সংকটে পড়া পাঁচ বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে নিয়ে এখন নতুন একটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক করা হবে।

নতুন ব্যাংকের জন্য নাম প্রস্তাব করা হয়েছে দুটি—‘ইউনাইটেড ইসলামিক ব্যাংক’ ও ‘সম্মিলিত ইসলামিক ব্যাংক’। ব্যাংকটি পরিচালিত হবে বাণিজ্যিকভাবে ও পেশাদারির ভিত্তিতে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

বৈঠক শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে এ অনুমোদনের কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানান, ব্যাংকগুলো একীভূত করার

ফলে কেউ চাকরি হারাবেন না এবং কোনো আমানতকারী আমানত হারাবেন না।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রাথমিকভাবে নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ ব্যাংকের সব দায় ও সম্পত্তি গ্রহণ করে নতুন ব্যাংকটি তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা সরকার দেবে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে নগদে, আর বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুক বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে।

সুকুক হলো শরিয়াহভিত্তিক একটি ইসলামি বন্ড, যা সুদযুক্ত বন্ডের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ আইনি দলিল বা চুক্তিপত্র।

এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের শেয়ার দিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা মূলধনে রূপান্তর করা হবে বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। পরে আবার রেজল্যুশন পরিকল্পনা অনুযায়ী তা পরিশোধ করা হবে আমানতকারীদের। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমানতকারী ও অন্যান্য পাওনাদারের ঋণের একাংশ বাতিল হয়ে শেয়ারে রূপান্তরিত হয়, সেটাই হচ্ছে বেইল-ইন।

নতুন ব্যাংকটি প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন হবে। পরে পর্যায়ক্রমে মালিকানা বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হবে। প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আশা করছি, পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যাংকটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।’

ব্যাংকটি সরকারি খাতে চলে যাওয়ায় গ্রাহকদের আতঙ্ক কমে আসবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি আতঙ্কিত ক্ষুদ্র গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে মাসখানেক সময় লাগতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। ১৩-১৮ অক্টোবর এ সম্মেলন। গভর্নরের ফেরার কথা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।

যেভাবে বাস্তবায়িত হবে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ব্যাংকের নাম প্রস্তাব করে অর্থ বিভাগ এখন যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) পাঠাবে। নাম অনুমোদিত হলে গঠন করা হবে কোম্পানি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকেও অনুমতি নিতে হবে। এরপর নতুন ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করবে সরকার, যাতে পরিচালনা পর্ষদ ও চেয়ারম্যানের নাম থাকতে হবে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ইতিমধ্যে নতুন ব্যাংক গঠনের অনুমতি দিয়ে রেখেছে। আবেদন পাওয়ার পরপরই প্রজ্ঞাপন জারি করে নতুন ব্যাংক গঠন করে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রস্তাবিত ব্যাংকের জন্য একটি অফিস রাজধানীর সেনা কল্যাণ ভবনে ঠিক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ব্যাংকটি সরকারের প্রতিশ্রুত ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন পেলে পাঁচ ব্যাংকে প্রশাসক বসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ পর্যায়ে পাঁচ ব্যাংককে অধিগ্রহণ করে নেবে নতুন ব্যাংক। বদলে যাবে পাঁচ ব্যাংকের সাইনবোর্ডও।

কেন একীভূত

উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপিত সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিতকরণসহ সামগ্রিক আর্থিক শৃঙ্খলা আনার উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংক খাত সেক্টর সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কর্মসূচির আওতায় প্রাথমিক পর্যায়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নিরূপণ করতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। শ্রীলঙ্কাভিত্তিক এ দুই প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কেপিএমজি এবং ইআই।

উপদেষ্টা পরিষদকে জানানো হয়, এক বছরের বেশি সময় ধরে পাঁচ ব্যাংককে তারল্যসহায়তা দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটেনি; বরং তাদের তারল্যসংকট আরও ঘনীভূত হয়। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি, খেলাপি বিনিয়োগ/ঋণ ও অগ্রিমের হার, প্রভিশন ঘাটতি এবং তারল্যসংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তারা আমানতকারী ও অন্যান্য পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করতে পারছিল না।

যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে

উপদেষ্টা পরিষদকে জানানো হয়, শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রমালিকানাধীন নতুন ব্যাংক গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে সিমুলেশন অনুশীলন (এক্সারসাইজ) করেছে। কোনো জরুরি অবস্থা বা ঘটনার সময় কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে, তা পরীক্ষা করা হয় যে পদ্ধতির মাধ্যমে, সেটাই হচ্ছে সিমুলেশন অনুশীলন। এর ভিত্তিতে ব্যাংকটির জন্য আগামী ১০ বছর মেয়াদি একটি আর্থিক ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে।

এ ছাড়া নতুন ব্যাংকের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ জন্য গত ৮ সেপ্টেম্বর একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে। ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সভায় অনুমোদন করা হয়েছে ‘রেজল্যুশন পরিকল্পনা ২০২৫’। ২৪ সেপ্টেম্বর ব্যাংক খাত সংকট ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের (বিসিএমসি) সভায় ৫ ব্যাংকের লোকসানের দায়ভার বহন করার সিদ্ধান্ত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫ ব্যাংকের শেয়ারের অভিহিত মূল্য, বাজারমূল্য ও প্রকৃত সম্পদমূল্য (এনএভি) পর্যালোচনা করে দেখেছে, প্রতিটি ব্যাংকের এনএভি ঋণাত্মক এবং প্রতিটিতে বিপুল পরিমাণ মূলধন ঘাটতি, মন্দ সম্পদ ও তারল্যসংকট রয়েছে।

একীভূত হওয়ার তালিকায় থাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাফিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক খাত তথা আর্থিক খাতের স্বার্থে পাঁচ ব্যাংকের একীভূত হওয়ার পদক্ষেপ একটি উত্তম সিদ্ধান্ত। এতে পাঁচ ব্যাংকের ৯০ লাখ আমানতকারীর স্বার্থ সুরক্ষা পাবে। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর উচিত হবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহায়তা করা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স প ট ম বর প রস ত ব নত ন ব য উপদ ষ ট পর য য় পর শ ধ পর চ ল এক ভ ত অন ম দ র জন য আর থ ক ইসল ম ম লধন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বিপিএল নিয়ে বিতর্ক কি এড়াতে পারবে আমিনুলের বোর্ড

বিসিবির নির্বাচন শেষ। আমিনুল ইসলামের নতুন পরিচালনা পর্ষদের সামনে শুরুতেই বড় চ্যালেঞ্জ বিপিএল। ডিসেম্বর–জানুয়ারিতে টুর্নামেন্ট আয়োজন নিয়ে তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গেছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান আইএমজির সঙ্গে দ্রুতই চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে জানিয়েছে বিপিএলের নতুন গভর্নিং কাউন্সিল। এরপর শুরু হবে ফ্র্যাঞ্চাইজি বাছাই, প্লেয়ারস ড্রাফটসহ অন্যান্য কার্যক্রম।

ডিসেম্বরে বিপিএল শুরু করা মানে হাতে মাত্র দুই মাসের মতো সময়। একই রকম সময় নিয়ে বিপিএলের গত আসরও আয়োজন করতে হয়েছিল বিসিবিকে। কিন্তু তাড়াহুড়া করে সবকিছু করতে গিয়ে বিপিএল নিয়ে বেশ ঝামেলাই পোহাতে হয়েছিল ফারুক আহমেদের বোর্ডকে। পরে তো খেলোয়াড়দের পাওনা বকেয়া আর স্পট ফিক্সিং বিতর্কে টালমাটাল হয়ে ওঠে টুর্নামেন্টটাই। অভিযোগ ওঠে ফ্র্যাঞ্চাইজি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম না মানারও।

ফারুক আহমেদের মতো এবারও বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের প্রধান হয়েছেন আমিনুল, সদস্যসচিব হিসেবে আছেন বিসিবি পরিচালক ইফতেখার রহমান। তাঁদেরও অল্প সময়ের মধ্যেই টুর্নামেন্ট আয়োজনের পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। বিপিএল নিয়ে এবারও তাই জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা থাকছে।

সর্বশেষ বিপিএলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ফরচুন বরিশাল

সম্পর্কিত নিবন্ধ