মুক্ত দেশ না হয়েও চীন কীভাবে উদ্ভাবনে এগিয়ে
Published: 27th, November 2025 GMT
এক দশক আগে চীন ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ ঘোষণা করেছিল। এর লক্ষ্য ছিল, চীনকে সস্তা পণ্যের কারখানা থেকে বিশ্বমানের উদ্ভাবনী শক্তিতে রূপান্তর করা। তখন অনেকেই, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা মনে করতেন একনায়কতন্ত্রে উদ্ভাবন সম্ভব নয়। চীনের প্রযুক্তিভিত্তি ছিল দুর্বল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল মাঝারি মানের আর দক্ষ কর্মীর ঘাটতি ছিল। তাই ধারণা ছিল, গুরুতর রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া চীন কখনোই ‘নকলপ্রধান দেশ’ থেকে বের হতে পারবে না। কিন্তু এত দিনে এসে সেই পূর্বাভাস ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
আমার লেখা অটোক্র্যাসি ২.
চীন ভারী দমন–পীড়নে না গিয়ে বিভিন্ন সূক্ষ্ম তথ্যনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি চালু করেছে। গবেষক টনি জিরুই ইয়াং বলেন, এই কৌশল মানুষকে সেন্সরশিপের সঙ্গে অভ্যস্ত করেছে। লাঠি-গুলি ব্যবহার না করে চীন ডিজিটাল নজরদারি (যেমন এআই, মুখ চেনার প্রযুক্তি ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ) ব্যবহার করে যাতে আগেভাগেই অসন্তোষ চিহ্নিত করা যায়।
অন্যদিকে সরকার অর্থনীতির কিছু অংশ (বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি খাত) খুলে দিয়েছে এবং উদ্ভাবন বাড়াতে বড় বিনিয়োগ করেছে। গবেষণা-উন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। গত দশকে চীনে উচ্চশিক্ষার মান দ্রুত বেড়েছে এবং বিশাল প্রযুক্তিকর্মী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে।
এখন চীন অনেকটা ঊনবিংশ শতকের আমেরিকার মতো। আগে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে যেত। এখন তারা দেশে থেকেই ভালো শিক্ষা পাচ্ছে। চীন
এখন বিশ্বে সর্বাধিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশল পিএইচডি তৈরি করে। ২০২৩ সালে যে ওপেন-সোর্স এআই মডেল ডিপসিক বিশ্বকে চমকে দেয়, তার অধিকাংশ প্রকৌশলী চীনেই প্রশিক্ষিত।
চীনা কোম্পানিগুলো এখন কয়েকটি উচ্চ প্রযুক্তি খাতে বিশ্বনেতা। বিশ্বের ৮০ শতাংশ সৌর প্যানেল উৎপাদন ক্ষমতা চীনের হাতে। বৈদ্যুতিক গাড়ি ও ব্যাটারিশিল্পেও তারা শীর্ষে। ২০২৩ সালে চীন জাপানকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ি রপ্তানিকারক হয়। আর ড্রোনশিল্পে ডিজিআই একাই ৭০ শতাংশ বৈশ্বিক বাজার দখলে রেখেছে।
চীন এখনো একদলীয় রাষ্ট্র, যেখানে ভিন্নমত দমন করা হয়। তবু উদ্ভাবনে তারা জাপান, জার্মানি, ফ্রান্সকে পেছনে ফেলে গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে দশম হয়েছে। যদিও ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’-এর সব লক্ষ্য পূরণ হয়নি, তবু চীন প্রযুক্তির সামনের সারিতে চলে এসেছে। তবে কিছু পর্যবেক্ষক এখনো সন্দিহান। তাঁরা মনে করেন, সি চিন পিংয়ের অধীন বাড়তি দমন–পীড়ন উদ্ভাবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ২০২০ সালে প্রযুক্তি খাতে দমন চালিয়ে অনেক সম্পদ নষ্ট হয়েছিল; কিন্তু ‘স্মার্ট স্বৈরতন্ত্র’-এর লক্ষ্য সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি নয়। তার মূল লক্ষ্য হলো শাসন টিকিয়ে রাখা। তাই কখনো কঠোরতা বাড়ে, আবার কখনো শিথিল করা হয়। সেদিক থেকে দেখলে বোঝা যাবে, ২০২৩ সালের পর চীন প্রযুক্তি খাতে কিছুটা ছাড়ও দিয়েছে।
সি চিন পিং বলেছেন, ‘চীনের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কেউ থামাতে পারবে না!’ এটা সত্য হবে কি না, ভবিষ্যতে জানা যাবে; কিন্তু এক বিষয় নিশ্চিত, সেটি হলো পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো আর ধরে নিতে পারে না যে তারা এমনি এমনি এগিয়ে থাকবে।চীনের আরও বড় কিছু চ্যালেঞ্জ আছে; যেমন বৃদ্ধ জনসংখ্যা, কম এবং ধীর উৎপাদনশীলতা, বিশাল ঋণ এবং রিয়েল এস্টেট সংকট। এগুলো সত্যিই প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দিয়েছে; তবু চীন ইতিমধ্যে প্রযুক্তি সুপারপাওয়ার হয়ে উঠেছে এবং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য বদলে দিয়েছে, যাকে অনেকেই অসম্ভব ভাবত।
তবে এসবের মানে এই নয় যে স্বৈরশাসন গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো উদ্ভাবন করতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশগুলো এখনো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বমানের কোম্পানি এবং আন্তর্জাতিক উদ্ভাবনী নেটওয়ার্ক ধরে রেখেছে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনও প্রথম তৈরি করেছিল গণতন্ত্রসমৃদ্ধ দেশগুলো। তারা এখনো চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম।
কিন্তু পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো আর চীনের উদ্ভাবনী শক্তিকে হালকাভাবে নিতে পারে না। প্রযুক্তিতে শক্তিশালী হয়ে চীন তাইওয়ানের জন্য বড় সামরিক হুমকি এবং পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া চীনের এ সাফল্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ‘স্মার্ট স্বৈরতন্ত্র’ চালানো দেশগুলোকেও উৎসাহ দিচ্ছে। চীন অন্য একনায়কতন্ত্রকেও নজরদারি প্রযুক্তি ও দমন কৌশল দিয়ে সহায়তা করছে।
সি চিন পিং বলেছেন, ‘চীনের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কেউ থামাতে পারবে না!’ এটা সত্য হবে কি না, ভবিষ্যতে জানা যাবে; কিন্তু এক বিষয় নিশ্চিত, সেটি হলো পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো আর ধরে নিতে পারে না যে তারা এমনি এমনি এগিয়ে থাকবে।
জেনিফার লিন্ড ডার্টমাউথ কলেজের গভর্নমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং চ্যাটাম হাউসের সহযোগী ফেলো
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
উৎপাদনকারী নয়, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের: হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়
নাগরিকদের জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের, উৎপাদনকারীদের নয় বলে এক রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বলেছেন, সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশের বিধান এবং ২০২৩ সালের ওষুধ ও কসমেটিকস্ আইনের ৩০(১) ও ৩০(২) ধারায় স্পষ্টতই দেখা যায় যে জীবনরক্ষাকারী ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের এখতিয়ার নিশ্চিত করে। সংশ্লিষ্ট আইনের বিধান এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে কোনো নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ রাখেনি।
সাত বছর আগে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২৫ আগস্ট ওই রায় দেন।
২৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি আজ সোমবার হাতে পেয়েছেন বলে জানান রিট আবেদনকারীপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্য যখন-তখন ইচ্ছামাফিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নির্ধারণের সুযোগ থাকছে না।
এর আগে দ্য ড্রাগস (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২ সালে প্রণয়ন করা হয়। এটি ২০২৩ সালের ওষুধ ও কসমেটিকস আইন দিয়ে রহিত করা হয়। অধ্যাদেশের ১১(১) ধারায় সরকার গেজেট নোটিফিকেশের মাধ্যমে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে বলে উল্লেখ ছিল। আর ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামালের মূল্য নির্ধারণসংক্রান্ত ২০২৩ সালের ওষুধ ও কসমেটিকস আইনের ৩০ ধারায় বলা আছে। ৩০(১) ধারা অনুযায়ী, সরকার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে, উপধারা (২)–এর অধীন তালিকাভুক্ত এবং আমদানিকারকেরা ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করতে পারবে। ৩০(২) ধারা অনুযায়ী, সরকার উপধারা (১)–এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, যেসব ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হবে, তার একটি তালিকা প্রস্তুত করে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশ করবে।
রিট আবেদনকারীপক্ষের তথ্য অনুসারে, আইনের বিধান অনুসারে ১৯৯৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ৭৩৯টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। পরে সীমিত করে ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা রেখে ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সার্কুলার ইস্যু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই সার্কুলারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে রুল নিষ্পত্তি করে ২৫ আগস্ট নির্দেশনাসহ রায় দেন হাইকোর্ট।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ওষুধ প্রস্তুত মালিক সমিতির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দ ইজাজ কবির শুনানিতে ছিলেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, নাগরিকদের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকবে এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোর জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা থাকবে না বলে রায়ে এসেছে। হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন যে প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলোর মূল্য সরকার নির্ধারণ করবে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে মূল্য নির্ধারণ করে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে। ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের বিধান যা বর্তমানে ওষুধ ও কসমেটিকস আইনের সুনির্দিষ্ট বিধান অনুসারে সরকার কর্তৃক গঠিত কমিটির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করার বিষয়টিও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।