সমাজে নারীবিদ্বেষী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। ব্যাপক হারে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া হচ্ছে। মব সহিংসতা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের ফলে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। নারী ও কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা প্রতিরোধে নারীবিদ্বেষী প্রচারণাকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে।

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালন উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেতারা এসব কথা বলেছেন। সংবাদ সম্মেলনে দেশে গত ১০ মাসে (জানুয়ারি থেকে অক্টোবর) ১০টি জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের খবর তুলে ধরা হয়। বলা হয়, এ সময় দেশে মোট ২ হাজার ৪৬৮ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৭১৩ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধষর্ণের পর আত্মহত্যার শিকার হয়েছে বলে খবরে বলা হয়েছে। এ ছাড়া যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, হত্যা, বাল্যবিবাহ, যৌন নিপীড়ন, অপহরণ, সাইবার সহিংসতার মতো নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশু।

জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলা হয়, ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে এদিনকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন দিবস হিসেবে পালনের দাবি তোলা হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে দিবসটিকে স্বীকৃতি দিয়ে ঘোষণা করা হয়, ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকার লঙ্ঘন।’ ২০০০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৫ নভেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ দিনের প্রচারাভিযান চালানোর কথা বলে।

দিবসটি উপলক্ষে এবার ‘সাইবার সহিংসতাসহ নারী ও কন্যার প্রতি সকল প্রকার নির্যাতনকে না বলুন, নারী ও কন্যার অগ্রসরমানতা নিশ্চিত করুন’ স্লোগান নিয়ে ১৬ দিনের কর্মসূচি আজ শুরু করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও সামাজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে হবে। নারীবিদ্বেষী প্রচারণাকে দৃঢ়ভাবে দমন করতে হবে। গণমাধ্যমেও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এখানেও একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা দরকার।

এক প্রশ্নের জবাবে ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর জন্য কর্মস্থলে ৫ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা রাখার (বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন) কথা বলা হলো। এটা কিসের আলামত? সাধারণ নারীরাই এর উত্তর দিয়েছেন। নারীর মধ্যে জাগরণ ও মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটা কেউ দমন করতে পারবে না।

সংবাদ সম্মেলনে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সমাজ নারীর প্রতি সহিংসতাকে নানা অজুহাতে ‘অনুমোদন’ দেয়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ড নারী নির্যাতন বাড়াতে উসকানি দেয়। নারীর প্রতি বৈষম্যকে স্থায়ী করতে নানা ধরনের বয়ান দিতেও দেখা যায়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তারা নারীর বিষয় একপাশে সরিয়ে রাখতে চায়। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো সরকার ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চুপ ছিল।

সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মব ভায়োলেন্স (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা) চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা কমছে না।

সংগঠনের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, যত দিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী ক্ষমতা না পাচ্ছে, তত দিন নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন হবে না। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে। দলের মনোনয়ন পেয়ে সংরক্ষিত আসনে ‘অমুকের ভাবি’, ‘তমুকের স্ত্রী-বোন’ এলে হবে না। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসা নারীরা নারীর প্রতিনিধিত্ব করবেন, নারীর পক্ষে কথা বলবেন।

মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদের সদস্য সাবিকুন্নাহারের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংগঠনের লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা। মূল প্রতিবেদনে বলা হয়, সহিংসতা শুধু নারীর অগ্রগতিকেই রুদ্ধ করে না, সামগ্রিকভাবে সমাজ-রাষ্ট্রের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। দেশের নারী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ যদি দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়; স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যদি পিছিয়ে পড়ে; জনজীবন ও রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ যদি সীমিত হয়ে যায়; তাহলে শুধু নারীর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার অবসান ঘটে না; সমাজে অস্থিরতা, অনাচার, ব্যক্তিগত ঘৃণা-বিদ্বেষ ও সামাজিক কুপ্রথা বাড়ে।

এ বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যাণ ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, দেশের ৭৬ শতাংশ নারী কাছের মানুষের মাধ্যমে প্রধানত স্বামীর হাতে কোনো না কোনো সময় শারীরিক, মানসিক, যৌন ও আর্থিক নির্যাতন বা নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে ব্যক্তি, পরিবার ও নাগরিক সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকার, গণমাধ্যম ও নারী আন্দোলনের জন্য আলাদা সুপারিশ করা হয়। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও সহনশীলতার সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ করতে হবে। গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। নারীদের প্রতি আত্মশক্তি, আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য উদ্দীপনামূলক নতুন নতুন কর্মসূচি নিতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দমন করত ম বল ন ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে প্রস্তুতিমুলক সভা

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে প্রস্তুতিমুলক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মোঃ রায়হান কবির এর সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় আগামী ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১১ টায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ডিসির সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভা ও পঞ্চবটি বদ্ধভুমিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের সকালে সরকারী ও বেসরকারী সকল দপ্তরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ সরকারী ভবনে আলোকসজ্জা করন, ৩১বার তোপধ্বনি, চাষাড়া বিজয় স্তম্ভে পুস্পস্তবক অর্পন করা হবে। ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামে শিশু কিশোর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও শিল্পকলা একাডেমিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সম্মাননা প্রদান করা হবে।

এ সময় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. রায়হান কবির বলেন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতার সেই সকল অকুতোভয় সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কখনো ভুলবো না। এর সাথে ২৪ এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদেরকেও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা নতুন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ পেয়েছি। তাদের এই ত্যাগ ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকবে।

জেলা প্রশাসক বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পঞ্চবটি বদ্ধভূমিতে ফুলেল শুভেচ্ছা নিবেদনসহ বিভিন্ন  মসজিদে মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে তাদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়ার আয়োজন করা হবে। এছাড়াও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

ভূমিকম্পের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সকল দপ্তরের কর্মকর্তাদের আহ্বান করেন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন বিল্ডিং চিহ্নিত করাসহ ঝুঁকিপূর্ণ আরো বিল্ডিং এর খোঁজখবর নেওয়ার বিষয়ে মতমতা প্রকাশ করেন। এছাড়াও ভবিষ্যতে ভূমিকম্প হলে বড় ধরনের কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেই দিকে সবার দৃষ্টির রাখার আহ্বান জানান।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোঃ আলমগীর হোসাইন এর সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন- নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ আ,ফ,ম মশিউর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাসমিন আক্তার, নারায়গঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সদস্য সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ নুর আলম, মহানগর  বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট  সাখাওয়াত হোসেন খান, জামায়েত ইসলামী কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য মাওলানা মঈন উদ্দিন, ইসলামী আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ।

এছাড়াও জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন  দপ্তরের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ  ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানগন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সহ সুশীল সমাজ এর নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ