ফিলিস্তিনের গাজায় পাঁচ বছরে জন্য যুদ্ধবিরতির একটি চুক্তি করতে রাজি হয়েছে হামাস। এই চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি হামাসের হাতে বন্দি বাকি সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসরের সঙ্গে আলোচনার পর আজ শনিবার এমন তথ্য জানিয়েছেন হামাসের এক কর্মকর্তা।

গাজায় ১৮ মাসের বেশি সময় ধরা চলমান সংঘাতের মধ্যে গত ১৯ জানুয়ারি থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। পরে ১৮ মার্চ থেকে যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। তারপর থেকে হামাস ও ইসরায়েল—দুই পক্ষ আলোচনায় বসলেও যুদ্ধবিরতি নিয়ে একমত হতে পারেনি। এরই মধ্যে সম্প্রতি যুদ্ধবিরতির নতুন প্রস্তাব দেয় মিসর।

নতুন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য কায়রো সফর করেছিল হামাসের একটি প্রতিনিধিদল। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সংগঠনটির এক কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, পাঁচ বছর মেয়াদি একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিনিময়ে একসঙ্গে সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত আছেন তাঁরা। হামাসের কাছে এখনো ৫৮ জন জিম্মি বন্দী আছেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার।

মিসরের এই প্রস্তাবের আগে ‘আংশিক’ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল ইসরায়েল। ওই প্রস্তাবে ৪৫ দিনের যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে ১০ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলেছিল দেশটি। তবে ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেয় হামাস। তারা দাবি করে আসছে—আংশিক নয়, যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ পুরোপুরি বন্ধের দিকে এগোতে হবে। এ সময় গাজা থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করবে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের হামলায় নিহত আরও ১৭

যুদ্ধবিরতি নিয়ে তৎপরতার মধ্যেই গাজায় তীব্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। স্থানীয় সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আজ ভোর থেকে উপত্যকাটিজুড়ে হামলায় অন্তত ১৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গাজা নগরের একটি বাড়িতে হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছেন। ওই বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে আনুমানিক ২০ জন চাপা পড়ে আছেন।

এই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান উম ওয়ালিদ আল–খৌর। তিনি বলেন, ‘হামলার সময় সবাই সন্তানদের নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। আমাদের ওপর বাড়িটি ভেঙে পড়ে। যাঁরা প্রাণে বেঁচে যান, তাঁরা সাহায্যের জন্য কান্নাকাটি করতে থাকেন। তবে কেউ আসেনি। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই শিশু।’

এ নিয়ে ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভাঙার পর থেকে গাজায় অন্তত ২ হাজার ৬২ জনে মৃত্যু হলো। আর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নৃশংসতায় উপত্যকাটিতে নিহত হয়েছেন প্রায় ৫২ হাজার মানুষ। আহত লক্ষাধিক। সেদিন ইসরায়েলের হামলা শুরুর আগে দেশটিতে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে জিম্মি করা হয় ২৫১ জনকে।

আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি ভাঙার পর গাজায় ২ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল২৫ এপ্রিল ২০২৫

শেষ হয়ে এসেছে ত্রাণ

গাজায় হামলার পাশাপাশি গত ২ মার্চ থেকে উপত্যকাটিতে ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি বাহিনী। এতে উপত্যকাটিতে খাবার, পানি, জ্বালানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আজ জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, গাজায় তাদের কাছে থাকা ত্রাণসহায়তা কমে এসেছে।

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রধান ত্রাণ সরবরাহকারীদের মধ্যে একটি ডব্লিউএফপি। সংস্থাটি বলেছে, তাদের হাতে থাকা খাবারের বাকি মজুত গাজার বাসিন্দাদের খাবার সরবরাহকারী রান্নাঘরগুলোকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই রান্নাঘরগুলোর খাবার পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। গাজায় চিকিৎসা সরঞ্জামেরও একই অবস্থা বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

তীব্র সংকটের মধ্যেও গাজায় ত্রাণসহায়তা প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার উপত্যকাটির ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য। আর ডব্লিউএফপিকে গাজায় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসেবে অবশ্যই খাবারকে ব্যবহার করা যাবে না।

আরও পড়ুনহামাস যেভাবে ইসরায়েলের ‘অপরাজেয়তার মিথ’ ভেঙে দিল২৪ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র প রস ত ব

এছাড়াও পড়ুন:

পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষা বাঁধের আরও ২০০ মিটার বিলীন

পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষা বাঁধের আরও ২০০ মিটার অংশ পদ্মায় বিলীন হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার বাঁধটির ওই অংশ নদীতে বিলীন হয়। এ সময় নদীগর্ভে চলে গেছে বাঁধের পাশে থাকা ২০টি বসতবাড়ি। আর ভাঙন আতঙ্কে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ৫০টি বাড়ির বসতঘর ও বিভিন্ন স্থাপনা। এ নিয়ে ৬ দফায় বাঁধটির ৮০০ মিটার পদ্মায় বিলীন হয়ে গেল।

ভাঙন রোধে গত তিন মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উদ্যোগে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল। ভাঙনের কারণে তা–ও নদীতে তলিয়ে গেছে। বাঁধের ওই ৮০০ মিটার অংশের পাশে থাকা ৩৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ৫০টি বসতবাড়ি গত দুই মাসে বিলীন হয়েছে। ভাঙন বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনটি গ্রামের ৬০০ পরিবার এবং মঙ্গল মাঝি-সাত্তার মাদবর ঘাট ও বাজারের ২৪০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিতে পড়েছে।

শরীয়তপুর পাউবো ও স্থানীয় সূত্র জানা যায়, শরীয়তপুরের পদ্মা নদীর অংশ জাজিরার নাওডোবা এলাকা থেকে শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু নাওডোবার ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে পদ্মা নদীর ৫০০ মিটারের মধ্যে সার্ভিস এরিয়া ২, সেনানিবাস, পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এসব অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যখন জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তখন ২০১২ সালের দিকে নাওডোবা এলাকায় পদ্মার ভাঙন শুরু হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা নদীভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তখন সেতু থেকে ভাটির দিকে (পূর্ব দিকে) দুই কিলোমিটার এলাকায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ওই বাঁধের পাশে (দক্ষিণ দিকে) আলাম খাঁরকান্দি, ওছিম উদ্দিন মাদবরকান্দি, উকিল উদ্দিন মুন্সিকান্দি এবং মঙ্গল মাঝি-সাত্তার মাদবর ঘাট ও বাজার অবস্থিত।

পাউবো সূত্র বলছে, গত বছর নভেম্বর মাসে জাজিরার নাওডোবা জিরো পয়েন্ট এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষা বাঁধের ১০০ মিটার অংশে ভাঙন দেখা দেয়। এরপর এ বছর ৭ জুন আবার বাঁধের ১০০ মিটার, ৭ জুলাই ২০০ মিটার, ৯ জুলাই ১০০ মিটার, ২৩ জুলাই ১০০ মিটার অংশ ভেঙে নদীতে ধসে পড়ে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার ওই বাঁধের আরও ২০০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন ঠেকাতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ৬০০ মিটার অংশে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পাউবো। এ পর্যন্ত ওই এলাকায় ১ লাখ ৫৫ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তাতে ব্যয় হয়েছে ৭ কোটি টাকা। তাও কোনো কাজে লাগেনি। ভাঙনের কারণে ওই জিও ব্যাগগুলো নদীতে তলিয়ে গেছে। ওই এলাকা দিয়ে নদী অন্তত ১০০ মিটার হতে ১৫০ মিটার ভেতরে (দক্ষিণ দিকে) প্রবেশ করেছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে পদ্মার ভাঙনে আলম খাঁরকান্দি এলাকার আবুল বাশার মাদবরের দুটি ঘরসহ বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ঘরের অবশিষ্ট জিনিসপত্র তিনি সড়কের পাশে স্তূপ করে রেখেছেন। আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা তীরে বাড়ি হওয়ায় তিন দফা ভাঙনের কবলে পড়েছি। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় বাড়ির সঙ্গে বাঁধটি হওয়ায় ভেবেছিলাম আর কখনো ভাঙনে নিঃস্ব হতে হবে না। কিন্তু তা আর হলো না, আমার সব শেষ। এখন বেঁচে থাকার জন্য আর কিছুই রইল না। উদ্বাস্তু হয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছি।’

ভাঙন আতঙ্কে গতকাল শুক্র ও আজ শনিবার তিনটি গ্রামের ৫০টি বসতবাড়ির বিভিন্ন স্থাপনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আলী হোসেন মাদবর নামের একজন শনিবার সকাল থেকে দুটি বসতঘর ভেঙে মালামাল সরাচ্ছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ভাঙনের কারণে একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম। রাতে আতঙ্কে ঘুমাতে পারতাম না। এখন আর পদ্মা পারে থাকতেই পারলাম না। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ফেলে ঘর নিয়ে চলে যাচ্ছি। জানি না কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেব।’

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক হাসান প্রথম আলোকে জানান, নদীতে অনেক স্রোত। ভাঙন ঠেকাতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে, তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ভাঙনের কারণে বালুভর্তি জিও ব্যাগ নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। জাজিরার ওই স্থানে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীভাঙনের শিকার হয়ে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, এটা কষ্টদায়ক। আমরা ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর নির্মাণের জন্য টিন, নগদ টাকা ও খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। যাঁরা ভিটেমাটি হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়েছেন, তাঁদের পুনর্বাসন করার জন্য খাসজমি খোঁজা হচ্ছে। সেই জমিতে তাঁদের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ