নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা আইনি ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যত নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে খুব বেশি কাজে আসছে না। নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন ও মাত্রা বর্তমানে বদলেছে। সহিংসতা প্রতিরোধে প্রতিবাদ করতে হবে, নিজেদের সচেতন হতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ-২০২৫ পালন শুরুর আগে গণমাধ্যমের নারী পাতার সম্পাদক এবং নারী বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আনোয়ারা বেগম মুনিরা খান মিলনায়তনে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।

সভাপতির বক্তব্যে মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘বর্তমানে নানা পশ্চাৎপদ অবস্থার মধ্যে মানুষের মধ্যে যে তার স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, এটি আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন। পরিবারে নারী-পুরুষের প্রতি পারিবারিক আচরণ পরিবর্তিত হবে, এটি স্বাভাবিক। তবে এই পরিবর্তন যেন মানুষকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।’

এ সময় পারিবারিক ও সামাজিক পরিবর্তনের দিকগুলো গণমাধ্যমকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার জন্য আহ্বান জানান মহিলা পরিষদের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আমাদের প্রতিবাদের রূপ ও ধরন বদলাবে। প্রতিবাদ করেই নারীর অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে হবে।’

সভায় স্বাগত বক্তব্যে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন নীতিমালা গৃহীত হলেও বাস্তবে নারীর প্রতি সহিংসতা কমেছে, এমনটি বলা যাবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালনের একটি গুরুত্ব আছে।

মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এই নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালনকালে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে আমরা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে যে বার্তা দেব, যে কথাগুলো বলব এবং যে কর্মসূচিগুলো নেব ও বাস্তবায়ন করব, তা বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হবে। এর মধ্য দিয়ে আগামীর জন্য আবারও প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে। এবারের পক্ষের বিষয়বস্তু হচ্ছে সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধ করা।’

সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন ও মাত্রা বর্তমানে বদলেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শক্তিশালী নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে গণমাধ্যম সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সে জন্য গণমাধ্যমের সঙ্গে আজকের কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মহিলা পরিষদের প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক মাহফুজা জেসমিন। তিনি বলেন, দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা আইনি ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যত নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে খুব বেশি কাজে আসছে না। এ পর্যায়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা গণমাধ্যমই পারে অন্যায়ের প্রতিকারে সত্যকে সামনে নিয়ে আসতে।

সভায় মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন দৈনিক সংবাদের নাসরিন গীতি, আমার দেশ পত্রিকার এমরানা আহমেদ, উইমেন আই ২৪ ডটকমের রীতা ভৌমিক, আজকের পত্রিকার অর্চি হক, দৈনিক ইত্তেফাকের রাবেয়া বেবী, দেশ রূপান্তর পত্রিকার তাপসী রাবেয়া, মহিলা পরিষদের প্রচার ও গণমাধ্যম উপপরিষদ সদস্য তাসকিনা ইয়াসমিন, খবরের কাগজের মারওয়া জান্নাত মাইশা ও দৈনিক ভোরের ডাকের আবদুর রহমান মল্লিক। সভা সঞ্চালনা করেন মহিলা পরিষদের প্রচার ও গণমাধ্যম উপপরিষদ সদস্য সেবিকা দেবনাথ।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

কেন পুরোনো গির্জায় এক লাখ কোটি ওয়েবপেজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে

যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রেসডিও থেকে সামান্য দূরে গোল্ডেন গেট ব্রিজের পাদদেশে এক জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। তার ঠিক কাছে একটি পুরোনো গির্জার অবস্থান। পুরোনো গির্জা হলেও এখন দাঁড়িয়ে আছে ঝকঝকে সাদা ভবন হিসেবে। একসময় এটি ছিল ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্টিস্ট চার্চের ঠিকানা। আর এখন ভবনটি ইন্টারনেট ইতিহাসের আর্কাইভ নামে পরিচিতি। এটি একটি অলাভজনক ডিজিটাল লাইব্রেরি। এখানে বেশ কয়েকজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী ও গ্রন্থাগারিকদের একটি দল প্রায় ৩০ বছর ধরে ইন্টারনেট দুনিয়ার অনেক ওয়েবসাইটের বিভিন্ন পৃষ্ঠা সংরক্ষণের কাজ করে যাচ্ছেন।

রঙিন কাচের জানালা শোভিত উপাসনালয় ভবনের ভেতরে কান পাতলেই শোনা যায় সার্ভারের গুঞ্জন। এসব সার্ভারে ইন্টারনেট আর্কাইভের ওয়েব্যাক মেশিন বিভিন্ন ওয়েব পৃষ্ঠা সংরক্ষণ করছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই ওয়েব্যাক মেশিন ব্যবহার করেন। শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ এই মেশিন। অতীতে কে কী অনলাইনে প্রকাশ করেছে, তা এখান থেকে জানা যায়। অনেকের কাছে ওয়েব্যাক মেশিন ইন্টারনেটের একটি চলমান ইতিহাসের বই। এ বছরের অক্টোবর মাসে এক লাখ কোটি বা এক ট্রিলিয়ন পৃষ্ঠা সংরক্ষণের মাইলফলক ছুঁয়েছে ইন্টারনেট আর্কাইভ।

ওয়েবসাইট সংরক্ষণ করা আগের চেয়ে এখন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস বিপুল পরিমাণ সরকারি ওয়েবপেজ সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। এদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাস্তব ও কৃত্রিমভাবে তৈরি বিষয়বস্তুর মধ্যকার রেখা ঝাপসা করে দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওয়েবসাইট দেখার প্রয়োজনীয়তা বদলে গেছে। ইন্টারনেট দুনিয়ার বেশি অংশ এখন পেওয়ালের আড়ালে বা এআই চ্যাটবটের কথোপকথনে লুকিয়ে রয়েছে। সব কিছু কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, তা খুঁজে বের করার কাজ করছে ইন্টারনেট আর্কাইভ। ইন্টারনেট আর্কাইভ বিভিন্ন সংগীত, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ভিডিও গেম এবং বইও সংরক্ষণ করে। ইন্টারনেট প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বিশেষ মেশিন ব্যবহার করে পৃষ্ঠা ধরে ধরে ডিজিটাইজ করে যাচ্ছেন সেখানে।

ইন্টারনেট আর্কাইভের প্রতিষ্ঠাতা ব্রুস্টার কাহলে বলেন, ‘আমরা একটি রেকর্ড রাখার চেষ্টা করছি। মানুষ যেন তা থেকে শিখতে পারে ও একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে বা নতুন ধারণা তৈরি করতে পারে। কাহলে ১৯৯৬ সালে আর্কাইভটি তৈরি করেন। তখন এক বছরের সংরক্ষিত ওয়েবপেজ প্রায় ২ টেরাবাইটের হার্ডডিস্ক ড্রাইভে ধরে যেত। এখন আর্কাইভটি প্রতিদিন প্রায় ১৫০ টেরাবাইট বা কোটি কোটি ওয়েবপেজ সংরক্ষণ করছে।’

পুরোনো গির্জায় নিজের সদর দপ্তর স্থাপন করেন কাহলে। কাহলে বলেন, ইন্টারনেট আর্কাইভ গোটা ইন্টারনেটকে একটি লাইব্রেরি হিসেবে পরিবেশন করছে। ওয়েব্যাক মেশিনের পরিচালক মার্ক গ্রাহাম জানান, ওয়েব্যাক মেশিন শুধু ওয়েব পেজের স্ক্রিনশট নেয় না। এটি এর প্রযুক্তিগত স্থাপত্য যেমন কোডের ভাষা সংরক্ষণ করে। সার্ভার কাজ না করলেও ওয়েব্যাক মেশিন আগে ওয়েব পেজ ঠিক যেমন ছিল সেভাবে পুনরায় দেখায়। গ্রন্থাগারিক ও সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের নিয়ে গঠিত ইন্টারনেট আর্কাইভ দল এখন প্রতিদিন খবরের ওপর ভিত্তি করে শত শত প্রশ্ন ও প্রম্পট তৈরি করে। সেই প্রশ্ন ও উত্তর উভয়ই রেকর্ড করা হচ্ছে। মানুষ চ্যাটবট থেকে কীভাবে খবর পাচ্ছে তা সংরক্ষণ করা যায়।

অগ্নিকাণ্ড বা বন্যায় সার্ভারের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় ইন্টারনেট আর্কাইভের কপি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রাখা হয়। এই পদ্ধতির পেছনে রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন অপছন্দের কনটেন্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মিডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে বলে নানামুখী চাপ আছে। এখন আর্কাইভের বেশির ভাগ সার্ভার সান ফ্রান্সিসকোর বাইরে একটি বড় গুদামে রাখা আছে। যদিও সার্ভারের একটি অংশ প্রতীকীভাবে পুরোনো গির্জার মূল উপাসনালয়ে স্থাপন করা হয়েছে। কাহলে বলেন, ‘এই অবস্থানটি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন সার্ভার দেখে মানুষ বুঝবে আমরা সবাই মিলে আমাদের জ্ঞানের সুরক্ষা দিচ্ছি।’

এখন যুক্তরাষ্ট্রের সদর দপ্তর ইন্টারনেট আর্কাইভের প্রায় ২০০ জন কর্মী কাজ করেন। এখানে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বিশেষ মেশিন ব্যবহার করে বই পাতা ধরে ডিজিটাইজ করেন। সবার দেখার জন্য ইউটিউবে এসব সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এই ভবনে মাইক্রোফিল্ম থেকে শুরু করে সিডি ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন পর্যন্ত যেকোনো ধরনের সামগ্রীর জন্য সব ধরনের মিডিয়া কনসোল রাখা আছে। ভবনের দারুণ একটি বিষয় হচ্ছে সেখানে তিন ফুট লম্বা ১০০টির বেশি কর্মীর মূর্তি রয়েছে। যেসব কর্মী তিন বছর ধরে কর্মরত থাকেন, তাঁদের মূর্তি স্থাপন করা হয়।

সূত্র: সিএনএন

সম্পর্কিত নিবন্ধ