বটতলায় থেমে থাকা রিকশায় এক বাবার জীবনসংগ্রামের ছবি
Published: 2nd, August 2025 GMT
শ্রাবণের বর্ষাস্নাত বিকেল। বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ে নৌকাগুলো দুলছে। নদীতীরে মানুষের ভিড়। এমন বিকেলে নগরের ত্রিশ গোডাউন এলাকার বটতলায় ব্যাটারিচালিত একটি রিকশায় অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখা গেল। দুজন যাত্রীকে নিয়ে এসে বটতলায় থামলেন রিকশাচালক। চালকের কোলে বসা একটি শিশু আর পাদানিতে জবুথবু হয়ে বসে আসে আরেকটি শিশু।
কাছে গিয়ে জানা গেল, শিশু দুটির বাবা রিকশাচালক মো.
জীবিকার তাগিদে এক যুগ আগে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থেকে বরিশালে আসেন সোহাগ মিয়া। দুই ভাই ও এক বোন। বাবার এক শতাংশ বাড়ির জমি আছে। মা-বাবার মৃত্যুর পর ওইটুকু জমিতে ঘর তুলে মাথা গোঁজার মতো অবস্থা না থাকায় বড় ভাই আবুল হোসেন ঢাকায় গিয়ে শ্রমিকের কাজ নেন। বোন পুতুলের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় স্বামীর সংসারে আছেন। আর সোহাগ বরিশালে চলে আসেন।
আট বছর আগে বিয়ে করেন। এরপর রিকশা চালিয়ে তাঁদের সংসার ভালোই চলছিল। একে একে দুই সন্তান আসে সংসারে। সম্প্রতি তাঁদের সংসারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। প্রায় তিন মাস আগে স্ত্রী দুই সন্তানকে রেখে সোহাগকে তালাক দিয়ে অন্যত্র চলে যান। একদিকে সংসার ভাঙার কষ্ট, অন্যদিকে ছোট্ট দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়েন সোহাগ। ঘরে বসে থাকলে জীবন চলবে না। ছোট বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে বাধ্য হয়ে পথে নামেন, রিকশার হ্যান্ডল ধরেন শক্ত হাতে। কোলে ছোট্ট জান্নাতি, পাদানিতে ছেলে রমজান পাদানি আঁকড়ে ধরে বসে থাকে।
গতকাল শুক্রবার কথা হয় সোহাগের সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এই দুনিয়ায় একেকজন মাইনসের একেক রকমের কষ্ট। অবুঝ দুইটা শিশুরে কার কাছে রাইখ্যা আমু। তাই লগে লগে রাখি। আমারও কষ্ট হয়, ওগোরও কষ্ট হয়। কিন্তু কী করমু কন?’
সোহাগ মিয়া জানান, তাঁর মন ভেঙে গেছে। ভাঙা মন আর জোড়া লাগবে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কখনো আর বিয়ে করবেন না। দুই ছেলেমেয়ে আঁকড়ে বাকি জীবন বাঁচবেন। ওদের পড়াশোনা করিয়ে বড় করবেন। বাচ্চাদের কষ্টের কথা ভেবে দুপুরের পর একবেলা রিকশা চালান। সকালে রান্নাবান্না করে বাচ্চাদের খাওয়ান ও নিজে খান। তারপর রাস্তায় নামেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করেন। এর মধ্যে রিকশার ভাড়া ৩০০ টাকা দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে বাজার-সদাই ও বাসা ভাড়া দিয়ে জীবনটাকে জিয়ে রেখেছেন।
সোহাগ মিয়া বললেন, ‘বাচ্চারা ভালোমন্দ খেতে আবদার করে। কিন্তু যে আয় করি হেইয়্যা দিয়ে দুই বেলা ভাতই তো মুখে তুইল্লা দেতে পারি না। হ্যারপর ভালোমন্দ! যদি নিজের একটা রিকশা থাকত, তয় ওগো জন্য কিছু করতে পারতাম। কিন্তু কেডা দেবে হেইয়্যা।’
সোহাগ যখন নিজের দুর্দশার কথা বলছিলেন, ছোট্ট জান্নাতি ও রমজান বাবার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল। ছোট্ট রমজান পাদানিতে বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে বলছিল, ‘ও আব্বা লও, বাড়ি লও...।’ ছোট্ট শিশুর আকুতি যেন ছুরির মতো বিদ্ধ করে নগর জীবনের হৃদয়হীন দেয়াল। সোহাগের জীবন গল্প কারও চোখে শুধুই দারিদ্র্য, কারও চোখে মায়ামাখা সংগ্রাম। কিন্তু বাস্তবতা হলো নগরীতে ছুটে চলা হাজারো সোহাগের মতোই কেউ কেউ নিজের জীবনটাকে সন্তানদের কোলে, পাদানিতে কিংবা ভালোবাসার রিকশার হ্যান্ডলে বেঁধে রাখেন—নীরবে, নিঃশব্দে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বটতলায় থেমে থাকা রিকশায় এক বাবার জীবনসংগ্রামের ছবি
শ্রাবণের বর্ষাস্নাত বিকেল। বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ে নৌকাগুলো দুলছে। নদীতীরে মানুষের ভিড়। এমন বিকেলে নগরের ত্রিশ গোডাউন এলাকার বটতলায় ব্যাটারিচালিত একটি রিকশায় অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখা গেল। দুজন যাত্রীকে নিয়ে এসে বটতলায় থামলেন রিকশাচালক। চালকের কোলে বসা একটি শিশু আর পাদানিতে জবুথবু হয়ে বসে আসে আরেকটি শিশু।
কাছে গিয়ে জানা গেল, শিশু দুটির বাবা রিকশাচালক মো. সোহাগ মিয়া। ছেলে রমজানের বয়স সাড়ে ছয় বছর আর মেয়ে জান্নাতের বয়স চার বছর। ওদের মা নেই। তাই দুই সন্তানকে এভাবে কোলে ও পাদানিতে বসিয়ে প্রতিদিন রিকশা চালান সোহাগ মিয়া। থাকেন নগরের জিয়া সড়ক এলাকার একটি খুপরিতে। পরিবারে আর কেউ নেই, যাঁর কাছে শিশুসন্তানদের রেখে জীবিকার জন্য বাইরে বের হবেন। বাধ্য হয়ে ছোট্ট দুই শিশুকে নিয়ে এভাবে প্রতিদিন রাস্তায় নামেন তিনি।
জীবিকার তাগিদে এক যুগ আগে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থেকে বরিশালে আসেন সোহাগ মিয়া। দুই ভাই ও এক বোন। বাবার এক শতাংশ বাড়ির জমি আছে। মা-বাবার মৃত্যুর পর ওইটুকু জমিতে ঘর তুলে মাথা গোঁজার মতো অবস্থা না থাকায় বড় ভাই আবুল হোসেন ঢাকায় গিয়ে শ্রমিকের কাজ নেন। বোন পুতুলের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় স্বামীর সংসারে আছেন। আর সোহাগ বরিশালে চলে আসেন।
আট বছর আগে বিয়ে করেন। এরপর রিকশা চালিয়ে তাঁদের সংসার ভালোই চলছিল। একে একে দুই সন্তান আসে সংসারে। সম্প্রতি তাঁদের সংসারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। প্রায় তিন মাস আগে স্ত্রী দুই সন্তানকে রেখে সোহাগকে তালাক দিয়ে অন্যত্র চলে যান। একদিকে সংসার ভাঙার কষ্ট, অন্যদিকে ছোট্ট দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়েন সোহাগ। ঘরে বসে থাকলে জীবন চলবে না। ছোট বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে বাধ্য হয়ে পথে নামেন, রিকশার হ্যান্ডল ধরেন শক্ত হাতে। কোলে ছোট্ট জান্নাতি, পাদানিতে ছেলে রমজান পাদানি আঁকড়ে ধরে বসে থাকে।
গতকাল শুক্রবার কথা হয় সোহাগের সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এই দুনিয়ায় একেকজন মাইনসের একেক রকমের কষ্ট। অবুঝ দুইটা শিশুরে কার কাছে রাইখ্যা আমু। তাই লগে লগে রাখি। আমারও কষ্ট হয়, ওগোরও কষ্ট হয়। কিন্তু কী করমু কন?’
সোহাগ মিয়া জানান, তাঁর মন ভেঙে গেছে। ভাঙা মন আর জোড়া লাগবে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কখনো আর বিয়ে করবেন না। দুই ছেলেমেয়ে আঁকড়ে বাকি জীবন বাঁচবেন। ওদের পড়াশোনা করিয়ে বড় করবেন। বাচ্চাদের কষ্টের কথা ভেবে দুপুরের পর একবেলা রিকশা চালান। সকালে রান্নাবান্না করে বাচ্চাদের খাওয়ান ও নিজে খান। তারপর রাস্তায় নামেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করেন। এর মধ্যে রিকশার ভাড়া ৩০০ টাকা দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে বাজার-সদাই ও বাসা ভাড়া দিয়ে জীবনটাকে জিয়ে রেখেছেন।
সোহাগ মিয়া বললেন, ‘বাচ্চারা ভালোমন্দ খেতে আবদার করে। কিন্তু যে আয় করি হেইয়্যা দিয়ে দুই বেলা ভাতই তো মুখে তুইল্লা দেতে পারি না। হ্যারপর ভালোমন্দ! যদি নিজের একটা রিকশা থাকত, তয় ওগো জন্য কিছু করতে পারতাম। কিন্তু কেডা দেবে হেইয়্যা।’
সোহাগ যখন নিজের দুর্দশার কথা বলছিলেন, ছোট্ট জান্নাতি ও রমজান বাবার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল। ছোট্ট রমজান পাদানিতে বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে বলছিল, ‘ও আব্বা লও, বাড়ি লও...।’ ছোট্ট শিশুর আকুতি যেন ছুরির মতো বিদ্ধ করে নগর জীবনের হৃদয়হীন দেয়াল। সোহাগের জীবন গল্প কারও চোখে শুধুই দারিদ্র্য, কারও চোখে মায়ামাখা সংগ্রাম। কিন্তু বাস্তবতা হলো নগরীতে ছুটে চলা হাজারো সোহাগের মতোই কেউ কেউ নিজের জীবনটাকে সন্তানদের কোলে, পাদানিতে কিংবা ভালোবাসার রিকশার হ্যান্ডলে বেঁধে রাখেন—নীরবে, নিঃশব্দে।