর ৪৭ শতাংশ।

সংস্থার কমিউনিকেশন বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, সেখানে ওয়াশরুম দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আছেন। যে কেউ ১০ টাকার বিনিময়ে এই টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া দেয়ালে টানানো নির্দেশনা অনুযায়ী কিউআর কোড স্ক্যান করে যে কেউ ১০ টাকা বিকাশসহ কয়েকটি মাধ্যমে পে করে টয়লেট ব্যবহার করতে পারবেন। এসব টয়লেটে গন্ধ পর্যবেক্ষণ করার জন্য অটো মনিটরিং ডিভাইস ও অটো ফ্লাশ বসানো আছে।

এ ছাড়া ব্র্যাকের উদ্যোগে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত ও নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দুটি করে মোট চারটি টয়লেট স্থাপনের কাজ নির্মাণাধীন।

সুপ্রিম কোর্টে টয়লেটের মান উন্নয়নে জোর দেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে টয়লেটের অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেকটাই উন্নত। আমরা বর্তমানে টয়লেটের পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। চার-পাঁচ মাস আগে সুপ্রিম কোর্টে দুটি স্বাস্থ্যকর ওয়াশরুম এলাকা (জোন) করা হয়েছে। মূল ভবনে আরও তিনটি টয়লেট জোনের কাজ চলছে। আগামী এক মাসের মধ্যেই এই টয়লেটগুলো চালু হবে। যেখানে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেট থাকছে।’

মোয়াজ্জেম হোছাইন আরও বলেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য টয়লেটের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এখন প্রতি ছয় ঘণ্টা পরপর টয়লেট পরিষ্কার করছেন এবং টয়লেট যেন ভেজা না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখছেন। কিছুদিনের মধ্যে আরও ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ