বিশ্বজিত হাসদা (৫৫) পেশায় কৃষিশ্রমিক। পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদও করেন। বছর দুয়েক আগে সমিতি থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সোয়া বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছিলেন। জমি চাষ-সার-বীজসহ শুরুতেই প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয় তাঁর।

এরপর প্রতি সপ্তাহে কিস্তি শুরু হয় ১ হাজার টাকা। প্রথম কয়েক সপ্তাহ ঠিকঠাক কিস্তি দিতে পারলেও পরে বিপাকে পড়েন তিনি। কিস্তি পরিশোধ করতে শেষ সম্বল দুটি ছাগল বিক্রি করতে হয়। সেবার ধানেও লাভ করতে পারেননি বিশ্বজিত। এরই মধ্যে ভুট্টা লাগানোর মৌসুম শুরু হলেও হাতে টাকা ছিল না তাঁর। এ সময় বিশ্বজিত খোঁজ পান আইফার্মারের অ্যাকসেস টু ফাইন্যান্স কর্মসূচির। চাষাবাদের জন্য শর্ত সাপেক্ষে অগ্রিম টাকা দেয় আইফার্মার।

ওই বছর আইফার্মার থেকে মাত্র ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ২২ কাঠা জমিতে ভুট্টার চাষ করেন বিশ্বজিত। পাঁচ মাস পর ৫৭ হাজার টাকার ভুট্টা বিক্রি করেন।আইফার্মারকে ঋণের টাকা পরিশোধ করে লাভের মুখ দেখেন।

বিশ্বজিত বলেন, ‘যেকোনো ফসলের চাষ করতে গেলে শুরুতে একটা মোটা টাকার ধাক্কা আসে। আমরা গরিব চাষি। টাকার জন্য হয় সমিতি থেকে ঋণ নিতে হয়, নয়তো সুদের (দাদন) ওপর টাকা নিতে হয়। এরপর গুনতে হয় চড়া সুদ। কিন্তু আইফার্মার এই ঝামেলা নেই। অগ্রিম টাকা নিয়ে আবাদ করা যাচ্ছে। ফসল বিক্রি করে একবারে টাকা পরিশোধ করতে পারছি। সুদের হারও কম।’

বিশ্বজিতের বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার রনগাঁও গ্রামে। ১৯ নভেম্বর ভাদুরিয়া বাজারে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। প্রদীপ চন্দ্র রায়ের সার-বীজ ও কীটনাশকের দোকানে বসে ছিলেন। সে সময় নজরুল ইসলাম, পুতুল চন্দ্র, বিনয় চন্দ্র, জয়দেব মণ্ডলসহ আরও কয়েকজন কৃষক ছিলেন প্রদীপের দোকানে। অধিকাংশ দিন সকাল-সন্ধ্যা এই দোকানে আসা পড়ে তাঁদের। কারণ, প্রদীপ আইফার্মারের ডিলার (এগ্রি ইনপুট রিটেইলার)। তাঁর মাধ্যমেই আইফার্মারের সেবা পৌঁছে গেছে প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে। অ্যাপসের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের প্রতিদিনের বাজার মূল্যসহ নানান তথ্য কৃষকদের জানান প্রদীপ। ঋণ নিতে চাইলেও তাঁর মাধ্যমে আবেদন করেন আইফার্মারের কাছে। কেউ চাষের জন্য অগ্রিম ঋণ নিয়েছেন, কেউ কিনেছেন কৃষি যন্ত্রপাতি।

প্রদীপ জানান, আইফার্মারের উদ্যোগে এলাকার ক্ষুদ্র কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। প্রথম দিকে অনেক বোঝাতে হয়েছে। কিন্তু এখন প্রায় প্রতিদিনই কৃষকেরা ঋণের জন্য আবেদন করতে আসছেন। তিন বছরে ১২০ জনের মতো কৃষক আইফার্মারের সেবা নিয়েছেন। মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত চাষাবাদের জন্য আগাম ঋণ পাচ্ছেন, পণ্য বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করছেন। তা ছাড়া পণ্য বিক্রির হেঁসেলও থাকছে না। কৃষক চাইলে অ্যাপসে বাজার যাচাই করে কোম্পানির কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন।

২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আইফার্মার লিমিটেড। প্রান্তিক কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান, কৃষি পরামর্শ ও বিমা, কৃষি ইনপুট ও যন্ত্রপাতি, ফরোয়ার্ড মার্কেট লিংকেজ ও রপ্তানি এবং সহনশীল ও টেকসই কৃষি ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জলবায়ু-স্মার্ট সমাধান বিষয়ে কাজ শুরু করে আইফার্মার। আইফার্মার ‘কৃসপ’ অ্যাপটি দেশের অন্যতম বড় কৃষি ইনপুট প্ল্যাটফর্ম, যা কৃষক ও কৃষি ইনপুট বিক্রেতাদের মানসম্মত ইনপুট, যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছে। লালমনিরহাট, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, খুলনা, বাগেরহাট, ভোলাসহ বর্তমানে দেশের ৪২টি জেলায় আইফার্মারের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে নিবন্ধিত কৃষকসংখ্যা ২ লাখ ৮৮ হাজার। এর মধ্যে দিনাজপুরের কৃষক আছেন পাঁচ সহস্রাধিক। আর নিবন্ধিত কৃষি-ইনপুট খুচরা বিক্রেতা রয়েছেন ২২ হাজারের অধিক। এর মধ্যে দিনাজপুরের খুচরা বিক্রেতা রয়েছেন ৪৬৮ জন। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার হাবলুরহাট এলাকায় কার্যক্রম চলছে আইফার্মারের।

আইফার্মার থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করছেন মাড়িয়ালা গ্রামের বিনয় চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ‘বছর দু-এক হইল এংনা স্বস্তিত আছি। সুদের উপুরত টাকা নিলে প্রতি হাজারে মাসোত ৩০০ টাকা সুদ দিবা হয়। আর সমিতিত থাকি লোন নিলে ২০ পার্সেন্ট সুদ। ফসল বিক্রি করি লাভ খুঁজি পাওয়া যায় না। টাকা জোগাড় করতে করতে সময় শেষ। এখন মোবাইলত আবেদন (ফলন অ্যাপের মাধ্যমে) করছি, ব্যাংক থাকি টাকা উঠাছি, খরচ করছি। হাতোত টাকা আছে সময়মতো জমিত সার-কীটনাশক দেছি। এলা ফলনডাও ভালো হছে।’ জানালেন, গত বছর আইফার্মার থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ধান বিক্রি করে শোধ করেছেন। এবার ভুট্টা লাগানোর জন্য ৮০ হাজার টাকা ঋণের জন্য ডিলারের মাধ্যমে আবেদন করেছেন।

কৃষিকাজের পাশাপাশি কৃষিপণ্যের ব্যবসা করেন কাহারোল উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘আইফার্মারের একটা বড় সুবিধা হচ্ছে ডিলার পয়েন্টে সব সুবিধা পাওয়া যায়। সার-বীজ-কীটনাশক যেখান থেকে কিনছি, সেখান থেকে ঋণের আবেদন করতে পারছি, কৃষি পরামর্শসহ আবহাওয়ার খবর জানতে পারছি। আবার ফসল বিক্রি করতে বাজারেও নিতে হচ্ছে না। ফসল বিক্রির টাকাও পাচ্ছি নগদ।’

কাহারোল উপজেলার রামপুর বাজারে আইফার্মারের ডিলার দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই এলাকার প্রধান ফসল হচ্ছে ধান, আলু, ভুট্টা। ফসল লাগানোর সময় কৃষকদের যে আর্থিক চিন্তা, সেটা দূর হতে শুরু করেছে আইফার্মার উদ্যোগে। শুধু ঋণসেবা নয়, সহজ শর্তে পাওয়ার টিলার, স্প্রে মেশিন, খড়কাটা মেশিন, ভুট্টা রোপণ যন্ত্রসহ নানান কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকের হাতের নাগালে এনেছে আই ফার্মার।’ জানালেন, তাঁর কাছেই নিবন্ধন করা আছে শতাধিক কৃষকের। কৃষকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটাও বেড়েছে।

কৃষিকাজকে আরও সহজ, স্মার্ট এবং সবার জন্য লাভজনক করে তোলাই আইফার্মারের লক্ষ্য। এমনটিই বলছেন প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহাদ ইফাজ। তিনি বলেন, ‘কৃষিকে সত্যিকারে সহায়তা করতে হলে একটি সম্পূর্ণ নিরবচ্ছিন্ন ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। সেই লক্ষ্যেই আমরা বিভিন্ন অংশীজনের জন্য ডিজিটাল টুলস তৈরি করেছি; যাতে কৃষিবিষয়ক যেকোনো সমস্যার সমাধান আরও কার্যকর ও সহজ হয়। প্রযুক্তিগুলোকে বাস্তবে কাজে লাগানোর কেন্দ্র হলো আইফার্মার। মোট কথা আইফার্মার হলো একটি ফিজিক্যাল, ওয়ানস্টপ সলিউশন, যেখানে কৃষক তাঁর প্রয়োজনীয় সব সেবা পাবেন।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আইফ র ম র র ফসল ব ক র উপজ ল র ক ষকদ র র জন য ঋণ ন য় ইনপ ট

এছাড়াও পড়ুন:

৯ ব্রোকার হাউজকে ফিক্স সার্টিফিকেশন দিল ডিএসই

নয় ব্রোকারেজ হাউজকে ফিক্স সার্টিফিকেশন ও একটি ব্রোকারেজ হাউজকে রিসার্টিফিকেশন প্রদান করেছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এপিআই সংযোগের মাধ্যমে নিজস্ব ওএমএস চালুকরণের লক্ষ্যে ডিএসই প্রতিষ্ঠানুগলোকে ফিক্স সার্টিফিকেশন প্রদান করে।

বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) ডিএসই’র বোর্ডরুমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফিক্স সার্টিফিকেশন প্রদান করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আসাদুর রহমান৷

আরো পড়ুন:

ডিএসইর চিঠির জবাব দেয়নি খুলনা প্রিন্টিং

ইস্টার্ন কেবলসের প্রথম প্রান্তিকে লোকসান কমেছে ৫৬.২৫ শতাংশ

এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিএসই’র প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা ড. মো. আসিফুর রহমান, আইসিটি ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার মো. তারিকুল ইসলাম, উপ-মহাব্যবস্থাপক হাসানুল করিমসহ ডিএসইর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

ডিএসইর প্রকাশনা ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. শফিকুর রহমান স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।

ব্রোকারেজ হাউজগুলো পক্ষে সার্টিফিকেশন গ্রহণ করেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্স সিকিউরিটিজ লিমিটেডের এমডি এবং সিইও খন্দকার মাহমুদুল হাসান; ফিনট্রা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের এমডি অজিত কুমার বণিক; আইডিএলসি সিকিউরিটিজ লিমিটেডের এমডি এ. এইচ. এম. নাজমুল হাসান; আইআইডিএফসি সিকিউরিটিজ লিমিটেডের সিইও মোঃ নাজমুল হাসান চৌধুরী; লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ পিএলসির সিইও খন্দকার সাফাত রেজা; এমটিবি সিকিউরিটিজ লিমিটেডের েসিইও মোঃ নজরুল ইসলাম মজুমদার; এসএআর সিকিউরিটিজ লিমিটেডের পরিচালক শরীফ তাশরুবা রহমান; সাউথ এশিয়া সিকিউরিটিজ লিমিটেডের সিইও মোঃ আলা উদ্দিন পাটোয়ারী এবং ওয়াইফাং সিকিউরিটিজ লিমিটেডের সিইও মোঃ মাসুদুজ্জামান। এর মধ্যে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ পিএলসির রিসার্টিফিকেশন দেওয়া হয়েছে।

ফিক্স সার্টিফিকেশন প্রদান অনুষ্ঠানে ডিএসই'র প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আসাদুর রহমান বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারের ডিজিটাল রূপান্তরের অংশ হিসেবে ডিএসই কাজ করছে। নিয়ন্ত্রক মান বজায় রেখে ডিএসইকে গ্রাহক–কেন্দ্রিক সেবাধর্মী সংস্থায় রূপ দেওয়াই যার লক্ষ্য। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে ইতিমধ্যে বিজিএমইএ, সিরামিক ও এগ্রো–কেমিক্যালসহ বিভিন্ন শিল্প খাতের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ডিএসই আশা করছে, ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে ওয়েবসাইটের আধুনিক ল্যান্ডিং পেজ, ট্রেকহোল্ডারদের অনলাইন ডকুমেন্ট সাবমিশন ব্যবস্থা এবং স্টেকহোল্ডার–ফিডব্যাক ভিত্তিক কমপ্লায়েন্স ও ডেটা–প্রবাহ উন্নয়নসহ নতুন ডিজিটাল সেবা উদ্যোগ উন্মোচিত হবে।’’ 

ডিএসইর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা ড. আসিফুর রহমান বলেন, ‘‘স্টক এক্সচেঞ্জের প্রযুক্তি ব্যাংকিং থেকে ভিন্ন—এখানে এক মুহূর্তের সার্ভিসও পুরো বাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই আমাদের সবসময় সতর্ক, মনোযোগী এবং স্ট্যান্ডার্ড-কমপ্লায়েন্ট থাকতে হয়। সাম্প্রতিক সেন্ট্রালাইজড সিস্টেম ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে আমাদের প্রযুক্তির অবস্থান এখন গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডের খুব কাছাকাছি, কিছু ক্ষেত্রে আরও এগিয়েও। ওএমএস এপ্লিকেশনে স্থানীয় টিমকে সুযোগ দেওয়া কেবল প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়—এটি দেশের জন্য একটি গর্বের অর্জন।’’ 

২০২০ সাল থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এপিআই (অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম ইন্টারফেস) ভিত্তিক বিএইচওএমএস চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই প্রেক্ষিতে ৭২টি ব্রোকারেজ হাউজ নাসডাক ম্যাচিং ইঞ্জিনে এপিআই সংযোগ নিয়ে নিজস্ব অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে লেনদেন করার জন্য ডিএসইতে আবেদন করেন। আজকের ৮টিসহ মোট ৪৭টি ব্রোকার হাউজকে ফিক্স সার্টিফিকেশন প্রদান করা হয়েছে৷ এর মধ্যে ৩৫টি ব্রোকার হাউজ ফিক্স সার্টিফিকেশন পাওয়ার পর তারা এপিআই সংযোগের মাধ্যমে নিজস্ব ওএমএস চালু করেছে।

ঢাকা/এনটি/বকুল 

সম্পর্কিত নিবন্ধ