বৃষ্টির একেকটি ফোঁটাই যেন তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ
Published: 2nd, August 2025 GMT
শুক্রবার সকাল। খুলনার কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখ সরদারপাড়া গ্রাম। রাতভর ঝরার পর বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ আগে। গ্রামের পিচ্ছিল পথ ধরে হেঁটে চলতে হয় পা মেপে মেপে। চারপাশ কাদা আর পানিতে একাকার। তারই ফাঁকে চোখে পড়ে এক জরাজীর্ণ ঘর। ঘরের সামনে মাটির উঁচু ঢিবিতে বসানো একটি পুরোনো মাটির হাঁড়ি। ঘরের চালের সঙ্গে বাঁধা মরিচা ধরা এক টুকরা টিন। তার মাথায় ঝুলিয়ে রাখা দড়ির সঙ্গে টিনের ভাঙা টুকরা জোড়া দেওয়া। সেখান থেকে পানি চুইয়ে পড়ছে হাঁড়ির ভেতর।
পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির বাসিন্দা ৭০ বছরের ছবিরন বেগম হাঁড়ি থেকে মগে করে পানি তুলে নিচে রাখা বালতিতে ঢালছেন। বাড়ির মধ্যে পা দিতেই এগিয়ে এলেন ছবিরনের পুত্রবধূ ফজিলা খাতুন। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের এই উপায়টা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। বললেন, ‘খাওয়ার পানির বড় কষ্ট আমাগের। বৃষ্টি হলেই এই পানি জমাই, এইটাই খাই। কিন্তু গোসল করি নদীর লোনাপানিতে। আর বৃষ্টি না থাকলে তখন নৌকা নিয়ে অনেক দূরের পুকুরে যাইতে হয় খাওয়ার পানি আনতে।’
ছবিরন বেগমদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশপাশে একই চিত্র দেখা যায়। কোথাও ঘরের সামনে পলিথিন ঝুলিয়ে হাঁড়িপাতিল পেতে রাখা হয়েছে, কোথাও আবার চালের নিচে প্লাস্টিকের ড্রামের সাহায্যে বানানো হয়েছে অস্থায়ী রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম। জীবনযুদ্ধে রোজগারের পাশাপাশি পানি জোগাড় করাটাও এখানে বড় এক চ্যালেঞ্জ।
শেখ সরদারপাড়ার গল্প যেন পুরো কয়রা উপজেলার প্রতিচ্ছবি। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন মহেশ্বরীপুর, বাগালী, আমাদি, মহারাজপুর ও সদর ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামে বছরজুড়েই মিঠাপানির তীব্র অভাব। নলকূপ থাকলেও লবণাক্ত পানি ওঠে, তাই বৃষ্টির পানি আর দূরের পুকুরই ভরসা।
শেখ সরদারপাড়া গ্রামের পাশের কয়রা নদীর পানি মুখে দিয়ে চেখে দেখা যায় লবণাক্ততা কিছুটা কমেছে বর্ষার কারণে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে সেই পানি মুখের কাছেও নেওয়া যায় না। নদী থেকে কলসিতে পানি ভরে বেড়িবাঁধ বেয়ে ফিরছিলেন আসমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘নদীর এই নোনাপানিতেই ঘরের সব কাজ করি। এখন বৃষ্টির পানি খাই, বর্ষা গেলে সেইটাও পাই না। নোনাপানির কারণে গায়ের রং কালচে হয়ে গেছে। দূরের আত্মীয়রাও আর এখানে আসতে চায় না।’
গ্রামের আসাদুল ইসলাম বলেন, গত বছর গ্রামের কয়েকজন মিলে খুলনার রূপসা নদীর নৌকাবাইচে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। পুরস্কারের টাকায় এলাকায় একটি মিষ্টি পানির পুকুর খনন করা হয়েছে। এখন বৃষ্টি না হলে সেই পুকুরের পানি দিয়েই গ্রামের মানুষ কিছুটা হলেও মিঠাপানির সংকট মেটানোর চেষ্টা করে। ছোট্ট সেই জয় আজ অনেকের জীবনের বড় ভরসা হয়ে উঠেছে।
এই বাস্তবতার কথা জানিয়ে কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর সমাধান পেতে হলে প্রকৃতির দিকেই ফিরতে হবে। বর্ষাকালে পানি ধরে রাখতে বেশি করে পুকুর খনন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি চালু করলেই একদিন এই পানির সংকট কমে আসবে।
কয়রা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, উপকূলীয় কয়রায় লবণাক্ততার কারণে অনেক স্থানে গভীর নলকূপ বসিয়েও সুপেয় পানি মিলছে না। তাই ভূ-উপরিস্থ ও বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছেন। তিনি জানান, সরকারিভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য পানির ট্যাংক দেওয়া হচ্ছে, কেউ এখনো না পেলে আবেদন করলে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে।
যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে।
রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”
তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।
শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’
ঢাকা/শহিদুল/এস