বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এমন বিপর্যয়ের মধ্যে আগে কখনো পড়েনি। গত দেড় দশকের লুটপাট এ খাতকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বেশির ভাগ ইসলামি ধারার ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক এখন চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এ রকম শোচনীয় অবস্থা থেকে ব্যাংক উদ্ধারের জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ, পুনর্গঠন ও অবসায়নের মধ্য থেকে উত্তম বিকল্পটি গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে ব্যাংক উদ্ধারের ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল পুনর্গঠন করে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড করা হয়, যা এখন বেসরকারি খাতের ভালো ব্যাংকগুলোর একটি।

২০০০ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এএনজেড গ্রিনলেজ ব্যাংক একীভূত হয়ে প্রথমে স্ট্যানচার্ট গ্রিনলেজ এবং পরবর্তী সময়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ব্যাংক এশিয়া ২০০১ সালে নোভা স্কশিয়া ও মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের বাংলাদেশের ব্যবসায়িক কার্যক্রম অধিগ্রহণ করে বর্তমানে সফলভাবে চলছে।

২০০৭ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংককে পুনর্গঠন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হলেও ব্যাংকটি সফল হয়নি। সর্বশেষ ২০১০ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গঠন করা হলেও এটি সফল হতে পারেনি। এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এখন ৪২.

৪৫ শতাংশ।

আরও পড়ুনপাঁচ ইসলামি ব্যাংকের একীভূতকরণের চ্যালেঞ্জ ০৭ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ, যা ২০২৫ সালের মার্চে এসে ৪,২০,৩৩৫ কোটি টাকায় (২৪.১ শতাংশ) দাঁড়িয়েছে। তবে সংকটাপন্ন সম্পদের পরিমাণ ৭,৫৬,৫২৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৪৫ শতাংশ। ঋণের মান এভাবে কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের ওপর একধরনের চাপ তৈরি হয়েছে।

যেখানে ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী একটি ব্যাংকের ১২.৫০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করা দরকার, বাস্তবে এ হার মাত্র ৩.০৮ শতাংশ, যা পাকিস্তানে ২০.৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৮.৪ শতাংশ এবং ভারতে ১৬.৭ শতাংশ। বর্তমানে ব্যাংক খাতের সামগ্রিক মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৭১,৬৮৭ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে ইসলামি ধারার বেশির ভাগ ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে অতি সম্প্রতি সরকার পাঁচটি ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন ইসলামি ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক, যাদের খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে ৪৮.২০, ৬২.৩০, ৯৬.৩৭, ৯৫ ও ৯৭.৮০ শতাংশ।

এদের মধ্যে এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের গড় হার ৫৫.২৫ শতাংশ। কিন্তু বাকি তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের গড় হার ৯৬ শতাংশের ওপরে।

সরকারের ব্যাংক উদ্ধারের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো সমালোচনা না থাকলেও পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনার অভাব নেই। কারণ, এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে পরিচালনা করা যতটা সহজ হতো, বাকি তিনটি ব্যাংককেও একীভূত করার ফলে সামগ্রিকভাবে নতুন ব্যাংকটি পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে।

ব্যাংকের এ দুর্দশার জন্য ব্যাংকাররাও দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, তাঁরা জড়িত না থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণ অনুমোদনের প্রাথমিক ধাপ পার হতে পারে না। বোর্ডের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে মন্দ হবে জেনেও ঋণ অনুমোদন দিয়ে লাখ লাখ আমানতকারীর আমানত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া ব্যাংকারদের দায়িত্বে অবহেলা বিবেচনায় নিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দুটিকে তাদের কর্মক্ষমতা উন্নত করার জন্য কয়েক বছর সময় দিয়ে দেখা যেতে পারত। বাকি তিনটি ব্যাংকেরÿক্ষেত্রে অবসায়নের কথা ভাবা যেত। যেহেতু বাংলাদেশে ব্যাংক অবসায়নের ইতিহাস নেই, তাই সরকার হয়তো এ ব্যাংকগুলোকে অবসায়নের দিকে ঠেলে দিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি।

অন্য বিকল্প হিসেবে এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দুটোকে একীভূতকরণের আওতায় না এনে তাদের অধিগ্রহণের মাধ্যমে উদ্ধারের চেষ্টাও করা যেত। তবে বেসরকারি ব্যাংকের সে সক্ষমতা এখনো হয়নি যে কোনো একটি ব্যাংক চাইলেই এক্সিম অথবা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে অধিগ্রহণ করতে পারবে।

আবার সক্ষমতা থাকলেও ৪৮ বা ৬২ শতাংশ খেলাপি ঋণের ব্যাংককে অধিগ্রহণ করে কোনো ব্যাংক নিজের কর্মদক্ষতা কমাতে চাইবে না কারণ অধিগ্রহণ ও একীভূতকরণের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে বাজার শেয়ার বাড়িয়ে মুনাফা বৃদ্ধি করা, যা এ ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব।

সরকার যে পদ্ধতিতেই ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে চাইত, সে পদ্ধতিই সমালোচনার মুখোমুখি হতো।

কারণ, এ রকম ব্যাপক মাত্রার ব্যাংক ডাকাতি ইতিপূর্বে এ দেশে ঘটেনি। আবার আমাদের আমানতকারীদেরও ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে অবসায়নের অভিজ্ঞতা নেই। বাংলাদেশে ব্যাংকও অতীতে এ রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। তাই অবস্থা বেশ জটিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে এ খাতের অভিজ্ঞদের নিয়ে এলেও পরিস্থিতির কোনো সহজ ও দ্রুত সমাধান সম্ভব নয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সর্বনিম্ন একটা সময় দিতে হবে। গ্রাহকদের ধৈর্য ধরতে হবে। আশার কথা, যেহেতু পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হয়ে একটি সরকারি ব্যাংক হবে, তাই এর ওপর জনগণের একধরনের আস্থা তৈরি হবে।

রাজনৈতিক চাপেই মূলত ব্যাংকগুলোর এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও এর সঙ্গে আরও অনেকগুলো পক্ষ জড়িত। যেমন ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কি না দেখতে হবে। কারণ, এই বোর্ডই অন্যায়ভাবে ঋণ অনুমোদনের জন্য ব্যাংকারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তাই বোর্ড সদস্যদের অপরাধ বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি এই সদস্যদের দিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ (রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা ও অন্যান্য) ঋণ অনুমোদন করিয়ে নিয়ে খেলাপি হয়েছে কি না, সে অপরাধও বিবেচনায় নিয়ে বিচার করতে হবে।

ব্যাংকগুলোর দুর্গতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও জড়িত। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে তাদের দায়িত্ব ছিল আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে সে দায়িত্ব পালন করেছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা জরুরি। কেউ যদি অন্যায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

যেহেতু সরকারি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তাদেরও সরকারি ব্যাংকগুলোর দুরবস্থার জন্য দায়বদ্ধতার আওতায় নিয়ে আসা দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থাকার পক্ষে সোচ্চার থাকলেও এ বিভাগের কর্মের দায় নিতে চান না এবং জবাবদিহির আওতায় আসেন না বললেই চলে।

ব্যাংকের এ দুর্দশার জন্য ব্যাংকাররাও দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, তাঁরা জড়িত না থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণ অনুমোদনের প্রাথমিক ধাপ পার হতে পারে না। বোর্ডের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে মন্দ হবে জেনেও ঋণ অনুমোদন দিয়ে লাখ লাখ আমানতকারীর আমানত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া ব্যাংকারদের দায়িত্বে অবহেলা বিবেচনায় নিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

ব্যাংকের ভালো কর্মদক্ষতার সঙ্গে যদি ব্যাংকারদের বোনাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তবে মন্দ কর্মদক্ষতার সঙ্গে বোনাসের সংখ্যা কমানো এমনকি বেতনও আনুপাতিক হারে কমানোর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রত্যেক ব্যাংকারকে তাঁর সঞ্চয়ের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ তাঁর ব্যাংকে জমা রাখার বিধান করা যেতে পারে, যাতে তাঁরা একই সঙ্গে ব্যাংকার ও আমানতকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে এবং ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেলে তাঁদের আমানতও যেন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

এমন দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকেও উদ্ধার করার সবচেয়ে খারাপ দিক হলো অংশীজনদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হওয়া যে বাংলাদেশে একটি ব্যাংক যতই খারাপ করুক না কেন, শেষ বিচারে এটিকে উদ্ধার করা হবে অথবা ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। এই নৈতিক ঝুঁকি থেকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। তারপরও এ ধরনের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নিকট অতীতে আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত, দৃশ্যমান ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় এনে ভবিষ্যতে কেউ এ রকম অপরাধ করলে তাদেরও একই রকম শাস্তির কঠোর বার্তা দিতে হবে।

ড. মো. মাইন উদ্দিন, অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এক স ম ও স শ য ল ইসল ম গ রহণ কর উদ ধ র র র জন য ব র আওত য় ব যবস থ র ব যবস আর থ ক র কর ম দ র দশ র ওপর এ রকম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণ: বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বিএসইসির চি

দুর্বল ও তারল্য সঙ্কটে ভুগতে থাকা পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে আমানতকারীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষার কথা বলা হলেও ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডার সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ কারণে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে এ বিষয়ে একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুযায়ী, একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না। নতুন ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। তবে সেখানে ওই পাঁচ ব্যাংকের বিনিয়োগকারীদের কোনো শেয়ার থাকবে না। এসব ব্যাংকের শেয়ার নতুন করে ইস্যু করা হবে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের বর্তমান অবস্থার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দায় নেই। এ জন্য দায়ী ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকেরা এবং তারা চিহ্নিত। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা দরকার বলে তারা মনে করছেন। তারা বলছেন, যেহেতু এখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দায় নেই, তাহলে তাদের শেয়ার কেন বাজেয়াপ্ত করা হবে? এ কারণে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণ বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি। তাদের দাবি, সরকার ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি যেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, একই রকমভাবে শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত। 

এদিকে পাঁচটি দুর্বল শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাগ্রস্ত থাকা নয়টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ১৪টি প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এর সঙ্গে যুক্ত। তবে পাঁচ ব্যাংক একীভূত করা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে পরামর্শ করেনি। উল্লেখ্য, ব্যাংক একীভূতকরণ বাস্তবায়নের জন্য অর্থমন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ডিভিশন (এফআইডি) আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। সেখানেও বিএসইসি’র প্রতিনিধি নেই। এমনকি সংশ্লিষ্ট তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য পায়নি। তারা শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগকারীদের জানাতে মূল্যসংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের সুযোগও পায়নি। ফলে, লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এখনো জানেন না তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কী?

গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে বিএসইসি জানিয়েছে, একীভূত করতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংক; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং এক্সিম ব্যাংক পিএলসির বর্তমান এই অবস্থার জন্য কোনোভাবেই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দায়ী নন। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫ এর ধারা-৭৭ এ বর্ণিত দায়ী ব্যক্তিগণ ব্যাংকগুলোর এই অবস্থার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী, যা বাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশে স্বীকৃত। উক্ত পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করার কথা জানিয়েছে বিএসইসি। 

১. ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটে প্রদর্শিত সম্পদ মূল্যায়নের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর লাইসেন্স, ব্রাঞ্চ নেটওয়ার্ক, ক্লায়েন্ট বেজ, হিউম্যান রিসোর্স বেজ, সার্ভিস ডেলিভারি মেকানিজম এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু, ইত্যাদি মূল্যায়ন করে বিক্রয় মূল্য বিবেচনায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ নির্ধারণ করা। 

২. ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটে প্রদর্শিত সম্পদ মূল্যায়নের পাশাপাশি ব্যাংক প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে সংরক্ষিত জামানত এবং দায়ী ব্যক্তিপণের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে  আদায়যোগ্য অর্থ বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ নির্ধারণ করা।

৩. ধারা-৭৭ এ বর্ধিত দায়ী ব্যক্তিগণ কর্তৃক ধারণকৃত শেয়ার ব্যাতীত অন্যান্য সাধারণ শেয়ারহোল্ডারগণ বা সাধারণ বিনিয়োগকারী কর্তৃক বিনিয়োগকৃত অর্থ সাধারণ বিনিয়োগকারীর ন্যূনতম স্বার্থ মূল্য বিবেচনা করে একীভূতকরণের অনুপাত নির্ধারণ করা।

৪. উপরিউক্ত মূল্যায়ন বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংক পাঁচটির সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ মূল্য অনুপাতে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা। এবং ব্যাংকগুলোতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ মূল্য অনুপাত নির্ধারণ ও তা ঘোষণা না করে অথবা সাধারণ বিনিয়োগকারী কর্তৃক ধারণকৃত শেয়ারের এক্যুইজেশন মূল্য নির্ধারণ এবং তা ঘোষণা না করে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে তালিকাচ্যুত না করার কথাও গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে বিএসইসি জানিয়েছে। 

উল্লেখ্য, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে শরিয়াহভিত্তিক এই পাঁচটি ব্যাংক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ব্যাংকগুলোর ঋণের বেশিরভাগই খেলাপি হয়ে থাকায় গ্রাহক আমানত ফেরত পাচ্ছেন না। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরই ধরাবাহিকতায় ব্যাংক খাতে সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিতকরণসহ সামগ্রিক আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে একটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ। গত ৯ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এর নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। নতুন এ ব্যাংকের দুটি নাম প্রস্তাব করা হয়েছে- ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ ও ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’। ব্যাংকটি বাণিজ্যিকভাবে ও পেশাদারির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে বলেও জানানো হয়েছে। 

একীভূত করার ফলে কেউ চাকরি হারাবেন না এবং কোনো আমানতকারী আমানত হারাবেন না। প্রাথমিকভাবে নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ ব্যাংকের সব দায় ও সম্পত্তি গ্রহণ করে নতুন ব্যাংকটি তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা সরকার দেবে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে নগদ, বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুক বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের শেয়ার দিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা মূলধনে রূপান্তর করা হবে বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। পরে আবার রেজল্যুশন পরিকল্পনা অনুযায়ী তা পরিশোধ করা হবে আমানতকারীদের। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমানতকারী ও অন্যান্য পাওনাদারের ঋণের একাংশ বাতিল হয়ে শেয়ারে রূপান্তরিত হয়, সেটাই হচ্ছে বেইল-ইন। নতুন ব্যাংকটি প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন হবে। পরে পর্যায়ক্রমে মালিকানা বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হবে। নতুন ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে।

এছাড়া ইসলামি ধারার যে পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে শিগগিরিই প্রশাসক বসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা একীভূত প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবেন। প্রশাসক হিসেবে এক্সিম ব্যাংকের দায়িত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শওকত উল আলম, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ বদিউল আলম দিদা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে মো. সালাহ উদ্দীন ইউনিয়ন ব্যাংকের দায়িত্বে পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসেম ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে মকসুদুল আলমকে নিযুক্ত করা হবে। তাদের সহায়তা করার জন্য প্রত্যেক ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও চারজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। এর মাধ্যমে পাঁচ ব্যাংক মিলে ইসলামি ধারার একটি ব্যাংক গড়ে উঠবে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আলোকে প্রতিটি ব্যাংকে প্রশাসকদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা রয়েছে।  

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। একজন সাধারণ শেয়ায়হোল্ডারের যত ধরনের অধিকার পাওয়ার বিষয়টি আইনে বলা হয়েছে তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে।”

ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার দরকার ছিল। ব্যাংকগুলোকে পরিচালনা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। তারপরেও ব্যাংকগুলো ঠিক মতো পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি এবং তাদের সংকটও কাটেনি। চোর-বাটপাররা আমনতকারীদের টাকা নিয়ে গেছে, তাই সরকার ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে। আমি তো মনে করি, ব্যাংকগুলোর আমানতকারীরা ভাগ্যবান। ব্যাংকগুলোর নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) পজিটিভ থাকলে শেয়ারহোল্ডাররা কিছু পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। তবে এনএভি নেতিবাচক থাকলে কিছুই পাওয়ার কথা না। তারপরেও, সরকার চাইলে সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনা করতে পারে। কারণ ব্যাংকগুলোর এমন পরিণতির জন্য আমানতকারী ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দোষ দেওয়া যাবে না।”

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুযায়ী, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬৯.২০ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.৮৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৭.৯২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫২.৯৬ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩১.৬১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৮.৬২ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.২৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬৫.১৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৭.৬৫ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.৬৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩৯.২৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৩.৬৯ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.০১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩১.৮১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
 

ঢাকা/এনটি/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মহড়াসহ সব প্রস্তুতি নেওয়া হলো, কিন্তু ‘দরিয়া–ই–নূর’ হীরার প্যাকেট খোলা হলো না
  • রাকসু নির্বাচন: ১০ দফা ইশতেহার দিল ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম
  • পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণ: বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বিএসইসির চি